সোমবার, ২৯ মার্চ ২০২১, ০৯:০১ অপরাহ্ন
সূর্যগ্রহণ ও গাভী ॥ মূল: আউগুস্তো মোনতের্রোসো
সূর্যগ্রহণ
ব্রাদার বার্তোলোমে আরবাসোলা যখন বুঝতে পারলেন যে পথ হারিয়ে ফেলেছেন, অগত্যা মেনে নিলেন যে কোনো কিছুই তাকে আর বাঁচাতে পারবে না। গুয়াতেমালার সাংঘাতিক জঙ্গল, অনমনীয় ও চরম, তাকে বিহ্বল করেছে। ভূসংস্থান সম্পর্কে অজ্ঞাত বিধায় তিনি বসলেন শান্ত হয়ে মৃত্যুর অপেক্ষায় থেকে। ওখানেই মরতে চাইলেন, কোনো আশা ছাড়াই, একাকী, সূদূর এস্পানিয়ার চিন্তায় মগ্ন থেকে, বিশেষ করে লোস আব্রাহোস—এর মঠের চিন্তায়, যেখানে রাজা পঞ্চম কার্লোস একবার তার উঁচু আসন থেকে নেমে এসেছিলেন তাকে বলবার জন্য যে তার পাপমোচনকর্মের ধর্মীয় উদ্দীপনায় তার আস্থা আছে।
ঘুম থেকে উঠে তিনি দেখেন যে নিরাসক্ত চেহারার এক দল দেশজ ইন্দিয়ো তাকে ঘিরে রয়েছে যারা বেদিকার সামনে তাকে বিসর্জন দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে, এক বেদিকা যা বার্তোলোমের কাছে মনে হল খাট যার ওপর তিনি বিশ্রাম নেবেন, অবশেষে, তার শঙ্কা, তার নিয়তি, তার আপন সত্তা থেকে।
দেশটিতে তিন বছরের অবস্থান তাকে প্রদান করেছে স্থানীয় ভাষাগুলির উপর আধখানা দখল। তিনি কিছু একটা চেষ্টা করলেন। কিছু শব্দ ব্যক্ত করলেন যা তারা বুঝতে পারল।
তখন তার মাথায় একটা চিন্তা কুসুমিত হল যা তার প্রতিভা এবং বিশ্বজনীন শিক্ষা এবং অ্যারিস্টটলকে নিয়ে তার গভীর জ্ঞানের উপযুক্ত বিধায় তার মধ্যে ছিল। তার মনে পড়ল যে সেই দিন সূর্যের পূর্ণগ্রহণ হওয়ার কথা। এবং সিদ্ধান্ত নিলেন, তার মনের গহিনে, সেই জ্ঞান ব্যবহার করে নিজের জীবন বাঁচানোর, তার অত্যাচারীদেরকে ঠকিয়ে।
হ্যাঁ—যদি আমাকে তোমরা মেরে ফেলো তাদেরকে বললেন—আমি এমন করতে পারি যে সূর্যটা উপরে আঁধারকালো হয়ে যাবে।
ইন্দিয়োরা তার দিকে স্থির চোখে তাকালো এবং বার্তোলোমে অবাক হলেন তাদের চোখে অবিশ্বাস দেখে। দেখলেন যে তাদের মধ্যে ছোটখাটো কথাবার্তা চলছে, এবং তিনি দৃঢ়চিত্তে অপেক্ষা করলেন, এক ধরনের ঘৃণা না নিয়ে নয়।
দুই ঘণ্টা পর ব্রাদার বার্তোলোমে আররাসোলার হৃৎপিণ্ড থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটল প্রবলভাবে বিসর্জনের পাথরের উপর (সূর্যগ্রহণের অস্বচ্ছ আলোর নীচে দ্যুতিময়) আর তখন ইন্দিয়োদের একজন পাঠ করে যাচ্ছিল কণ্ঠস্বরের কোনও প্রত্যয় ছাড়াই, ধীরে ধীরে, একের পর এক, অন্তহীন তারিখের তালিকা যখন সূর্য ও চন্দ্রের গ্রহণ হবে, যা মাইয়া গোত্রের জ্যোতির্বিদরা ভাবীকথন করে গেছেন এবং তাদের পুুঁথিতে টুকে রেখেছেন অ্যারিস্টটলের গুরুত্বপূর্ণ সাহায্য ছাড়াই।
গাভী
সেদিন ট্রেনে চড়ে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ কেন যেন খুব ভালো লাগল, আসন ছেড়ে উঠে দুই পায়ে ভর দিয়ে জানালার বাইরে দৃষ্টি দিলাম। কী সুন্দর নিসর্গ আর গোধূলীবেলার দৃশ্য! দুই চোখ ভরে যায়। অন্যদেরকে ইশারা করলাম চোখ মেলে চাইবার জন্য। ট্রেনের কামরার নারী, শিশু আর জনাকয়েক পুরুষ নিজেদের কথাবার্তা থামিয়ে আমার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে হাসলেন। খানিকক্ষণের মধ্যে নিজের আসনে ফিরে আসলাম ঠিকই, কিন্তু ট্রেনের কামরার কেউই জানল না যে বসে পড়ার ঠিক আগ মুহূর্তে রেল লাইনের মেঠো রাস্তার পাড়ে আমি কী দেখলাম! দেখলাম মৃত, প্রশ্নাতীতভাবে মৃত এক গাভী মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। চলমান ট্রেনের গতির সঙ্গে ধাবমান আমার দৃষ্টির আড়ালে চলে গেল সে দৃশ্য, ধীরে ধীরে। কে এই গাভীকে সমাধিস্থ করবে, কে-ই বা সম্পাদনা করবে তার রচনাসমগ্র। তার গুণকীর্তন করে জ্বালাময়ী, হৃদয় নিংড়ানো ভাষণ দেবে এমন লোকই বা কোথায়; যে এতগুলি দিন আমাদেরকে এমনভাবে সাহায্য করে গেল, যার সফেন দুধের স্রোতধারায় জীবন বয়ে যায় নিরবধি— কে বলবে তার কথা! এ তো গেল সাধারণের কথা! আর বিশেষভাবে বলতে গেলে এই যে ট্রেনের ছুটে চলা তা—ও ওই গাভীটিরই কারণে নয় কি?
[আউগুস্তো মোনর্তেরোসো (১৯২১-২০০৩) মধ্য আমেরিকার দেশ গুয়াতেমালার একজন মহান লেখক যদিও হিস্পানি দুনিয়ার বাইরে তাঁর নাম জানেন অল্প কয়জনই। স্বল্পভাষিতা তাঁর রচনার প্রধান একটি বৈশিষ্ট্য। কুড়ি শতকের লাতিন আমেরিকার ছোট গল্পের ভুবনে তিনি একটি বিশিষ্ট নাম। তাঁর গল্পের সাজগোজই অন্য রকম — কি ভাষায়, কি বিষয়ে, কি ভঙ্গিমায়। এখানে তর্জমা করা দুইটি গল্প ১৯৫৯ সালে প্রকাশিত তাঁর লাস ওব্রাস কোমপ্লেতাস ই ওত্রোস কুয়েন্তোস গ্রন্থ থেকে নেয়া। তিনি হিস্পানি সাংস্কৃতিক দুনিয়ার মর্যাদাকর হুয়ান রুলফো পুরস্কার এবং প্রিন্সিপে দে আস্তুরিয়াস পুরস্কারে ভূষিত হন।]