মঙ্গলবার, ১৬ নভেম্বর ২০২১, ০৩:৩০ অপরাহ্ন
আর্নেস্ট হেমিংওয়ের “ছোট্ট এক গল্প”
অনুবাদ: আবদুল্লাহ আল মামুন
পাদুয়ায়, গ্রীষ্মের এক সন্ধ্যায় তারা তাকে ছাদে বয়ে নিয়ে এল। ছাদ থেকে সারা শহরে চোখ বোলানো যেত। আর আকাশে দেখা যেত কাটাশী পাখির আনাগোনা। সন্ধ্যা নেমে এলে সার্চলাইট জ্বলে উঠলো। বাকিরা সবাই নিচে নেমে গেল। সাথে পানীয় বোতল নিয়েই নামল। ছাদ থেকেই সে আর ল্যুজ ব্যালকনিতে তাদের হুল্লোড় শুনতে পেল। ল্যুজ বিছানায় এসে বসল। সেই গ্রীষ্মের রাতেও তাকে শান্ত আর সতেজ দেখাচ্ছিল।
এরপর ল্যুজ নাইট ডিউটিতে ছিল টানা তিন মাস ।
ওরা তাতে বেশ খুশি ছিল । তার অস্ত্রোপচারের আগে ল্যুজ সব ঠিকঠাক করে দিয়েছিল। অস্ত্রোপচারের সময় ওরা তাদের কোনও বন্ধু বা কাউকে পেছনে সুঁই ফোঁটানো ইত্যাদি নিয়ে হাসাহাসি করছিল। অ্যানেস্থেশিয়া দেওয়ার সময় সে কিছুটা সচেতনভাবে আড়ষ্ট হয়ে রইল যাতে ওষুধের ঘোরে বেশি না আবার বকবক করা শুরু করে। যখন সে ক্রাচে ভর দিয়ে দাঁড়াতে পারল, তখন নিজেই নিজের শরীরের তাপমাত্রা মেপে নেয়া শুরু করল। কারণটা ছিল যাতে ল্যুজকে কষ্ট করে তার জন্য বিছানা ছেড়ে উঠতে না হয়। ওইখানটায় হাতে গোনা যে-কয়জন রোগী ছিল তারা ব্যাপারটা জানত। ল্যুজকে তারা পছন্দ করত। দীর্ঘ বারান্দা দিয়ে হেঁটে ফেরার সময় ল্যুজের চিন্তায় বিভোর থাকত সে।
ফ্রন্টে ফেরার আগে দ্যুওমোতে গেল তারা প্রার্থনা করতে। মৃদু আলোয়, নিস্তব্ধতার মাঝে অনেকেই প্রার্থনায় ডুবে ছিল। বিয়েটা সেরে ফেলারই ইচ্ছে ছিল, কিন্ত বিয়েটা আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দেওয়ার জন্যে চার্চের যে সময়টুকু দরকার, তা দেওয়ার মতো সময় তাদের হাতে ছিল না। তার ওপরে নাই তাদের জন্মসনদ। যদিও তাদের ভাবখানা ছিল এমন যে, তারা যেন বিবাহিত; তারপরেও তাদের মন চাইত আনুষ্ঠানিকভাবে সবাই এটা জানুক।
অসংখ্য চিঠি লিখেছিল ল্যুজ তাকে; যদিও যুদ্ধ বিরতির আগ পর্যন্ত একটা চিঠিও তার হাতে পৌছায়নি। পরে ফ্রন্টে থাকা অবস্থায় পনেরোটি চিঠি একসাথে পড়ল। একে একে তারিখ অনুযায়ী সব চিঠি সাজিয়ে নিলো সে; আর এক নিশ্বাসে সবগুলো পড়ে নিলো। সবগুলোতে হাসপাতালের আলোচনা, তাকে কত ভালোবাসে তার বর্ণনা, তাকে ছাড়া পানসে জীবনের কথা, আর নিঃসঙ্গ রাতের কথা। যুদ্ধ-বিরতি শেষে, দুজনে মিলে ঠিক করলো, এবার বাড়ি ফিরে সে অন্য কোনও কাজের খোঁজ করবে। এরপর বিয়ে। আরেকটা চাকরি পাওয়া মাত্রই ল্যুজ তার কাছে চলে আসবে। অবশ্য মাঝে মাঝে মন চাইলে তারা নিউইয়র্কে দেখা করতে পারে। ইতিমধ্যে সে মদ্যপান ছেড়ে দিল আর আমেরিকায় বন্ধুবান্ধব আর অন্যান্যদের সাথে দেখা-সাক্ষাৎও ছেড়ে দিল। লক্ষ্য তার পরিষ্কার–চাকরি আর বিয়ে। তার সাথে তখনই বাসায় ওঠাতে কী আপত্তি তা নিয়েই পাদুয়া থেকে মিলান যাওয়ার পুরো পথটা ল্যুজের সাথে সে ঝগড়া করে কাটালো। মিলানে, বিদায় বেলার চুমুতেও যেন এই ঝগড়া শেষ হয় না। এমন বিদায় তার বড়ই পীড়াদায়ক ঠেকে।
নৌকায় সে জেনোয়া থেকে আমেরিকা ফিরে গেল। ল্যুজ ফিরে গেলো পরডননে, এক হাসপাতাল চালু করার আশায়। শহর জুড়ে ছিল বৃষ্টিমূখর নিঃসঙ্গতা। এরই মাঝে শহরে এলো আরডিটি সৈনিক দল। সেই শীতে, ওই কাদা আর বৃষ্টির শহরে সৈন্যদলের প্রধানের সাথে ল্যুজের প্রণয় হল। সে আগে ইতালিয়ান বলতে-লিখতে পারতো না। অবশেষে সে আমেরিকায় একটা চিঠি লিখলো। তাতে লেখা ছিল–তাদের দু’জনার প্রেমটা ছিল আসলে কাঁচা বয়সের প্রেমের মতো। দুঃখ প্রকাশ করে বলল, সে হয়তো ব্যাপারটা কখনোই বুঝবে না। কিন্তু কোনও একদিন হয়তো সে তাকে ক্ষমা করে দিবে, আর বরং তার কাছে কৃতজ্ঞ থাকবে। চিঠিতে সবচাইতে অপ্রত্যাশিত খবর ছিল–আসছে বসন্তে সে বিয়ে করতে যাচ্ছে। ল্যুজ আরো লিখেছে, তার ভালবাসায় কোন খাদ ছিল না; কিন্তু পরে সে বুঝেছে এ-ভালোবাসা কৈশোরের ভালোবাসার ন্যায়। ল্যুজের মতে, এই ভালো হলো। তার ভালো চাকরির প্রত্যাশা আর তার প্রতি বিশ্বাসের কথা বলে সে চিঠি শেষ করেছিল।
সৈনিক দলের প্রধান অবশ্য তাকে ওই বসন্তে বা এর পরে আর বিয়ে করেনি। ল্যুজও কখনো শিকাগোতে তার প্রাক্তনকে লেখা শেষ চিঠির জবাব পায়নি। অল্প কিছুদিন পরে, বারোয়ারি দোকানে কাজ করা এক সেলস-গার্লের সাথে টেক্সি-ক্যাবে চড়ে লিংকন পার্কের ভেতর দিয়ে যাওয়ার সময় তার গনোরিয়া সংক্রমণ হয়।
অনুবাদকের বয়ানে আর্নেস্ট হেমিংওয়ের এই গল্প নিয়ে কিছু কথা যুক্ত করা হল পরবর্তী অংশে
‘ছোট্ট এক গল্পে’র পেছনের গল্প
ফাঁকতালে ডিসকোর্সের সাথে গল্পের ফারাকটা বুঝে নিলে কাজ হয়। আমরা যাকে বাংলায় গল্প, আর ইংরেজিতে story বলি ফরাসিরা তাকে বলে ইস্তোয়া (histoire)। বোঝা শ্রমসাধ্য নয় histoire অনেকটা history বা ইতিহাসের ভাবের ওপর জোর দেয়। ব্যাপারটা আসলে তাই। মনে হয় এই কারণেই যে, গল্পের বর্ণনায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অতীত কাল ব্যবহার করা হয়। আরও একটা ব্যাপার না বললেই নয়, তা হল–গল্পে যত ঘটনা বা রটনা সকল কিছুর একপাক্ষিক আলাপ চলে। এ-সকল কারণে পুরো ব্যাপারটা লেখনীতেই যেন বেশি আঁটে।
অন্যদিকে ডিসকোর্স? ডিসকোর্স আলাপধর্মী। যেহেতু আলাপধর্মী, তাই বর্তমান কালের ছাঁচে ঢেলে একে পরিবেশন করা হয়। সাথে কল্পনা করা হয় অদৃশ্য শ্রোতার উপস্থিতি।
গল্প চলে ‘সে’, ‘তারা’–এই জাতের তৃতীয় পুরুষের ঘাড়ের ওপর ভর দিয়ে, আর ডিসকোর্স চলে ’আমি’ ‘তুমি’র ভাব বজায় রেখে। তবে এই নয় যে, ডিসকোর্স আর গল্পের মাঝে বেহেশত-দোজখ পার্থক্য। গল্পের ভাঁজে-ভাঁজে ডিসকোর্সের শ্বাস-প্রশ্বাসের উপস্থিতি বিচিত্র কিছু নয়। ডি এইচ লরেন্সের গল্পে প্রবেশ করলেই যেন আপনি লেখকের কোনও এক ছায়া চরিত্রের সাথে বাদানুবাদে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। কিন্তু হেমিংওয়ের ব্যাপারটা ভিন্ন। কেমন জানি, পাঠককে দূরে রেখে, গল্পের ছলে লেখক কাহিনী টেনে নিয়ে যান, ডিসকোর্সের ছলে নয়। ব্যাপারটা বোঝার জন্যে প্রফেসর আজমের হুমায়ুন আহমেদ সম্পর্কে এক বক্তব্যের কথা পাতে তোলা যায়। উনি বলছেন, হুমায়ুন গল্প লিখেন না; গল্প বলেন।
ধরে নেয়া যায়, হুমায়ুনের গল্প লেখার ঢং-এ ডিসকোর্সের বাতাস পাওয়া যায়, হেমিংওয়ে চলে যার বিপরীতে।
হার্মিনিউটিক পদ্ধতিতে যাঁরা সমালোচনা করেন, তাঁদের চেষ্টা থাকে লেখার পেছনে লেখকের উদ্দেশ্য খুঁজে বের করা। নিউ ক্রিটিক বা নব্য সমালোচক নামে যাঁরা পরিচিত, তাদের উদ্দেশ্য রচনার অর্থের অস্পষ্টতার পিছে ছোঁক-ছোঁক করা। আর সেমিওটিক পদ্ধতিতে যে সমালোচনার আয়োজন তাতে সবকিছু ছাঁচে ফেলার পাঁয়তারা আছে। সেমিওটিকস পদ্ধতিতে অর্থ তৈরির কারখানায় লেখক বা পাঠক কেউই মাস্তানি ফলাতে পারে না। রচনা বা টেক্সট শুধু শব্দ-সমষ্টি নয়। রোঁলা বার্থ (উনার s/z বইয়ে) বলেছেন, এ-শব্দমালা সংকেতের আন্তর্জাল। সাধারণ পরিচিত স্থান বা অন্যান্য কিছুর নাম (যেমন নেপোলিয়ন, ওয়াটার লু) আমাদের মস্তিষ্কে এমনি প্রবেশ করে না। এই নামসমূহ তাদের সাথে জড়িত সংস্কৃতি মারফত আমাদের মনে জায়গা করে নেয়, যাকে বলা হয় ডাইজেসিস পদ্ধতি। এছাড়া এমন হতে পারে যে, একটি রচনায় ঘটনার বর্ণনা ধারাবাহিকভাবে সময়ানুক্রমিকভাবে সাজানো নেই। মানে হয়তো, গল্প শুরু হয়েছে ঘটনাপ্রবাহের মাঝখান হতে; এর পরেও ডাইজেসিস পদ্ধতিতে আমাদের মন গল্পটিকে সময় অনুযায়ী প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে সাজিয়ে নেবে। রচনায় এক মিনিটকে এক পৃষ্ঠা বিস্তৃত করা যেতে পারে, এক বছরকে এক লাইনে ঠেসে ঢুকানো যেতে পারে, কিন্তু ডাইজেসিসে সময়ে মিনিট আর বছরের হিসাব মিনিট আর বছরই।
সংক্ষেপে বললে, রচনায় যেমন ইচ্ছা তেমনভাবে লেখা বা বর্ণনা করা যায়, কিন্তু ডাইজেসিসের নিজস্ব চলন এবং পদ্ধতি আছে। এখানে পার্থক্যটা মনে হয় খুব পরিষ্কার, যেখানে লেখক কিংবা তার লেখা রহস্য নিয়ে খেলতে পছন্দ করে, অন্যদিকে পাঠক ডাইজেসিস পাঠের সাহায্যে রচনার খুঁটিনাটি সাজিয়ে বুঝে নিতে চেষ্টা করে। ঠিক এই ফারাকের জায়গায় উদ্ভব হয় টানটান উত্তেজনা: একদিকে রচনার কুহেলিকা, অন্যদিকে ডাইজেসিস পাঠের সরলতা। আধুনিক লেখকেরা এই দুই-এর বিবাদের জায়গাতে নিজেদের জারিজুরি দেখানোর চেষ্টা চালায়। সেমিওটিসানরা সাধারণত পাঠকের ডাইজেটিক নাড়ি ধরে আগানোর চেষ্টা চালায়।
এখন কথা হল, হেমিংওয়ের “ছোট্ট এক গল্প” ডিসকোর্স নাকি গল্প?
নামেই প্রমাণ হয় গল্প; ভাবেও—কেননা পুরো ঘটনার বিবৃতি তৃতীয় পুরুষে মানে ‘সে’ দিয়ে। তবে হ্যাঁ, ঘটনার গভীরে আছে ডিসকোর্সের আলামত পারিপার্শ্বিকতার পরিপ্রেক্ষিতে পুষ্ট ডিসকোর্সের আদল বোঝার জন্যে প্রধান পুরুষ চরিত্রের জায়গায় ‘আমি’ বসিয়ে দেখা যেতে পারে। প্রশ্ন আসতে পারে ল্যুজ নামের নারী চরিত্রের জায়গায় ‘আমি’ বসালে ক্ষতি কী ? ক্ষতি খুব একটা নেই, তবে গোল বাঁধে। প্রথম অনুচ্ছেদের শেষ বাক্যটি লক্ষ করা যাক; নারীর মুখে এ-বাক্য বেমানান: “সেই গ্রীস্মের রাতে আমাকে শান্ত আর সতেজ দেখাচ্ছিল।“ ‘তার’ জায়গায় ‘আমাকে’ বসানোর কারণে গোলমেলে ঠেকে বাক্যটা। এই একটা বাক্যই প্রমাণ করে ছাড়ে পুরো গল্পটা পুরুষের চোখে দেখার আমেজ মিশিয়ে পুরুষের অভিজ্ঞতার বয়ান। আমরা যখন চতুর্থ অনুচ্ছেদ পাঠ করি, তখন দেখি–পুরুষ চরিত্রটি মদ্যপান ও বন্ধুবান্ধব ছেড়ে দিয়ে চাকরির সন্ধানে ব্যস্ত। পক্ষান্তরে নারী পক্ষ হতে তেমন কিছু করার বর্ণনা বা ইঙ্গিত নেই, যার ফলে নার্স চরিত্রটির ওপর পাঠকের দোষ চাপানোর কাজ সহজ হয়।
পুরো আলাপটি এক বৃত্তে বেঁধে ফেলতে সমস্যা হয় না, যখন আমরা হেমিংওয়ের জীবন বৃত্তান্ত হতে জানতে পারি, উনিশ বছর বয়সে, রেডক্রসে কাজ করার সময় তিনি এগন্যাস হান্নাহ ভন কুরস্কি নামের এক নার্সের প্রেমে পড়েছিলেন। প্রেম সফলও হয়, কিন্তু পরে তাদের আলাদা হয়ে যেতে হয় এবং পরবর্তীতে সেই নার্স হেমিংওয়েকে খারিজ করে আরেক জনকে বিয়ে করার চেষ্টা করে (যদিও তা সফল হয়নি)। হেমিংওয়ের বোন মার্সেলিন জানান, হেমিংওয়ে তার প্রেমিকার প্রত্যাখানে ভালোই মুষড়ে পড়েছিলেন। মোদ্দা কথা হল, গল্পের আড়ালে ডিসকোর্সের চরিত্র ধরতে পারলে, সাথে ডাইজেসিস অনুসন্ধানের ইচ্ছায় অন্যান্য আনুষঙ্গিক গঠন জুড়ে দিলে টেক্সট বা বয়ানের কাঠামোবাদী চরিত্র বুঝে নিতে সমস্যা হয় না। দ্বিতীয় আলাপে সেই চেষ্টাই ছিল।
ডিসক্লেইমার: এক ধূমপায়ীকে বলতে শুনেছিলাম, “ভাত খাই আসলে সিগারেটটা আরাম করে খাওয়ার জন্যে।” হেমিংওয়ের গল্পটাও অনুবাদ করেছি মুলত গল্পটির উপর রবার্ট শোলের আলোচনাটা হাজির করার জন্যে। গল্পের শেষে নিজের বোঝাপড়া অনুযায়ী আমি তার আলাপটার সার সংক্ষেপ তুলে ধরলাম।
পাঠসূত্র:
Scoles, Robert. New Critical Approaches to the Short Stories of Ernest Hemingway. “Decoding Papa: “A Very Short Story” As Work and Text.” Ed. Jackson J Benson. London, 1990.