বৃহস্পতিবার, ১৪ অক্টোবর ২০২১, ০৭:৫৭ অপরাহ্ন
অন্ধকার শুরু হলো যেভাবে
শের মাসুম :
সিনেমা হলের সিটের নিচে প্রায় অন্ধকারে একটা কাগজের টুকরা চকচক করে ওঠে। টাকা ভেবে চমকে উঠি। চট করে চারপাশটা কাকের মতো করে ঝটিকা বুলিয়ে নিই দ্রুত। কেউ দেখছে না তো। ময়লা স্যান্ডেলসহ টাকাটার উপর পা রাখি। মাথাটা আধো নামিয়ে দেখে নিই টাকাটা পুরোটা ঢাকা পড়ল কিনা। আহ..
পা চুলকাবার সাবধানী ভঙ্গিতে নিচু হই। অভ্যস্ত স্টাইলে ডান হাতটা পায়ের নিচ থেকে টাকাটা চট করে হাতের মুঠোতে নিয়ে নিলাম। পুরো টাকার নোটটা এমনভাবে মুঠো দিয়ে ঢেকে ফেলি যে কেউ বুঝতেও পারবে না। এদিক ওদিক হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে প্যান্টের পকেটে চালান করে দেই। সুন্দর একটা সন্ধ্যা শুরু হলো। আমার পাশ দিয়ে কে যেন দুইজন চলে গেল, ইলিশ মাছের ঘ্রাণ এলো উড়ে, নাকে। লোকদুটো ইলিশ ভাজা নাকি সরষে ইলিশ খেয়ে এসেছে ভাবছি। বাইরে এসে দাঁড়াতে অভিনেত্রী শ্রীলেখা মিত্রের মতো একটা মেয়ে আবার পাশ কেটে সেমি দৌড়ে গেল। এবারে কোন পারফিউমের ঝাপটা।
এই সময়টা ভুসভুস সন্ধ্যা। সিনেমা হলের সামনে একটা একঘেয়ে প্রতিদিনের ভিড়। পকেটের ভেতর হাতটা আছে। ছোট্ট একটা গরম ভাপ হাতের তালু বেয়ে ছড়িয়ে পড়ে। মুখে একটা নির্লিপ্তভাব বজায় রেখে টের পেতে শুরু করি যে ভালো লাগছে। কিশোর বয়সী একটা ছেলে আমার গা ঘেঁষে মাথা মালিশ মাথা মালিশ বলে দাঁড়াল। একটা আলতো সাবলীল ঢঙে আমার প্যান্টের জিপারের উপর চাপ দিল।
অনুভূতিটা মন্দ না। ছেলেটা মুখ অসহায় করে আবার বলল; তেল মালিশ।
জবাব দিলাম না। আমার হাতটা তখনো প্যান্টের পকেটের ভাপে। ভালো লাগছে। আগে কখনো সিনেমা শেষ হবার আগেই হল থেকে বেরিয়ে পড়েছি কিনা মনে নাই। সিনেমা দেখতে দেখতে বুঝতে পারি শেষ দৃশ্যে কি হবে। পয়সা যে উসুল হলো না, আক্ষেপ নাই।
পকেটে হাত ঢুকিয়ে হাঁটার মাঝে একটা ওজনদার ভঙ্গি আছে। আলসে একটা হংসরাজ। আমার পাশ দিয়ে যে মানুষগুলো সটকে পড়ে, কারো কারো মুখের দিকে তাকাই। যে মানুষকেই দেখছি, চেনা চেনা লাগছে। কেউ হাই তুলছে, কেউ বাস ধরবার জন্য দৌড়াচ্ছে, কেউ চুলকাচ্ছে, কেউ হনহন করে মিলিয়ে যাচ্ছে। যে মুখ চেনা লাগছে আমি নিশ্চিত, ১ ঘন্টা পরে তাকে আমি আর চিনব না কোথাও। মিলিয়ে যাবে স্মৃতি থেকে।
আখ মাড়াই করে এক পাশে ইক্ষুরস বিক্রি করছে এক লোক। লোকটার পাশে এক শুকনো মতো কিশোরী। মেয়ে হবে লোকটার। ঘন ঘন ওড়না সামলাচ্ছে। ইক্ষুরস বিক্রি করছে যে লোক তাকে চিনি। আউচপাড়ায় থাকে। লোকটার মেয়ের সাথে লাইন মারার চেষ্টা করেছি আগেও। দুই একদিন ছোটখাট উপহার কিনে দিয়েছি। মেয়েটা সারাক্ষণ হাসে, কথা বলে না। কথা বলতে পারে না। বনমালা রোড ধরে একটা খালি রিক্সা যাচ্ছে। জানতে চাইলাম দত্তপাড়ায় যাবে কিনা। রিক্সাঅলা মাথা নাড়ল। যাবে না। রিক্সাঅলাকে একটা সুখ করে গালি দিলাম। কাউকে গালি দেয়ায় আনন্দ আছে। কি মনে করে আবার ফিরে আসি ইক্ষুরসের কাছে। কিশোরী মেয়েটা আমাকে আজ বেশ টানছে। সন্ধ্যার বাতি ছাপিয়ে লোকটার হারিকেনের আলো মেয়েটার মুখে এসে পড়ে। বড় সাইজের এক গ্লাস রস কিনি। হারিকেনের আলোতে কিছু মাছি এখনো উড়ে বেড়াচ্ছে যেমন মেয়েটার চারপাশে উড়ছি আমি।
গ্লাসে চুমুক চুমুক করতে করতে পকেট থেকে ভাপ হওয়া হাতটা বের করি। এদিক ওদিক তাকিয়ে আস্তে করে মেয়েটার পেছনে হাত চালান করে দেই ওস্তাদি ওঝার মতো, যেন হাতটা সাপের খেলা করে।
খা খা খা বক্ষীলারে খা
খা খা খা কালনাগিনীরে খা
মেয়েটা অস্ফুট কাঁইকু্ঁই করে। লোকটাকে রসের দাম দিলাম, মেয়েটাকেও..
মেয়েটার হাতের মুঠোয় লুকিয়ে একটা ১০ টাকার নোট গুঁজে দিলাম। প্যান্টের জিপারে খামোকা একটা হাত বুলিয়ে ওখান থেকে সরে আসি।
আমার বাসা বড় দেওড়া রোডে। কাল বেশ রাত করে বাড়ি ফিরেছিলাম। বউ ধানের শীষের মতো হেলে ঘুমাচ্ছিল। খামোকা শরীর জাগানোর চেষ্টা করেছিলাম। কোন কথা নাই বার্তা নাই, বউরে বললাম: করব..
ঘুম ঘুম গলায় বউ গুরুত্ব দিল না। কুকুরের মতো একটু ঘেউ ঘেউ করলাম। বউ ওপাশ ফিরে খ্যাঁচ করে বলে তার মাসিক চলছে।
স্বামী মানুষের প্রত্যাখ্যান ভালো লাগে না। গতকাল রাতের সেই ঘটনার কথা মনে পড়ল চেপে রাখা প্রস্রাবের মতো। বনমালা রোড ধরে দত্তপাড়ার দিকে হাঁটছি। দত্তপাড়ায় এক বিধবা মহিলা আছে। কিছু টাকা পয়সা দিলে গায়ে হাতটাত দিতে দেয়।
মায়ের দোয়া নাম নিয়ে একটা বাস পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে। বাসটাকে দেখেই আবার কাল রাত উড়ে এলো। চিৎকার। মোনায়েম গলা ঠেসে ধরেছে..
সুপারভাইজার সিরাজ মামা হিস হিস সাপের ফণার মতো দুলছে। মুখে আশিক জর্দার পান..মধুপুর জঙ্গলের পাশ দিয়ে মায়ের দোয়া বাস সাঁ সাঁ …
মেয়েটা তীব্র হাত পা ছুঁড়ছে…
মোনায়েম খাঁ:
মেয়েছেলেটা বাসের জানালার কাছে বসল। এইটা নতুন কিছু না। বেশিরভাগ আপারাই জানালার কাছে বসতে ভালোবাসে। আমি নিজেও বাসে উঠলে জানালার কাছের সিট খুঁজি। অবশ্য পকেটে টাকা না থাকলে মফিজ হয়ে যাই। এই আরিচা ঘাটের এই দিকে আমার মতো কেউ বাসে উঠলেই হেল্পার জোরে চিৎকার করে বলবে
৩টা মফিজ উঠসে ওস্তাদ।
আমাদের মতো কম পয়সার যাত্রী তো মফিজই। একটা কী রকম বস্তার উপরে আমাকে বসিয়ে দেয়। বাস চলে আমি ঝিমাই। লোকজন আসা যাওয়ার পথে আমাকে গুতা দেয়। আমি কোন রকম পাশ ফিরে তাদের সাইড দেই। ভিড়ের মধ্যে টের পাই আমার পিছনের লোকটা আমার পাছায় হাত দেয়। গন্তব্যে পৌঁছাতে পৌঁছাতে আমার এই মায়ের দোয়া পরিবহনে হেল্পার হিসাবে চাকরি পাক্কা হয়ে যায়।
পলাশী বেগম:
গভীর রাতে বাড়ি ফিরে ও বলল: করব।
বুঝতে পারছিলাম তাই ঘুমের ভাণ করে মটকা মেরে পড়েছিলাম। পাশ ফিরে শুয়ে বললাম মাসিক চলছে। আসলে চলছে না। মিথ্যা বলেছি। মানুষের মন দেখা যায় না বলে অজস্র মিথ্যা সত্য বলে চালিয়ে দেয়া যায়।
সে আমার স্বামী। মাসের কোন তারিখগুলোতে আমার রক্ত বেরোয়, সে জানে না। অনেক কিছু এ জীবনে না জানাই থাকে। আগ্রহ হয় না আর। যেমন তার সাথে সম্পর্কটা। আছে। চলছে। থাকে, থাকার হুকুম আছে কাগজে, তাই। মন তো কোন কাগজে দস্তখত করেনি। শরীরও।
সাথে বাস করলেই সহবাস হয় না। সে আবার কি জিনিস! দু’পা ছড়িয়ে শুয়ে থাকা তার শরীর জাগলে, তারপর একসময় স্খলন। চুম্বনে ঠোঁট সরিয়ে নেয়া, শরীরে স্পর্শ করলে বিরক্তি।
আমি জানি সে অন্য কোন নারীকে চিন্তা করে আমার কাছে আসে, তাকে পায় না বলেই। শুনেছি সে পাড়ায় যায়। কোন এক বিধবাও তাকে সুখ দেয়। কোন কিশোরী তার স্বপ্নে আসে। আসুক। আমার কিছু বিকার হয় না। আজ রাতে সে বাথরুমে গিয়ে স্ব-মৈথুন করবে, তার পকেট গরম হয়ে আছে। ভাপ লাগে। এই লোকটাকে বিয়ে করেছিলাম পরিবারের অমতে, পালিয়ে গিয়ে। খুব ছোট্ট একটা সুন্দর সংসার আমাদের। প্রথম প্রথম পাগলের মতো মিলন। দিন নেই রাত নেই সকাল সন্ধ্যা নেই। গায়ে হাত দিলেই হতো।
কয়েক বছর কাটে। সময় গড়িয়ে যায় মার্বেলের মতোন। পরিবার মেনে নেয় দুজনেরই। শাশুড়ি নাতি নাতনীর মুখ দেখতে চায়। আমরা দুজন রিকশায় চড়ে ফুরফুরে মনে হাওয়াই মিঠাই খাই। সিনেমা হলে ঢুকি। ওর সিনেমা দেখার বাতিক। আমার অতোটা না। তবুও দেখি। ওর সব কিছুই আমার ভালো লাগে। আমাদের কোন সন্তান হয় না। ডাক্তার বলে দিয়েছে, হবে না।
রাত বাড়তে থাকে প্যাঁচার মতো শব্দ করে। বাড়তে থাকে আমাদের দূরত্বও। মাঝখানের কোলবালিশের মতো অদৃশ্য একটা দেয়াল, নীরবতা আর নিস্পৃহতার গাঁথুনি দিয়ে, উঠে যায়। কর্মব্যস্ত দিন শেষে আমরা দুজন আলাদা আলাদা বাসায় ফিরি। কখনো হয়তো সে ফেরে অনেক রাতে। সপ্তাহান্তে ছুটি। অনেক রাতে একা গা ছমছম করে। কোন কারণ নেই তবুও ভয় লাগে। কথা বলার কেউ নেই। ফোন করি কখন ফিরবে?
সে হয়তো তাসের আড্ডায়। বন্ধুদের সাথে। মদ-টদ খায় হয়তো। শুধু বলে, দেরি হবে। তুমি ঘুমাও। ফোন করি, আসো। অপর প্রান্তে খিলখিল হাসির শব্দ শুনতে পাই।
আমার মন মরে যায়। এক লহমায় সমস্ত পৃথিবীর কালো বেড়ালের থাবা দিয়ে নিকষ অন্ধকার ঝপ করে নামিয়ে আনে। আমি দেখি পত্রিকার পাতায় ধর্ষণের খবরগুলো ও খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ে। চোখ চকচক করে ওঠে। জিব দিয়ে ঠোঁট চাটে। জিপারের ওপর হাত বুলায়। এক সময়কার ভালোবাসার মানুষের এ বিকৃতি, ভীষণ আহত করে ভেতরটা। শাওয়ার করে বেরিয়ে আলগোছে চুল ঝেড়ে বারান্দার দড়িতে টাওয়েল ঝুলিয়ে দিই। আমার জীবনটাও একটা সূক্ষ্ণ বন্ধনের দড়িতে ঝুলতে থাকে।
আমাদের কোন ঝগড়া হয় না, মনোমালিন্য হয় না। প্রতিক্রিয়াহীন বিক্রিয়াহীন লবণহীন নিরামিষের মতো গেলা শুধু। আগে সামাজিকতা রক্ষা করতে বিভিন্ন বাসায় দাওয়াতে বা অনুষ্ঠানে যেতাম আমরা। আটপৌরে মানুষজনদের একটিই প্রশ্ন: বাচ্চা হয় না ক্যান? কার সমস্যা?
এসব শুনতে শুনতে কমিয়ে দিয়েছি যাওয়া।
একটা বাগান করেছি ছোট্ট, বারান্দায়। ফুল লতাদের নিয়ে অবসর কাটে। কিচিরমিচির দুটো চড়ুই বাসা বেঁধেছে কার্নিশে। তাদের ঠোঁটে ঠোঁটে ভালোবাসা, ঠোঁটে করে খড় এনে নীড় বোনে। আমার মন ভালো থাকে। ফুলেদের সাথে, পাখিদের সাথে। এক সকালে চ্যাঁ চ্যাঁ করতে থাকে চড়ুইছানা।
সেদিন রাতে আমার শরীরে ও প্রবেশ করে অনেকদিন পর। আমরা আবার ভালোবাসি। কোথাও একটা আস্ত ব্রণ দূরত্বের। ঠিক স্বাভাবিকতা নেই। যা আছে তা অভ্যাস। শরীরটাকে চর্চার মাঝে রাখতে হয়।
সিনেমা দেখতে তেমন ভালো লাগত না আমার। ফুল পাখিদের তত্ত্ব-তালাশ করি। সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত অব্দি সিনেমাতে ডুব দিই। না ভালো লাগার জিনিষ প্রিয় হয়ে ওঠে একসময়। যেমন করে প্রিয় জিনিস অপ্রিয়…
রুপালি ফিতে আমাকে বেঁধে ফেলে। সেলুলয়েড চিত্রকল্প আমার মনে ক্ষণে ক্ষণে দোলা জাগায়। নেশা লাগে। মনে হয় আমার যদি কেউ থাকত, আকাশটার মতো ঐ মাথার উপর…
কাল রাতে ও বাড়ি ফেরেনি। কাক-ভোরে ফোনের শব্দে ঘুম ভাঙে। পুলিশের, থানা থেকে।
‘আপনাকে একটু আসতে হবে পলাশী বেগম। কাল রাতে আখের রস বিক্রি করত যে মেয়েটি রাস্তার মোড়ে বাবার সাথে, ওকে বাসে ধর্ষণের পর মেরে ফেলা হয়েছে। আপনার স্বামী শের মাসুম এখন আমাদের জিম্মায়, গ্রেফতার করা হয়েছে তাকে।
তাকিয়ে দেখি কার্নিশ থেকে চড়ুই ছানাটি ডানা মেলে উড়তে শিখেছে।