বৃহস্পতিবার, ১৪ অক্টোবর ২০২১, ০৭:৪৫ অপরাহ্ন
ইয়োহা ও ফুরা
ঈশ্বর তাঁর ছেলে ইয়োহাকে জিজ্ঞাসা করে, “স্বর্গ-মর্ত্যের সকলে নিজেদের দুঃখ-কষ্টের কথা আমাকে জানায়, আমার কাছে সাহায্য প্রার্থনা করে; কিন্তু তুমি ইয়োহা কখনো কোন কষ্টের, কোন যাতনার কথা আমাকে জানালে না; কখনো আমার কাছে কোন সাহায্য কামনা করলে না কেন?”
নিজস্ব স্বভাব অনুযায়ী ইয়োহা চুপ থাকে। ভাবে, পিতা ঈশ্বরকে কী উত্তর দেয়া যায়?
ইয়োহাকে নিশ্চুপ দেখে ঈশ্বর তাঁর ক্ষমতা ব্যবহার করে ইয়োহার ভাবনা-জগতে প্রবেশের চেষ্টা করে।
ব্যর্থ হয়।
বিস্ময় পেয়ে বসে ঈশ্বরকে। ঈশ্বর পুনরায় চেষ্টা চালায়।
আবারো ব্যর্থ হয়।
এবার ঈশ্বরের ক্ষোভ জন্মাতে শুরু করে। ঈশ্বরের সেই ক্ষোভ টের পেয়ে ইয়োহা ভীত হয়ে পড়ে। তখন সে দমক লাগা কণ্ঠে ঈশ্বরকে বলে, “পিতা আমার তো কোন কষ্ট নাই, দুঃখ কখনো আমাকে স্পর্শ করে নাই; তাই কখনো তোমার কাছে সাহায্য প্রার্থনার প্রয়োজন পড়ে নাই আমার।”
ইয়োহার ভাবনা-জগতে প্রবেশে ব্যর্থ ঈশ্বর ইয়োহার কথা বিশ্বাস করতে পারে না। ঈশ্বর ভাবে- ইয়োহা দম্ভের দরুন তাঁর কাছে সাহায্য চাইতে অনিচ্ছুক। ঈশ্বর আরো ভাবে- তাঁর সাথে ইয়োহা ক্ষমতা প্রদর্শনের খেলায় লিপ্ত হতে চাইছে। ঈশ্বর সিদ্ধান্ত নেয় ইয়োহাকে সে শাস্তি দেবে। তীব্র যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।
ঈশ্বর ইয়োহাকে কিছুই বলে না। ইয়োহা ঈশ্বরের উপস্থিতি অনুভব করতে ব্যর্থ হয়। আর ঠিক তখনই ইয়োহার মাথার উপর দিয়ে উড়ে চলে যায় একটা দাঁড়কাক। ইয়োহা শরীরজুড়ে কর্কশ অনুভূতি টের পায়। কর্কশ অনুভূতিকে সঙ্গী করে সে হেঁটে গিয়ে স্বর্গের একমাত্র অশ্বত্থ গাছের নিচে গিয়ে হাঁটু মুড়ে বসে পড়ে।
তখন সে-পথে চন্দ্রদেবতা খোনসুর দেখা মেলে। অশ্বত্থ গাছের নিচে ইয়োহাকে বসে থাকতে দেখে খোনসু গিয়ে তার পাশে বসে পড়ে।
চন্দ্র দেবতা খোনসুর দিকে ইয়োহা মলিন দৃষ্টিতে তাকালে খোনসু বলে, “জানো ইয়োহা- সূর্যদেবতা রা’য়ের সমান আলো ছিল আমার। মহাপ্লাবনের আগের কথা। একবার আকাশ দেবী নাত আমার সাথে সেনেট খেলতে চাইলো। আর সে শর্ত দিল- আমি যতবার খেলায় হারবো, ততবার আমার অনেকটুকু করে আলো তাকে দিয়ে দিতে হবে। ইয়োহা তোমার জন্ম অনেক পরে, তাই হয়তো তুমি জানবে না, যে ঈশ্বর ব্যতীত আর কারো পক্ষে সেনেটে আমাকে হারানো সম্ভব ছিলো না।
পাঁচবার খেলা হলো। আমি পাঁচবারই নাতকে জিতিয়ে দিলাম। বাতাস দেবতা সু আমাকে বলেছিল- নাত যদি একবারও হেরে যায়, তাহলে সে ইশ্বরের কাছে মৃত্যু কামনা করবে। আর তুমি তো জানোই- এই স্বর্গে একমাত্র নাতেরই আছে স্বেচ্ছা মৃত্যুর অধিকার। আমি নাতকে এতোটাই ভালবেসেছিলাম যে, তার মৃত্যু আমি কোনভাবেই মেনে নিতে পারতাম না।
নাত সেনেটে পাঁচবার জিতে আমার যতটুকু আলো কেড়ে নিয়েছিলো, তা দিয়ে সে আরো পাঁচটা দিন সৃষ্টি করলো। ঈশ্বর তাঁর কথা রাখলো, নাত তার প্রেমিক গেবকে বিয়ে করতে চাইলে ঈশ্বর তাকে শর্ত দিয়েছিলো পাঁচটি দিন সৃষ্টি করার।”
খোনসু খানিক থেমে আবার বলে, “ইয়োহা দেখো- আমি একদিকে হারালাম রা’য়ের সমান আলো, অন্যদিকে যার জন্য আমি ম্রিয়মাণ, সে কখনো জানলোও না তাকে আমি কী ভীষণ ভালবাসি!”
খোনসু তার কথা শেষ করে চুপ করে যায়, ইয়োহা তাকে কিছুই বলে না, কিন্তু খোনসুর মনে হয়- ইয়োহাকে বলাতে তার দুঃখ অনেকটা কমে গেছে।
একদিন জ্যেষ্ঠা এসে ইয়োহাকে বলে, “ইয়োহা তুমি হয়তো জানো না, পোড়া মুখের যন্ত্রণা আমাকে কেন বয়ে বেড়াতে হচ্ছে… আমি চেয়েছিলাম মানুষ শুধু খাবার আর প্রজননময় ভাবনায় সারাক্ষণ লিপ্ত না থাকুক, তারা একটু চিন্তা করতে শিখুক; তাই তাদের শরীরে ক্লান্তি দিয়েছিলাম, আলসেমি দিয়েছিলাম।
ক্লান্তিতে, আলসেমির মুহূর্তে মানুষ যখন চিন্তা করতে শুরু করলো, ধীরে ধীরে তারা ইশ্বরের ক্ষমতার কাছাকাছি পৌঁছাতে থাকলো; এতে করে ঈশ্বরের সকল রাগ এসে পড়লো আমার ওপর।
ঈশ্বরের নির্দেশে আগুন দেবতা ওদকান এক রাতে আমার মুখ আগুনে পুড়িয়ে দিলো। ইয়োহা, নিদারুণ যন্ত্রণায় বিদ্ধ হই, যখন দেখি যেই মানুষের জন্য আমি এতো কিছু করলাম, সেই মানুষ আমাকে কুৎসিত দেবী বলে ভয় পায়, আমার মূর্তিকে অশুভ হিসাবে বিবেচনা করে।”
আরেকদিন, শাইয়া এসে ইয়োহাকে বলে, “তোমাকে আমার ভীষণ কষ্টের কথা বলি আজ। একবার আমাকে আর সোমনাস পুত্র মরফিয়াসকে ঈশ্বর তাঁর উদ্দেশ্যে উৎসর্গ দিতে বললো। আমরা দু’জনেই তখন স্বর্গে ফসলের চাষাবাদ করি। উৎসর্গের দিন আমি ঈশ্বরকে আমার সবটুকু ফসল উৎসর্গ করলাম, আর মরফিয়াস তার ফসলের অর্ধেক। ঈশ্বর আমার উৎসর্গ গ্রহণ করায় মরফিয়াসকে তীব্র ঈর্ষা পেয়ে বসলো।
আমার ওপর মরফিয়াস প্রতিশোধ নেয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। তাই সে প্রতিরাতে আমার ঘুমে স্বপ্ন হয়ে হামলা করতে শুরু করলো। ঘুমাতে গেলেই স্বপ্ন দেখি–আমি একটা গাছের মধ্যে আটকা পড়ে আছি, আর কে যেন করাত দিয়ে গাছটাকে চিরে দুই ভাগ করে ফেলছে, গাছের সাথে আমার দেহও দুইভাগ হয়ে যাচ্ছে।”
এরপর আলা তার মৃতদের আত্মা পেটে নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর কষ্টের কথা, হেবো তার আধা অন্ধত্বের বেদনার কথা জানায় ইয়োহাকে।
একে একে স্বর্গের দেব-দেবীরা সবাই ইয়োহাকে তাদের দুঃখ শোনাতে থাকে। সবারই মনে হয়– ইয়োহাকে নিজেদের দুঃখের কথা বললে সেই দুঃখ অনেকটুকু ওজন হারায়।
ঐদিকে ঈশ্বর অপেক্ষা করতে থাকে সেদিনের জন্য, যেদিন ইয়োহা স্বর্গের দেব-দেবীদের ব্যক্ত এতো এতো নিদারুণ কষ্ট আর সহ্য করতে পারবে না, চূর্ণ হবে ইয়োহার দম্ভ, অতি তুচ্ছ ক্ষমতার অধিকারী ইয়োহা দ্বারস্থ হবে তাঁর কাছে।
বহুদিন কেটে গেলেও ঈশ্বরের অপেক্ষা শেষ হয় না; রিক্ততাকে সঙ্গী করে ইয়োহা হাজির হয় না ঈশ্বরের সম্মুখে। ক্ষিপ্ত ঈশ্বর তখন ইয়োহাকে নিঃসীম দুঃখের মুখোমুখি করার সিদ্ধান্ত নেয়।
ঈশ্বর ইয়োহাকে একদিন বলে, “ইয়োহা তুমি তো জানোই, স্বর্গের সবাইকে অন্তত একবার পৃথিবীতে গিয়ে মানুষ হয়ে বসবাস করতে হয়; আমি চাই তুমিও খুব শীঘ্রই পৃথিবীতে গিয়ে মানুষ হিসাবে জীবন-যাপন করতে শুরু কর।”
ইয়োহা ঈশ্বরকে জানায়– ঈশ্বর তাকে যখনই পৃথিবীতে যাওয়ার নির্দেশ দিবে, তখনই সে পৃথিবীতে গিয়ে মানুষ হিসাবে জীবন অতিবাহিত করতে শুরু করবে।
ঈশ্বরকে ইয়োহা শুধুমাত্র জিজ্ঞাসা করে, “পিতা আমি কি আর কখনো স্বর্গে ফিরে আসতে পারবো না?”
এমন প্রশ্নে ঈশ্বর ইয়োহাকে তাঁর মুখাপেক্ষী হিসাবে দেখতে পায়।
ঈষৎ আনন্দিত ঈশ্বর ইয়োহাকে উত্তরে বলে, “ফিরে আসতে পারবেনা কেন? তুমি যখন চাইবে তখনই স্বর্গে ফিরে আসতে পারবে।”
ইয়োহার হাতে একটা আংটি দিয়ে ঈশ্বর বলে, “এই আংটিকে তোমার চোখের জল স্পর্শ করলেই দেখতে পাবে যে স্বর্গে ফিরে এসেছো তুমি।”
ঈশ্বর ইয়োহাকে তার কোন চাওয়া কিংবা পৃথিবীবাসের জন্য বিশেষ কোন ক্ষমতা অর্জনের ইচ্ছা আছে কি-না জিজ্ঞাসা করলে ইয়োহা ঈশ্বরকে জানায়–তার কোন চাওয়া বা বিশেষ কোন ক্ষমতা লাভের ইচ্ছা নাই।
কয়েকদিন পর স্বর্গবাসীদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ইয়োহা ঈশ্বরের কাছে পৃথিবী গমনের অনুমতি প্রার্থনা করে। ঈশ্বর ইয়োহাকে অনুমতি দেয় এবং তাকে বলে, “ইয়োহা তুমি না চাইলেও আমি তোমাকে বিশেষ একটা ক্ষমতা দিয়ে পৃথিবীতে পাঠাচ্ছি, তুমি চাইলে পৃথিবীর যেকোন একজন মৃত মানুষকে বাঁচিয়ে তুলতে পারবে; তাকে দিতে পারবে স্বর্গীয় অমরত্ব। মনে রেখো ইয়োহা, যদি কখনো কোন মৃত মানুষকে পুনরায় জীবন দিতে চাও, তবে তোমাকে যে আংটিটা দিয়েছি সেটা তার আঙ্গুলে পরিয়ে দেবে। দেখবে, সেই মৃত মানুষ দ্বিতীয় জীবন ফিরে পেয়েছে, সুখী চোখে সে পৃথিবীর দিকে, তোমার দিকে তাকাতে সক্ষম হচ্ছে।”
তখন মধ্য রাত। ইয়োহা পৃথিবীর পথে হেঁটে যায়। পায়ে ক্লান্তি জড়ো হলে ইয়োহা একটা ল্যাম্পপোস্টের নিচে বসে পড়ে। সে-পথে তখন একজন যুবক হেঁটে যায়। যুবক ল্যাম্পপোস্টের নিচে বসে থাকা ইয়োহার সম্মুখে গিয়ে থমকে দাঁড়ায়। যুবক দুর্বল চোখে ইয়োহার দিকে নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। ইয়োহা বুঝতে পারে না যুবক তার দিকে অমনভাবে কেন তাকিয়ে আছে। যুবক গিয়ে ইয়োহার পাশে বসে পড়ে।
যুবক ইয়োহাকে তার জমাটবদ্ধ এক কষ্টের কথা শোনার সময় হবে কি-না জিজ্ঞাসা করে। সম্মতির অপেক্ষা না করেই সে ইয়োহাকে শোনায় যে, সে তার সন্তানের কাছ থেকে বিগত কয়েকদিন পালিয়ে বেড়াচ্ছে। তার সন্তান একজোড়া লাল জুতার বায়না জানিয়েছিল কিছুদিন আগে। বায়না পূরণের আর্থিক সামর্থ্য নাই তার।
সন্তানের, স্ত্রীর, নিজের ক্ষুধা–ধংসাত্মক ক্ষুধা নিবারণের প্রাত্যহিক দায়িত্ব পালনে যেখানে সে ক্রমাগত ব্যর্থ হচ্ছে, সেখানে বাচ্চার জুতা, সে যত ক্ষুদ্রাকৃতির, যত নগণ্য মূল্যেরই হোক না কেন, তা এখন তার কাছে অতি শৌখিন বস্তুর মতন।
পরিবারের সবার ক্ষুধা মিটিয়ে, স্যাঁতস্যাঁতে আস্তরখসা যে ঘরটায় তারা থাকে, সেটার ভাড়া চুকিয়ে শীঘ্র কোনদিন তার বাচ্চার বায়না ধরা জুতা কেনার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সে জোগাড় করতে পারবে কি-না, তাও সে জানে না।
তাই সে মধ্যরাতে ঘরে ফেরে, যাতে এই সময়ের ভিতর তার সন্তান ঘুমিয়ে পড়ে, আবার অনেক ভোরে সন্তানের ঘুম ভাঙার আগে সে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে, যাতে সন্তানের মুখোমুখি না হতে হয় তাকে।
যুবক তার জমাটবদ্ধ কষ্টের কথা ইয়োহাকে বলে নিশ্চুপ হয়ে যায়। যুবকের মনে হতে থাকে–তার দুঃখ বুঝি তাকে ছেড়ে দূরে কোথাও চলে যাচ্ছে।
সেই রাত থেকে পৃথিবীতে কোন ব্যক্তি কয়েকদিনের পরিচয়ে, কেউ হয়তো মুহূর্তের আলাপে কিংবা একদম অপরিচিত কেউ ইয়োহাকে তাদের বেদনার কথা জানাতে থাকে। পৃথিবীর মানুষদের মনে হতে থাকে– ইয়োহাকে বললে তাদের কষ্টের বোঝা হালকা হয়। অনেকে ইয়োহাকে পুনরাবৃত্তিক উপায়ে নিজেদের দুঃখের কথা শোনাতে থাকে, তারা ভাবে–তাতে করে তাদের দুঃখ বুঝি একসময় নিঃশেষ হয়ে যাবে।
এক মা তার অদেখা বাচ্চার কথা শোনায় ইয়োহাকে। মা বলে, “যুদ্ধ শেষ হলো, সবকিছু শান্ত হলো, সিজার করে আমার পেট থেকে ওরা আমার বাচ্চাকে বের করে আনলো, আমি তার কান্না শুনলাম, কিন্তু আমাকে ওরা আমার সন্তানকে দেখতে দিলো না; বললো–দেখলে যদি আমার মায়ার জন্ম হয়, আমি যদি তাদের কাছে আমার সন্তান তুলে না দেই। ওরা আরো বললো–আমার সন্তানকে, আরো অনেক মায়ের অনেক সন্তানকে নিয়ে যাওয়ার জন্য উড়োজাহাজ অপেক্ষা করছে, উড়োজাহাজ আমাদের সন্তানদের অনেক দূরে নিয়ে যাবে, যেখানে তারা বড় হবে, মানুষ হবে, তারা কখনো জানবে না আমরা তাদের মা ছিলাম; এতে করে তাদের জীবনটা দুর্দশার হাত থেকে রক্ষা পাবে, সুন্দর হবে।”
এক সন্তানের নিজ পিতা দ্বারা অর্থ চুরির মিথ্যা অভিযোগ মাথায় নিয়ে ঘর থেকে বিতাড়িত হওয়ার, অতঃপর তার এখন রাস্তায় রাস্তায় দিন-রাত কাটানোর কথা জানতে পারে ইয়োহা।
যুদ্ধে দুই পা হারানো এক কিশোর ইয়োহার কাছে এক ধূসর দুপুরে যুদ্ধপূর্ব বিকেলগুলোতে বন্ধুদের সাথে তার মাঠ দাপিয়ে ফুটবল খেলার স্মৃতি উল্লেখ করে। ফুটবল সে নাকি দুর্দান্ত খেলতো, বন্ধুরা বলতো তার পায়ে জাদু আছে।
ইয়োহা পরবর্তীতে সেই কিশোরকে দেখতে পায় রাস্তায় বসে চক দিয়ে সে নিজের না-থাকা দুই পা আঁকছে। আঁকা শেষ হলে কিশোর তার কোলে থাকা একটা ফুটবল চকে আঁকা তার দুই পায়ের সম্মুখে রেখে একবার চকে আঁকা পায়ে, আরেকবার ফুটবলের দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে।
একজন নারী ইয়োহাকে জানায়, তার প্রেমিক কীভাবে প্রতিবার দেহ-সৌন্দর্য ভেদ করে তার হৃদয় স্পর্শ করতে ব্যর্থ হয়।
আরেকজন নারী ইয়োহার নিকট প্রতি রাতে তার পাথরে পরিণত হওয়ার পৌনঃপুনিকতা এবং দুর্বিষহ তার পাথর-জীবনের যন্ত্রণা বর্ণনা করে।
বিষণ্ণ এক ভোরে ইয়োহা সৈনিকদের দ্বারে দ্বারে কবর দেয়ার আশা নিয়ে ছোট ভাইয়ের লাশ খুঁজে ফেরা এক বড় ভাইয়ের অঝোর কান্না দেখতে পায়।
ইয়োহা সবার দুঃখের, যন্ত্রণার কথা শোনে, তাদের সকল কষ্ট শুষে নেয়।
ইয়োহা এক সময় পাহাড়ে ঘেরা একটা জনপদে গিয়ে পৌঁছায়। সেখানে তার সাথে ফুরা নামের একজন নারীর পরিচয় হয়। প্রথম দেখায় ফুরার চোখে মিশে থাকা বিষাদে ইয়োহার দৃষ্টি আটকে যায়। ইয়োহা ভাবে–কোন চোখে অমন বিষাদের নীড় কীভাবে জায়গা করে নিতে পারে?
পরিচয়ের কিছুদিন পর ফুরা ইয়োহাকে তার পূর্ব-পুরুষদের গল্প শোনায়; তার পূর্ব-পুরুষদের একটা জীবন-ভরপুরে বাসস্থান ছিলো, সেখানে সকালে সূর্যের আলোয় তারা ফসল ফলাতো, কোমল সন্ধ্যায় তারা বাতাসকে সঙ্গী করে নাচতো, গাইতো।
এক গ্রীষ্মে তারা কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাদের মাটিতে ভিনদেশি কিছু লোকের আনাগনা খেয়াল করে। তারা পরবর্তীতে জানতে পারে যে, সে লোকেরা তাদের জনপদে জাহাজে করে এসেছে; সাথে করে এনেছে কামান, বন্দুক। দিন যত যেতে থাকলো, তাদের জনপদে ভিনদেশিদের সংখ্যা তত বাড়তে থাকলো।
জাহাজে করে আসা মানুষেরা ফুরার পূর্বপুরুষদের সাথে মিশতে শুরু করার পর ধীরে ধীরে তাদের দীর্ঘদিনের লালন করা প্রাচীন জ্ঞানকে অস্বীকার করতে শুরু করে। জাহাজীরা বলেছিলো–পৃথিবীর প্রথম মানব-মানবী এডাম ও ইভ। পূর্বপুরুষদের জানা ছিলো–পৃথিবীর প্রথম মানবী ফুরা, আর মানব টেরা।
“সেই প্রথম মানবীর নামেই আমার নাম” ইয়োহাকে বলে ফুরা। তারপর দূরে ইশারা করে ফুরা দু’টি পাহাড় দেখিয়ে ইয়োহাকে জানায়–দুই পাহাড়ের মধ্যে ছোটটির নাম ফুরা, আর বড়টির টেরা।
ফুরা ইয়োহাকে তারপর শোনায় প্রথম মানব-মানবী টেরা ও ফুরা কীভাবে পাহাড়ে পরিণত হয়েছিলো, যেই বসন্তে জার্বি নামের এক পুরুষের আগমন ঘটলো তাদের জনপদে, ততদিনে ঈশ্বরের সৃষ্ট প্রথম মানব-মানবী টেরা ও ফুরা একে অন্যকে ভালবেসে বহু বছর কাটিয়ে দিয়েছিলো।
জার্বির ছিলো একজোড়া নীলচোখ আর স্বর্ণকেশী দাড়ি। জার্বি এসেছিলো এক ঝরনার সন্ধানে, যেই ঝরনার জলই কেবল বাঁচাতে পারে তার মৃতপ্রায় সন্তানকে। জনপদে এসে জার্বির দেখা হয় ফুরার সাথে। সে ফুরাকে জানায় তার সন্তানকে বাঁচানোর জন্য ঝরনা খুঁজে ফেরার কথা। ফুরার মায়া জন্মায় জার্বির অদেখা সন্তানের জন্য।
ফুরা জার্বিকে ঝরনা খোঁজায় সঙ্গ দেয়। ঝরনা খুঁজতে থাকা জার্বি ও ফুরাকে একত্রে দেখতে পায় টেরা। ক্রোধান্ধ টেরা জার্বি ও ফুরা দু’জনকেই হত্যা করে নিজে আত্মহত্যা করে। ঈশ্বরের নির্দেশে ফুরা ও টেরার লাশ থেকে সৃষ্টি হয় ইয়োহাকে ফুরার দেখানো দুই পাহাড়ের।
“জানো ইয়োহা, ফুরা যখন পাহাড়ে পরিণত হয়, তখন পাহাড়ের বুক চিরে জলের স্রোত বের হতে শুরু করে। অনেকে বলে, সেই জলের স্রোত থেকেই সৃষ্টি হয়েছিল পৃথিবীর প্রথম নীল ডানার প্রজাপতি।”
মাঝ দিয়ে অনেকগুলো দিন কেটে যায়। ফুরা ও ইয়োহা একত্রে পৃথিবীর পথে পথে ঘুরে বেড়ায়, বুক ভরে বাতাসে মিশে থাকা শিউলি ফুলের ঘ্রাণ নেয়, তারা সন্ধ্যার আধেক আঁধার দেখে মুগ্ধ চোখে।
ফুরা ইয়োহাকে হেমন্ত বিকেলগুলোতে তার পূর্ব-পুরুষদের অসমাপ্ত ইতিহাস শোনায়–জাহাজে আসা লোকেরা একটা সময় তাদের গ্রামের মালিকানা দাবী করে বসে, নিজেদেরকে উন্নত প্রজাতির মানুষ বলে চিহ্নিত করে পূর্বপুরুষদেরকে তাদের দাসত্ব গ্রহণ করার নির্দেশ দেয়।
পূর্বপুরুষেরা জাহাজীদের দাসত্ব গ্রহণে অস্বীকৃতি জানালে জাহাজীরা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়। সেই যুদ্ধ থামে ১১ বছর পর, যখন তাদের ঘর-বাড়ি জাহাজীরা জ্বালিয়ে দিতে শুরু করে।
পূর্ব-পুরুষেরা তাদের পরবর্তী প্রজন্মকে বাঁচাতে যুদ্ধ থামিয়ে নিজেদের জন্মভূমি ত্যাগের সিদ্ধান্ত নেয়। ঈশ্বর-প্রদত্ত নিজেদের বিশেষ ক্ষমতার ব্যবহার করে টানা ছয়দিন ধ্যানমগ্ন থাকার পর সপ্তম দিনের দিন তারা সকলে নিজেদেরকে বাদুড়ে পরিণত করে, তারপর নিজেদের মাটি ছেড়ে তারা বাদুড়বেশে উড়ে চলে যায় বহুদূরের জঙ্গলে। জঙ্গলে গিয়ে তারা পুনরায় মানুষে রূপান্তরিত হয়।
ফুরা ইয়োহাকে জানায়, জঙ্গলে বড় হওয়া সে বহু পথ পাড়ি দিয়ে পূর্বপুরুষদের ভিটামাটির রূপ দেখবে বলে, গন্ধ নেবে বলে এই জনপদে চলে এসেছে।
পৃথিবীতে শীত নেমে এলে ফুরার খেয়াল হয়, তার মতো করে ইয়োহা কখনো নিজের দুঃখের কথা বলে না।
এক মলিন সন্ধ্যায় ফুরা তাই ইয়োহাকে জিজ্ঞাসা করে, “ইয়োহা তোমার কোন দুঃখ নাই?” ইয়োহা চমকে ওঠে, তার মনে পড়ে যায় স্বর্গে থাকতে তাকে করা ঈশ্বরের একই প্রশ্নের কথা।
ইয়োহা ভাবতে গিয়ে আবিষ্কার করে তার সকল দুঃখ অন্যের–স্বর্গের খোনসু, জ্যেষ্ঠাদের দুঃখ; পৃথিবীর মধ্যরাতে বাড়ি ফেরা পিতার, সন্তানের লাশ খুঁজে ফেরা ভাইয়ের, যুদ্ধে দুই পা-হারানো কিশোরের দুঃখ। না, তার নিজের কোন দুঃখ নাই, সে অন্যের যন্ত্রণায়-কষ্টে পূর্ণ।
ইয়োহা যখন ফুরাকে জানায় তার নিজের কোন দু;খ নাই, ফুরা ইয়োহার কথা বিশ্বাস করতে পারে না, সে ভাবে–এখনো তবে ইয়োহা তাকে আপন করে নিতে পারে নাই।
ফুরাকে তীব্র একাকীত্ব আক্রমণ করে বসে, সে ইয়োহাকে বলে, “এতোদিনেও তোমার কাছের মানুষ হতে পারলাম না ইয়োহা, তাই না?” এই বলে ফুরা বিষণ্ণতাকে সঙ্গী করে চলে যেতে থাকে।
চলে যেতে থাকা ফুরাকে ডাকতে গিয়ে ইয়োহা আবিষ্কার করে, সে স্বর্গের জাকারিয়ার মতো বাক্শক্তি হারিয়ে বোবায় পরিণত হয়েছে।
হেঁটে চলা ফুরা কিছু দূর এগিয়ে যাওয়ার পর পথের পাশে বসে থাকা একটা হলুদ রঙের ব্যাঙ দেখতে পায়। ব্যাঙটাকে নিজের মতো একাকী ভেবে সে পথ থেকে হাতে তুলে নেয়। ব্যাঙটাকে সে আদর করে বুকে চেপে ধরে।
এদিকে ফুরাকে চলে যেতে দেখে ইয়োহা প্রচণ্ড যন্ত্রণায় আক্রান্ত হয়। ইয়োহা চিৎকার করে ফুরাকে ডাকতে চায়, বলতে চেষ্টা করে, “ফুরা তোমার চলে যাওয়া দেখতে পাওয়াই আমার নিজের দুঃখ, একান্ত নিজের দুঃখ”; কিন্তু ব্যর্থ হয়! ইয়োহার মুখ দিয়ে কোন আওয়াজ বের হয় না। ইয়োহার চোখে অশ্রু জমে ওঠে।
বুকে চেপে ধরা ব্যাঙটা ফুরার হাত গলে বেরিয়ে মাটিতে পড়ে লাফাতে লাফাতে বনের ভেতর উধাও হয়ে যায়। ফুরা টের পায় তার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে, শরীর নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে।
দূর থেকে ইয়োহা দেখতে পায় ফুরা মাটিতে ধ্বসে পড়েছে। ইয়োহা দৌড়ে গিয়ে ফুরার কাছে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে।
পৃথিবীতে বহু বছর কাটানো ইয়োহা ততদিনে মৃত্যুকে চিনে ফেলেছে। ফুরার দৃষ্টি দিয়ে, তাকে স্পর্শ করে ইয়োহা বুঝতে পারে ফুরার দেহে প্রাণ নাই।
ফুরার হাত নিজের মুঠোয় নিতে গিয়ে ইয়োহার নিজের হাতে অশ্রু-জমা ঝাপসা দৃষ্টি পড়ে। ইয়োহার স্মরণ হয় তাকে দেয়া ঈশ্বরের বিশেষ ক্ষমতার কথা–তার আঙুলে থাকা আংটির কথা, যে আংটি কোন মৃত মানুষের আঙুলে পরিয়ে দিলে সে বেঁচে উঠবে।
ইয়োহা এক টানে আঙুল থেকে আংটিটা খুলে ফেলে। ফুরার আঙুলে ইয়োহা আংটি পরাতে গেলে ইয়োহার চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়া এক ফোঁটা অশ্রু আংটিকে স্পর্শ করে।
……….
ইয়োহা নিজেকে স্বর্গের অশ্বত্থ গাছের নিচে হাঁটু মুড়ে বসে থাকা অবস্থায় আবিষ্কার করে। হাতে ধরে থাকা আংটির দিকে ইয়োহার দৃষ্টি গেলে সে নিথর চোখে আংটির দিকে তাকিয়ে থাকে।
ডানা ঝাপটিয়ে এসে একটা দাঁড়কাক ইয়োহার পাশে বসে পড়ে। দাঁড়কাক ইয়োহাকে বলে, “ইয়োহা আমিই সেই দাঁড়কাক, যার ডানা থেকে ঝরে পড়া দুঃখই তোমার শুষে নেয়া প্রথম দুঃখ ছিলো।”