বৃহস্পতিবার, ১৪ অক্টোবর ২০২১, ০৫:২৬ অপরাহ্ন
ডুব
বাবা অসুস্থ ছিলেন না , তবে ঠিক সুস্থও ছিলেন না। তার চেহারা ছিলো স্বাভাবিকের চেয়েও এক কাঠি উপরে। নিয়মেও সরেস। অফিস , মিটিং, বাসা। বাসায় ফিরেই মুড়ি পাকোড়া , কিংবা ফ্রোজেন সিঙ্গাড়া ভাজা। এসব কিছু চিবিয়ে চা টুকু গিলেই চলে যেতেন বন্ধুদের আড্ডায়, সারাজীবন।
মা ছিলেন স্বভাবে গালফুলানো, দেখতেও ফুটবলের মতো মতো গোল। গড়িয়ে গড়িয়েই দিন যেত তার। একা একা বাতাসে এদিক ওদিক হেলান দিকে ধাক্কা খেয়ে খেয়ে সময় কাটতো।
রান্নাঘরে পিড়ি পেতে বিরাট আয়োজনে চলতো সহজাত রান্নাবান্না। কাকরোলের মাঝখান থেকে বাদ পড়তো বিচি। নকশা করে কাটা হতো আলু । সাদা বাটিতে চিরে রাখা সবুজ কাঁচামরিচ। ডাগর মাগুরের মাথায় হাত বুলিয়ে ঘ্যাঁচ করে কেটে নিতেন মা। ইলিশের টাটকা রক্ত দেখে একবার মায়ের হাত কেটে গেছে মনে করে আমি কী চিৎকার! আসলে মা দক্ষ, মিশুক, অতি সহজ। পরপর কী নিপুণভাবে কাজ গুছিয়ে নিতেন।
আমরা ভাইবোনেরা তার ধারেকাছে থাকতাম না কাজের ভয়ে। সাতচারা খেলা বাদ দিয়ে রান্নাঘরে অকাজ করতে কে যায়! আমরা সারা বিকেলে উড়ে বেড়াতাম।
দুপুরের পর মায়ের একার সময়। এ সময়ে মুখে কাটা সুপারি চালান করে মা চলে যেতেন ছাদে। ছাদে গিয়েই তিনি অন্যমনস্ক হয়ে পড়তেন। কেননা হালকা হাসিঠাট্টার আওয়াজ ভেসে আসছে । পাশের বাড়ির ছাদে চেয়ার পেতে আড্ডা দিচ্ছেন প্রতিবেশী চাচা-চাচি। কোনও রসিকতায় হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছেন তারা। হাতে আচারের বাটি। ছাদেই তাদের দশটা মুখ খোলা আচারের বোয়েম রোদ খাচ্ছে। কতক্ষন বাদে ব্যাডমিন্টন খেলা শুরু হবে। তারা বাচ্চাদেরসহই কিছুক্ষণ খেলে নেমে যাবেন।
প্রতিদিনের এই দৃশ্যগুলো একদম পরপর মায়ের মুখস্ত। ততক্ষণ তিনি বসে থাকেন যতক্ষণ শাফি চাচিরা না নামেন।
মাঝে একদিন হঠাৎ প্রচন্ড বাতাস , ধূলোঝড়, ছাদে মেলা সব কাপড় ছড়িয়ে ছিটিয়ে এদিক ওদিক উড়ে গেছে। মা চেয়ারে থম মেরে বসে আছেন। হাতে সুপারি কাটার যাঁতি। আমি দ্রুত নিচে পড়া কাপড় তুলে নেই। ছোট পিচ্চি ভাইবোনগুলো বাতাসে নাচ। আমি এদের ধমকে নিচে পাঠাই। মায়ের কাছে এসে মা’ ডাকি। মা কিছুই শুনছেন না। চুপ হয়ে আছেন। গালি শুনে শুনে তার কান আজকাল কাজ করে না। আমি মা কে ধরে ধরে নামাই। ঝড় এখন জল হয়ে নামছে আমাদের গালে মাথায় ফোঁটায় ফোঁটায়।
ফেরার সময় মা ঝিমানো বাতাস বের হয়ে যাওয়া ফুটবলের মতো ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে হাঁটেন। আমার পড়ার টেবিলের পাশে বসেন। আমি পড়তে বসে জোরে জোরে পড়ছি। যতটা না পড়া তার বেশি শোনানো। আমার সহজ মা এগুলো বোঝেন না। সন্ধ্যা হয়ে আসে। মা হঠাৎ কি যেন মনে পড়েছে ভঙ্গিতে সরে যান। যাবার আগে আমার মাথায় তার হাত দিয়ে ছুঁয়ে যান। আমার চট করে চোখে পানি চলে আসে। একা মা আমার , গল্প করার জন্য এক আমিই আছি , অথচ আমি শুধু খেলতে যাই। কাল থেকে মায়ের সাথে মন দিয়ে গল্প করবো।
রাতের খাবারের তাড়া দিতে দিতে টেবিল গুছান মা। সবাই এসে বসি। আমি ইলিশের ডিম দেখেই মহাখুশী। ছোটভাইবোনেরা মুরগী ছাড়া কিছু খায় না। মা এটা ওটা সাধতে থাকেন। এমন সময় কলিং বেল। ব্যাস ওমনি বদলে গেল দৃশ্য।
পরের দৃশ্যে দেখা গেল বাবা ফ্রেস হয়ে খেতে বসেছেন। কানে ইয়ারফোন। হাতে অপ্পো। মাঝে মাঝে মাথা নাড়ছেন। দূর থেকে দেখলে আমাদের সাথে কথা বলছেন ভেবে ভুল হবে। বাবা আসলে ফোনে। ফোন শেষের দিকে দুই এক মিনিট আমাদের হালচাল জিজ্ঞাসা শেষে বাবা নিজের ঘরের দিকে রওনা দিলেন। কখনই মায়ের কথা জিজ্ঞেস করেন না তিনি। না জানার ভান তিনি ভাল পারেন।
আমি ঘর থেকে টের পাই বাবার ঘরের চাপা কথা, গল্পের শব্দ , ভিডিও কলের আলো মেঝেতে বাঙময় হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। আমরা সে আলো ধরতে পারি না। চাই না আসলে।
মা চুপচাপ এবার দৃশ্যে ঢোকেন। টেবিল গুছান। আমি চট করে মাকে ভাত বেড়ে দেই। কোনওমতে দুই গাল গিলেই উঠে পড়েন। আনন্দের সাথে ওষুধ খান। এত আনন্দিত তিনি আর কোনও কিছুতে নন। লাল, নীল , সাদা হরেক ওষুধ। এক জীবন রক্ষার জীবন বটিকা। তিনি তার বাচ্চাদের জন্যই বাঁচতে চান। আমাকে পড়তে বলে দ্রুত তার ছোট্ট ঘরটিতে অদৃশ্য হয়ে যান। সেখানে গুচ্ছে্র আসবাব, ডাঁই করা পুরোনো কাপড় , রঙের খালি বাক্স এবং তিনি। । সিঙ্গেল খাটে চাদর ,ঘুমানোর বালিশ কাঁথা। এই ঘরে কথাহীন আলোহীন বহুদিন নিমগ্ন আমার মা।
কয়েকবছর ধরেই এমন চলছে। বাবা যতক্ষন বাসায় মা ততক্ষণ লুকানো। যেন মায়ের ছোঁয়াচে রোগ আছে। যেন তার উপস্থিতি ক্ষতিকর। যেন তারা টিলো এক্সপ্রেস খেলছেন।
বাবার হিংস্র আচরণের সাক্ষী কেবল আমার ভাই বোনেরা এবং সবার বড় আমি। তার অন্য কোথাও সম্পর্ক আছে । কিন্তু উপায় নেই মাকে চ্যুত করে। তাই তুচ্ছ তাচ্ছিল্য , খিস্তি সব খুব নৈমত্তিক। গায়ে হাত তোলাও হয়ে গেছে তার।
শুধু মা দমে যাননি। নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন। গুটিয়ে নিয়েছেন। এটাই প্রতিবাদ। অতিমারির সংকটে নয়। অতিমারি আর কত ক্ষতি করে , বড় জোর জীবনটা টেনে নিয়ে নেয়। কিন্তু অতিমানব জীবন্ত রেখেই আত্মাকে খেয়ে ফেলে। বাইরে থেকে বোঝা যায় না। মা একাই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি এই সময়টুকুই আড়ালে থাকবেন। দেখবেন না, দেখাবেন না। সেলফ আইসোলেশন। অল্প কিছু সময় নিজেকে নিয়ে নিজের মতো থাকা , নিজের আয়নায় পুরোনো আমলের হারিয়ে ফেলা কিশোরী মুখ দেখা।