সোমবার, ২৯ মার্চ ২০২১, ০৫:৫২ অপরাহ্ন
সরকারি দয়া
বড় উপকার করচুনগো দারোগা সাব। আপনে আমার বাপ লাগুন, আপনে আমার আল্লা, আর না হয় আল্লা আপনারে নিজে পাডাইছে আমারে এই জুলমতের হাত থেকে রক্ষা করতে। কী যে শান্তি লাগতাছে, কী আর বলবো, মুক্কুসুক্কু মানুষ কথাওতো ঠিকমত কইতে পারি না। তয় খুব ভাল্লাগতাছে। দুনিয়ার শান্তি আইসা আমার কান্ধে ভর করতাছে। জন্মায়ে এমুন শান্তি কোনদিন পাইছি বইলা মনে করতে পারতাছি না। আপনারা আসলেই দেবদূত। গজবের পয়দা গরীবরে বাঁচায়া রাইখা দুনিয়াডারে দোজখ বানানোর কোন মানে আছে? কোন শালা কয় গরীবরে বাঁচায়া রাখার কথা? এইসব বোকাচোদাদের আমি চুদিও না।
এহনতো আমার রাগ হইতেছে আমারে এতদিন পরে মারলেন কেন? এতদিন কার বাল ফালাইতেছিলেন? আমারতো মরা উচিত আছিলো আরো ছোট থাকতে! আমার পোলা যে বয়সে মরছে সেই বয়সে যদি আমি মরতাম তাইলেতো আমার পোলার মরণ আর আমার দেহা লাগতো না। যেমন আমার পোলার তার পোলার মরণ দেখার আগেই দুনিয়া ছাইড়া চইলা গেছে। আমিওতো আরো আগেই যাইতে পারতাম। খামুকাই এতদিন ধইরা ঝুইলা আছি। ঝুইলা থাকার যে কী কষ্ট তা তুমরা বাঞ্চোতগুলা কেমনে বুঝবা। কতদিন ধইরা ঝুইলা আছি ঠ্যাঙ্গের মধ্যে ফাঁস নিয়া, তার হিসাব কি আছে তোমাদের কাছে? ঠ্যাঙ্গের মধ্যে ফাঁস নিয়া ঝুইলা থাকা কত কষ্টের তা কি বুঝ? তা বুঝবা কেমনে, জেলে গেছ কোনদিন? ঠ্যাঙ্গের ফাঁস গলার ফাঁস থেইকা যে কডিন এই কথা আমি প্রথম শুনছিলাম জেলে গিয়া।
জেলে প্রত্যেক রাতে প্রথমে গান বাজনা হৈত তারপর এজলাস বসানো হৈত। সেই এজলাসে একজন বিচারক সাজতো, দুইজন উকিল, কয়েকজন মেয়াসাব (পুলিশ), আর আমরা যারা গরীবগন্ডা চুরিচামারির কেইসে জেলে যাইতাম তারা আসামি। ও! কয়েকজন আবার সাক্ষীও সাজতো। বিচারকার্য শুরু হওয়ার পর, উকিল তাদের জেরাজুরা করার পর, বিচারক আসামিকে তিনদিনের ফাঁসি দিত। আমরা সবাই হোহো করে উল্লাস করতাম। কখনও কখনও আসামিরে লেট্টিনে বন্দি করে শাস্তি কার্যকর করা হৈত। এতে সবাই আরো বেশি মজা পাইতাম। বেশি চিল্লাপাল্লা হৈলে আসল মেয়াসাবরা আসত। তখন সবাই খেলাধুলা থুয়া যারা যার জায়গায় গিয়া শুয়ে পরতাম।
সেবার জেলে গেছিলাম চুরির কেইসে। ছাগল চুরির মামলা। আমি যে জীবনে চুরি করি নাই তা কমু না। তয় এই ছাগল সম্পর্কে আমি কিছু জানতাম না। বালেশ্বর-বালরে তুমি কেমন বুঝাইবা যে আমি যদি এই ছাগল চুরির বিষয়ে জানতাম তাইলে পুলিশ আর আমারে ধরতে পারতো না। জানি না বৈলাই সাদা-দিল নিয়া এলাকায় ঘুইরা বেড়াইতেছিলাম আর ধরাও খাইলাম। সেবার জেলে আইসা খুব কষ্ট হইতেছিলো, খালি আমার পোলাডারে স্বপ্নে দেখতাম। আহারে বাজান আমার, অবুঝ শিশু, তাওতো আল্লা ওরে কী কষ্টডা দিয়াই না দুনিয়া থেইক্যা তুইলা নিলো! ছোড মানুষ তখন বয়স আর কত, তিন কি চার। এহন আর মনে নাই। লোহা দিয়া নিজেই নিজের গালের মধ্যে ফুটা কৈরা ফালাইছিলো। টাকার অভাবে ডাক্তার দেখাইতে পারি না। উত্তর পাড়ার মালুর মা, ভাল কবিরাজ। সবাইরে নানা অষুধপত্তর দিয়া ভালা করতাছে কিন্তু আমার পোলারে দিবো না, কয় ‘হাসপাতালে যাও। আমার কাছে গাল ফুটা হওয়ার ওষুধ নাই।’ হাসপাতালে গেছিলাম, ওরা কয়, ‘জেলা শহরে যাও।’ বালের কথা, জেলা শহরে কেমনে যামু? টাকা কই, আর চিনিনি জেলা শহর! কই যামু কিছুইতো জানি না। গালের ব্যথায় ছেলেটা কুঁকড়াইতেছিলো, সেইডা দেইখা এক ডাক্তার আপা কয়টা বিষের গুলি দিছিলো। সেইডা নিয়াই বাড়ি যাই। সেই ফুটা গাল ফুললো, পচলো, আস্তে আস্তে ফুটা বড় হৈতে থাকলো, বইসা বইসা দেহা ছাড়া আর কিছু করতে পারলাম না। মাঝে মাঝে বিষ্যের যন্ত্রণায় কী যে চটফট করতো, তখনতো আল্লার কাছে কানছি; কইছি, ’আল্লাগো এই মাসুম বাচ্চাটারে কষ্ট না দিয়া তু্ইলা নেও।’ মাঝে মাঝে ব্যথাডা যহন কমতো তহন খাইতে চাইতো। একটু খাইতো তো একটু ফুটা দিয়া বাইর হৈয়া যাইতো। কথা বলতে চাইলে চাপার হাড্ডির নড়াচড়া দেখা যাইতো; কালা কুচকুইচ্ছা একটা চোট্ট চাপার হাড্ডি নড়ে যেন দইনহের বন্ধের সেলো মেশিনের পিস্টন, পোড়া মবিলের রং নিয়া উঠানামা করতাছে। সেইবার জেলে থাকাকালীনই পোলাডা আমার মরছে। প্রথম শুনার পর কানছিলাম। তারপর মনে হৈছিলো ভালই হৈছে সামনে ছিলাম না। আমার বাজানের মরা মুখ আর আমার দেহা লাগলো না।
বাজানের মরা মুখ দেহি নাই কথা সত্যি, কিন্তু ওর চাপার চোট্ট হাড্ডির নড়াচড়া আমার চোখ থেইকা আর সরাইতে পারলাম না। এইযে এহনও ওউরা (সরিষা) ক্ষেতের ঝুরঝুইরা মাটির মধ্যে শুয়ে আছি, পিঠের নিজে ভিজা ভিজা লাগতাছে, শইলডা, মনডা, কেমন জানি ঠাণ্ডা হৈয়া আসতাছে। আমার বাজানের চাপার হাড্ডিটা নড়াচড়া করতে করতে থাইমা যাইতাছে, আর কালা পোড়া-মবিলের রংডা চারদিকে ছড়ায়ে পড়তাছে…