রবিবার, ২৮ মার্চ ২০২১, ০৭:০৯ অপরাহ্ন
একটি ভয়াল বাস-যাত্রা
অনেকদিন আগে একটা ফরাসি গল্প পড়েছিলাম। গল্পের প্রটাগোনিস্ট ছিল একজন নারী। প্রতারক প্রেমিকের হাত থেকে নিষ্কৃতি পেতে পাড়ি জমিয়েছিল আয়ারল্যান্ডের এক গণ্ডগ্রামে। অবাক লেগেছিল পড়ে। প্রেমিকের হাত থেকে বাঁচার জন্যে এত বড় আত্মবিসর্জন?
আমাকেও যে একদিন ওরকম একটা অবস্থায় পড়তে হবে ভাবিনি। প্রায় পাঁচ বছর হাফসা বেগমের সঙ্গে অন্তরঙ্গ সম্পর্কের পর ছ’বছরের মাথায় জানা গেল, সে আমার সঙ্গে নয় আসাদের সঙ্গে প্রেমের বন্ধনে আবদ্ধ। আসাদের আগে আরও তিনজনকে নাকি সে ভালোবেসেছিল। তারা আমাদের শহরেরই যুবক।
ফরাসি গল্পের ওই মেয়েটার মতো আমারও মনে হয়েছে হাফসার ছায়া না- মাড়াতে সুদূরে পাড়ি জমাতে হবে, অন্তত কিছুদিনের জন্যে।
এম. এ পরীক্ষা দিয়ে ফলের অপেক্ষায় আছি। ফল পেতে – পেতে আরও মাস দুয়েক । তখন রাহুল সাংকৃত্যায়নের ‘ভবঘুরেশাস্ত্র’ পড়ছিলাম : ভবঘুরে হওয়া মানুষের পক্ষে পরম সৌভাগ্যের কথা। এই পন্থা আত্মকেন্দ্রিক ব্যক্তিকে মৃত্যুর পর কোনো কাল্পনিক স্বর্গের প্রলোভন দেখায় না। ভবঘুরেমি সে-ই করতে পারে যে নিশ্চিন্ত। আর নিশ্চিন্ত হওয়ার জন্যে দরকার ভবঘুরেমি। উভয়ের পরস্পর নির্ভরতা দোষের নয়, গৌরবের। ভবঘুরেমির চেয়ে বড় সুখ আর কিসে পাওয়া যাবে। বস্তুত ভাবনা চিন্তাহীন হওয়াই তো সুখের সব চেয়ে বড় লক্ষণ। ভবঘুরেমিতে কষ্টও আছে, তবে তাকে মনে করতে হবে – খাবার পাতে লঙ্কাটি। আর লঙ্কায় যদি ঝালই না-থাকে তাহলে কি কোনো লঙ্কা প্রেমিক তা ছুঁয়ে দেখবেন?…
বেশ উদ্বুদ্ধ হলাম লেখাটা পড়ে। কিন্তু কোথায় যাব? দু চোখ যে দিকে যায় সেদিকে তো আর বেরিয়ে পড়া যায় না। শুধু হাফসার বিষ-ছায়া থেকে বাঁচার প্রত্যাশায় এ সফর নয়, কিছু শিক্ষা তো অন্তত নিতে হবে! তখন হঠাৎ করেই খলিলের কথা মনে পড়ে যায়। জেলা স্কুলে আমার সহপাঠী ছিল। অর্থাভাবে লেখাপড়া চালাতে অক্ষম হয়ে এখন নিপাট কৃষক। বিয়েশাদী করে ঘোরসংসারীও। বেশ কটা বাচ্চা-কাচ্চার পিতা। সে থাকে শালুকদিয়ার চরে। জায়গাটা আমাদের শহর থেকে খুব একটা দূরে নয়। বাসে ঘন্টা খানেক ফেরিঘাট, তারপর নৌকায় আরও ঘন্টা খানেক। অনেকবার যেতে বলেছে, যাবযাব করে আর যাওয়া হয়নি।
ঝোলা কাঁধে বেরিয়ে পড়লাম একদিন সকালে। গুডবাই হাফসা বেগম। দুপুরের আগেই পৌঁছে গেলাম ফেরিঘাটে। এক – মাল্লার একটা নৌকা ভাড়া করলাম যমুনার বুকে জেগে ওঠা ওই চরে যাওয়ার জন্যে।
শীতকাল। যমুনায় ঢেউয়ের বিক্ষোভ নেই। তারপরও বিশাল নদীর ওপর নৌকাটাকে খোলামকুচি বলে মনে হলো। ঝিরঝির বাতাস বলছিল। ছলাৎ – ছলাৎ করে এগিয়ে যাচ্ছিল আমাদের নৌকা। তাকিয়ে দেখলাম কূলকিনারাহীন যমুনা। বর্ষায় রীতিমতো সমুদ্দুর হয়ে ওঠে।
“কার বাড়ি যাইবেন গো?” জিজ্ঞেস করল মাঝি। বললাম।
“ও, খলিল সাব? বড়োই বালা মানুষ। কী লাগে আপনের?”
“বন্ধু।”
“তা হইলে আপনেও নিচ্চয় বালা মানুষ। বালা মাইনসে্র লগে বালা মাইসে্র বন্ধুতা অয়।”
মাঝির এই সরলীকরণে মুগ্ধ না – হয়ে পারি না। জগতে এ ধরনের মানুষেরাই শুধু এমন সরল সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারে।অগত্যা হাসতে হলো। তখন ঘাট দেখা যাচ্ছিল। আমাদের নৌকা দেখে ছেলে – বুড়ো আর নারী – শিশুদের একটা দল এগিয়ে এল।
“কুন বাড়ির কুটুমগো আপনে?” একজন জানতে চাইল। উত্তর দিল মাঝি, “আমাগো খলিল মিয়ার বন্দুগো ইনি।”
“আইচ্ছা, আইচ্ছা আসেন।”
ঘাটে নামতেই লোকজন চলল আমার পিছু – পিছু। বলল, “চলেন, খলিল মিয়ার বাড়িতে লইয়া যাই।”
বন্ধু বাড়িতে ছিল না। তার বউ এগিয়ে এল। আমার পরিচয় জেনে বলল, “এতদিন ওই নামই খালি হুনচি, এ্যাদ্দিনে চোখে দেখলাম।”
ঝোলা থেকে চকোলেট, বিস্কুট, চিপস ইত্যাদির বেসাতি বের করে খলিলের ছেলে – মেয়ের হাতে দিয়ে তবে শান্তি।
দুপুর গড়িয়ে গিয়েছিল। দোস্তাইন খাবারের ব্যবস্থা করল : গরম ভাত, ঢেঁড়সের চচ্চড়ি, কুমড়ো শাক আর টাটকিনি মাছের সালুন। অমৃতের মতো লাগল। দোস্ত চলে এল একটু পড়েই। সোরগোল তুলে বলল, ‘কুন তরাসে এই গহীন চরে বন্ধু?’
ভাবলাম সত্যি কথাটা বলি; কিন্তু আত্মসম্বরণ করলাম। এইসব জটিল বিষয় বন্ধুকে বলে কী লাভ? তাকে শুধু শুধু ভারাক্রান্ত করা হবে। তাছাড়া প্রেমিকা বিট্রে করেছে এ – খবরটাও স্বস্তিকর নয়। বরং ভবঘুরেমির কথা বললাম তাকে। বিস্মিত হলো আমার কথা শুনে।
বলল,’ তোমার এই গুণের কথা আগে জানা আছিল না আমার।’ আমি তাকে সাংকৃত্যায়নের বইয়ের কথা বলি। তাতে সে আরও অবাক হয়। বলে,”ভবঘুরেমি আবার শাস্ত্র হয় কী কইরা?”
“বইটা আছে আমার সঙ্গে। যাবার সময় দিয়ে যাব তোকে। পড়লেই বুঝতে পারবি।”
বিকেলে চর দেখতে বেরুলাম। যত বড় ভেবেছিলাম তাতো বড় নয়। বেশ দূরে দূরে গোটা পঞ্চাশেক বাড়ি। চাষের জমিও আছে কিছু। আছে বড় বড় গাছপালা। মানুষের বসতি বেশিদিন আগে থেকে শুরু হয়নি। কৃষি কাজ ছাড়াও চরের মানুষ মাছ ধরে জীবিকার জন্যে। কিছু নিজেরা খায় বাকিটা বিক্রি করে। ফেরিঘাট থেকে মাইল তিনেক দূরে বিরাট বাজার। শুক্রবার হাট বসে।
আমাদের খলিলুর কৃষিকাজ করলেও মাছ ধরে না। বাজারে তার একটা মুদি দোকান আছে। সেখান থেকে ভালো আয় হয়। তার একটা শক্তপোক্ত এক- মাল্লার নৌকা আছে। সকালে গরম ভাত খেয়ে নৌকা নিয়ে বের হয়। নৌকা ফেরিঘাটে বেঁধে রেখে বাসে করে বাজারে যায় – মিনিট বিশেক লাগে। ফিরতে রাত হয়ে যায়।
পরের দিন সকালে ভাত, শাকভাজা আর ডাল ভর্তা দিয়ে নাস্তা করি। দোস্তাইন দুপুরের খাবার বাক্সবন্দি করে : ভাত, কুমড়ো ফুলের ভাজি, লাউ দিয়ে কুচোচিংড়ি আর ঘন ডাল।
ওখানকার বাজারটা বেশ বড়। অনেক দোকানপাট। একেক গলিতে একেক পণ্যের পসরা। মাছ বাজারে সদ্য তুলে আনা মাছ লাফাচ্ছে। তরকারির বাজারে তাজা শাকসবজি- আশপাশের গ্রাম থেকে এসেছে। বেলা দশটাও বাজেনি, বোটা থেকে কশ বেরোচ্ছে। শহরে সাতদিনের বাসি তরি তরকারি খেয়ে খেয়ে তাজা সবজির স্বাদই ভুলে গেছি আমরা।
এখানে শসাটা খুব সস্তায় পাওয়া যায়। মাত্র দুশো টাকা মণ। অনেকে দোকানে সাজিয়ে ফালি শসা বিক্রি করে। খেতেও ভালো। দোকানদার, পাইকার আর বাজারে আসা মানুষ খুব খায়। দাঁড়িয়ে – দাঁড়িয়ে এসব দেখি।
খলিলের সঙ্গে রোজই বাজারে যাই। অনেক পুরনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। তাদের কেউ কেউ স্কুলে ঘনিষ্ট ছিল। তারা ওখানে আমাকে দেখে অবাক হয়। একজনকে পাওয়া যায় যার নাম আক্কাস। বাজারের সবচেয়ে বড় চায়ের দোকান তার। বলে, ‘ যদ্দিন এইখানে আচাও আমার দুকানে চা – নাস্তা খাইবা। পয়সা দিওন লাগব না। তুমি আমাগো ছুটো কাইলা বন্ধু।’ শুনে আমি বিমোহিত। এতোদিন পরেও এরা কেমন মনে রেখেছে আমাকে।
একদিন খলিলকে বলে কিছু শসা নিয়ে ডালা সাজিয়ে বড় একটা বটগাছের নিচে বসে গেলাম বাজারে ঢোকার মুখে। খলিল অবশ্য একটা মন্তব্য করল, “ভদ্রলোকের ছেলে, আজ বাদে কাইল এম. এ পাশ করবা, বাজারে বইসা শসা বিক্রি করলে লোকে কী বলবো।”
“বাদদে তো লোকের কথা। আনন্দের জন্যে করছি। তা ছাড়া দু – চারজন বন্ধু ছাড়া এখানে কে-ই বা আমাকে চেনে?”
শসা ভালো বিক্রি হয়। নানান্ কিছিমের মানুষের সঙ্গে আলাপ পরিচয় ঘটে। লাভও বেশ। তা থেকে খলিলকে দিতে গেলে সাংঘাতিক গোস্বা করে সে। আমি শরমিন্দা হই। শসার লাভ থেকে দামি সিগারেট ফুকি। বন্ধুর বাচ্চাদের জন্যে বেসাতি কিনি। তাতে দোস্তাইন বেজার হয়, “নিত্যি আপনে এইসব কী করেন? এক দুই দিন আনলেই তো হয়। খামাখা ট্যাকা নষ্ট করনের কী দরকার?” আমি আর কী করব – হাসি।
দুষ্টু মেয়েটার স্মৃতি মন থেকে মুছে ফেলতে পারিনি এখনও। ভাগ্যিস ওর সঙ্গে সম্পর্কটা ছিন্ন হয়েছে, না- হলে সারা জীবন ভুগতে হতো।
বাজারে প্রতিদিন বিচিত্র সব মানুষের বিচিত্র জীবনে শরিক হই। রাতে বিশাল যমুনা পাড়ি দিয়ে চরে ফিরি। অন্ধকার চর। বিদ্যুৎ নেই এখানে। বাড়িগুলোতে কুপি আর হারিকেন জ্বলে। সন্ধ্যা গড়িয়ে গেলে অধিকাংশ বাড়ির আলো নিভে যায়। খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে সবাই। একটা -দুটো বাড়িতে শুধু আলো থাকে। হয়তো কোনো ছাত্র – ছাত্রী পড়া তৈরি করে। কোনো কোলাহল নেই। নেই গাড়ির শব্দ।
এই নিস্তরঙ্গ জীবন খারাপ লাগে না আমার। মনে হয় গুহামানবদের আদিম জীবনে ঢুকে বসে আছি। ফোন নেই, পত্রিকা নেই, টিভি নেই। একটা দুটো বাড়িতে রেডিও আছে। উঠানে পাটি বিছিয়ে তারা গান শোনে। শিয়ালুর মাঠে যাত্রাদল এলে দল বেধে দেখতে যায়। সিনেমা দেখতে কালেভদ্রে স্বর্ণকমলপুর শহরে যায় বাসে চেপে। চরের স্কুল মাঠে পালাগান হলে তারা শোনে। তাদের জীবনে খুব বেশি আনন্দের আয়োজন নেই।
এক হাটবারে ফেরিঘাটে কাজ থাকায় খলিল আগে চলে যায়। ফেরিঘাটে অপেক্ষা করবে আমার জন্যে। গল্পগুজব করতে গিয়ে আমি নটা বাজিয়ে ফেলি। গ্রামে এটা বেশ রাত। বাসস্ট্যান্ডে এসে দাঁড়াই। এ সময় লোকাল বাস খুব একটা থাকে না। ফেরি ধরতে ইন্টারডিস্ট্রিক্ট গুলো হুহু করে ছুটতে থাকে।
অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর একটা বাস আসে। যাত্রী নেই বেশি । ড্রাইভার, হেলপার দুজনেই মুখচেনা। ড্রাইভারের পেছনের সিটে বসে সিগারেট ধরিয়ে অর্ধেকটাতে এলে তাকে দিয়ে দেই। বলি, “আজ দেখি প্যাসেঞ্জার নেই, ব্যাপার কী?”
“হাটবার দেইখা সবাই বেলাবেলি বাড়ি ফিরা গেছে।”
ফাঁকা রাস্তা পেয়ে ড্রাইভার হু হু করে স্পীড তোলে। মিটার আশির ঘর স্পর্শ করে। ভয় পেয়ে বলি, “একী করছ, অ্যাকসিডেন্ট হবে তো!”
“ডরাইয়েন না, কিচ্ছু হইব না।”
শীতের কারণে গাড়ির জানালা বন্ধ, ড্রাইভারের পাশেরটা শুধু একটুখানি খোলা। উইতলি বাসস্ট্যান্ড পেরুলে ছোট্ট একটা স্টপেজ পড়ে। পাশে একটা গোরস্হান আছে বলে স্টপেজের নাম গোরস্হান। অন্ধকারের ভেতর থেকে দুজন লোক হাত তোলে।
“লইয়া লই ভাইজান?” ড্রাইভার জিজ্ঞেস করে।
“লও না, পরে তো আর বাস পাবে না।”
যারা ওঠে তাদের দেখে সারা শরীর হিম হয়ে যায়। পা থেকে মাথা অবধি শিরশির করতে থাকে।
ইয়া মোটা। দশাসই শরীর। লম্বায় কম করে হলেও দশ ফুট। পরনে আজানুলম্বিত সাদা পাঞ্জাবি। মাথায় ঝাঁকড়া চুল। সারা মুখে পশম। বাসটা নড়ে উঠল। দুজনের কোলে দুটি শিশু। একেবারে পেছনের সিটে গিয়ে বসল।
আমি ড্রাইভারের দিকে তাকালাম, ড্রাইভার আমার দিকে। হেলপার গেট ছেড়ে আমার পাশে এসে বসল। কানের কাছে মুখ এনে বলল, “দেখচেন মিয়াভাই?”
ড্রাইভার স্পীড বাড়াতে – বাড়াতে একশর কাছাকাছি নিয়ে গেলে আমি আতংকিত হয়ে বললাম, “আস্তে চালাও।” সে ফিসফিস করে বলল, “আপনে দেখেন নাই?”
“দেখেছি। কিছু করার নেই। ভয় না – পেয়ে মাথা ঠান্ডা রেখে চালাও।” স্টিয়ারিং হুইল ধরে রাখতে পারছে না, হাত কাঁপছে, পা-ও। ভয়ে ড্রাইভারের কন্ঠস্বর বিড়ালের মতো চিকন হয়ে আসে। মনে হলো এখনই কেঁদে ফেলবে। বলল, “কী হইবো ভাইজান?”
“কিচ্ছু হবে না, চুপচাপ গাড়ি চালাও।”
ভেতরে ভেতরে আমিও ভয়ে মরে যাচ্ছিলাম। তখন পেছন থেকে শিশুদের কান্নার শব্দ ভেসে আসে। সাহস করে পেছনে তাকালাম একটু পরে । গায়ে কাটা দিয়ে উঠল। দুজনের হাতে দুটি শিশু – মাথা অবধি খাওয়া হয়ে গেছে। আস্তে আস্তে শরীরের নিচের দিকে এগুচ্ছে। সাদা পাঞ্জাবি রক্তে ভেসে গেছে। ড্রাইভার আর হেলপার এসব কিছুই দেখেনি। জ্ঞান হারাবার উপক্রম হলো আমার।
এরা কি মিথের সেই রাক্ষস? না না, এরাই আসল রাক্ষস। মানুষ খায়। মিথের রাক্ষসের চুল হলুদ কিংবা লাল। শরীরে থাকে খাড়া – খাড়া লোম। থাকে লম্বা জিহ্বা। মিথের রাক্ষস শুধু মানুষ খায় না, খায় বন্যপ্রাণী। এরা স্পর্শ করা মাত্র মৃত্যু হয় মানুষের। সুন্দরী নারীতে পরিণত হতে পারে এরা। মানুষকে ভুলিয়ে ভালিয়ে গ্রাস করে। বামন হয়। স্বামী হয়ে নারীদের আবিষ্ট করে। প্রেমিক সাজে। কুকুর, শকুন, পেঁচা, ঈগল আর কোকিলের রূপ ধারণ করে। কিছুক্ষণ আগে যাদের মৃত্যু হয়েছে তাদের বাঁচিয়ে তুলতে পারে। আগুন আর রোদ ভয় পায়।…
ফস করে একটা সিগারেট ধরাই। ধপ করে কী একটা আমার কোলে এসে পড়ে। ভয়ে শিউরে উঠি। আমাদের বাড়ির সেই কালো বিড়ালটা যার অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে আমার দাদাজান একে একটা বস্তায় ভরে আমাকে বলেছিলেন, “যা কালিগঙ্গায় ফেলে দিয়ে আয়।” আমি তা না – করে বস্তার মুখ খুলে দিয়ে বলেছিলাম, “যেখানে খুশি চলে যা, আমাদের বাড়িমুখো হোসনে কোনোদিন।” আমাদের বাড়ি থেকে এই জায়গা অনেক দূরে। এখানে ও এল কেমন করে?
দু পায়ে আমার গলায় ঝুলছিল। ড্রাইভার ভয় পেয়ে বলল, “এইহানে বিলাই আইলো কেমনে?”
“ভয় পেও না, পোষা বিড়াল, আমাদের বাড়ির।” বিড়াল বলল, “কথা বোলো না, চুপ করে বসে থাক। একদম ভয় পেও না। ওরা আমাদের দেখে ভয় পায়। দেখবে এখনই নেমে যাবে।”
ত্রস্তে উঠে এল দুজন। ধপ্ ধপ্ করে গেটের কাছে এসে আগুন চোখে তাকাল আমাদের দিকে, তারপর লাফিয়ে পড়ল চলন্ত বাস থেকে। হালকা হলো বাস।
ততক্ষণে আমরা ফেরিঘাটে পৌঁছে গেছি। রেস্তোরাঁ গুলোতে বাতি জ্বলছে। লোকজন বসে খাওয়া দাওয়া করছে।
ড্রাইভার গাড়ি থামিয়ে চিৎকার করে উঠল , “আল্লাগো ইয়ারা ক্যারা?” সঙ্গে সঙ্গে মূর্ছা গেল। লোকজন ছুটে এল। আমাদের কথা কিছুতেই বিশ্বাস করল না। বলল, “ধান্দা দেখচেন আপনেরা।”
ভূত – প্রেত, দৈত্যদানো কিংবা অশরীরী কোনো কিছুতে বিশ্বাস নেই আমার। ও-সবের অস্তিত্ব শুধু রূপকথার বইয়ে আর আইজ্যাক সিঙ্গারের গল্পে। কিন্তু আজ নিজের চোখে যা প্রত্যক্ষ করলাম তার সঙ্গে আর কিছুকেই মেলানো যায় না।
সেই রাতে খলিলের অনেক অনুরোধ সত্ত্বেও আর শালুকদিয়ার চরে ফিরে যাইনি। রাতটা ফেরিঘাটের একটি হোটেলে কাটিয়ে পরদিন সকালে প্রিয় শহর স্বর্ণকমলপুরে ফিরে গিয়েছিলাম, যে শহরে বাস করে হাফসা বেগম; যার কথা মনে হলে ঘৃণায় শরীর ঘিনঘিন করে ওঠে।