সোমবার, ২৯ মার্চ ২০২১, ০৬:১১ অপরাহ্ন
জীবন অথবা মৃত্যুর গল্প
বাচ্চুর চায়ের টং ঘরে চায়ের গ্লাস হাতে নিয়ে শাহীন মিয়া ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। তার দৃষ্টি আনুমানিক ত্রিশ মিটার দূরে। দৃশ্যটা তার কাছে একদমই নতুন নয়। এর আগেও দেখেছে। প্রথম যেদিন দেখেছিল কেমন বমি বমি পাচ্ছিল। সে বছর বিশেক হবে। আজকে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে আছে ঠিকই, কিন্তু তার কাছে খারাপ লাগছে না। সময় মানুষকে অনেক কিছু হজম করতে শেখায়।
একটা বড়সড় কাচের গ্লাসে লেবু দিয়ে চা। লেবু চা খাওয়ার শুরুটাও সেই থেকেই। বমি বমি ভাবটা কাটাতে প্রথম প্রথম লেবু চা খেত। সেই বমি বমি ভাবটা নেই আর এখন, কিন্তু লেবু চায়ের অভ্যাসটা রয়ে গেছে। বাচ্চু চা আজকে ভালো বানায়নি। চা পাতা, পানি, লেবুর রস আর চিনির পরিমান ঠিকঠাক হলেই চা ভালো হয়। বাচ্চুর চা শাহীনের পছন্দ। ভালোই বানায়। তবে মাঝে মাঝে গণ্ডগোল পাকায়া ফেলে। সে মনে মনে বলে- “বউয়ের সাথে মারামারি কইরা আহে কিনা হালায় কেডায় জানে। মন-মর্জি খারাপ থাকলে মাঝে মইদ্দে এমন অয়। কোনদিন চিনি বেশি অয়, কোন দিন লেবুর রস বেশি অয়। আইজকা চা ভালা অয় নাই।”
চা ভালো না লাগার আরেকটা কারণ হতে পারে শাহীনের বিক্ষিপ্ত মন। অসুস্থ মেয়েটাকে ঘরে রেখে এসেছে। গত কয়েকদিন ধরেই জ্বর উঠা-নামা করছে। দিনের বেলা ভালো, কিন্তু রাতের বেলা গা পুড়িয়ে জ্বর আসে। জ্বরের ঘোরে আবোল তাবোল বকতে থাকে। সে আর তার বউ মিলে সারা রাত জেগে থাকে। তাদের ঘরে জ্বর মাপার মেশিন নেই। থাকলে হয়তো ১০০ এর উপরেই থাকতো, ১০২/১০৩। গরীবের জ্বর আইজকা আছে কাইলকা নাই। তার আর তার বউয়ের ধারনা ছিল- “এমনে এমনেই জ্বর আইসে, এমনে এমনেই জাইবগা”। কিন্তু না, জ্বর যাচ্ছে না, এর সাথে যোগ হয়েছে তীব্র মাথা ব্যথা। ব্যথা যখন ওঠে, মেয়ের আর দিগ্বিদিক জ্ঞান থাকে না। মাথা চাইপ্যা ধইরা চিক্কর পারে। আজকে দশ দিন ধরে এই অবস্থা। দোকানের কাছের একটা ফার্মেসি থেকে কিছু ব্যথা আর জ্বরের ঔষধ মেয়েকে খাইয়েছে। কিন্তু কাজ হয় নি। এই জ্বর কোন সাধারন জ্বর না, শাহীন বুঝতে পারে। বুঝতে পারে যে বড় কোন ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া দরকার। কিন্তু শাহীনের কাছে এখন কোন টাকা পয়সা নাই। গত সপ্তাহ দুয়েক তার কাছে কোন ক্ষ্যাপ নাই। ক্ষ্যাপ না থাকলে ইনকাম নাই। একটা ক্ষ্যাপের আশায় বসে আছে গত দশ- বারো দিন। “আল্লাহ যদি মুখ তুইল্যা চায়। মাইয়াডারে যদি একটু ভালো চিকিৎসা করাইতে পারি”, শাহীন ভাবে।
এমনিতে কপাল ভালো হলে শাহীনের, সপ্তাহে দুই-তিনটা ক্ষ্যাপও কোন কোন সময় মিলে যায়। আবার কপাল খারাপ হইলে মাসে একটাও মিলে না। এইবারতো গত বারো দিন ধইরা কোন ক্ষ্যাপ নাই।
চায়ের গ্লাসে চুমুক দিয়ে শাহীন সামনে তাকায়। ঘটনা কি ঘটছে বুঝার চেষ্টা করে। নরসিংদী রেলওয়ে ষ্টেশনে বাচ্চুর চায়ের দোকানের আনুমানিক ত্রিশ মিটার দূরে রেলওয়ে পুলিশ ফাড়ির সদস্য আর রেলস্টেশন কর্মকর্তারা কথা বলছেন। তার কিছুটা দূরে একটা মানুষ চার টুকরা হয়ে পড়ে আছে। মাথাটা আলাদা হয়ে দূরে ছিটকে গেছে। পা দুটো উরুর দিকে কাটা। রেললাইনের দু-দিকে ছিটকে পরে আছে। দূর থেকে শাহীন আবছা আবছা দেখছে। স্থানীয় লোকজনের সাথে কথা বলছেন পুলিশরা। অনেকদিন এই ষ্টেশন এলাকায় থাকতে থাকতে শাহীনের সব বোঝা হয়ে গেছে। লোকজনের সাথে কথা বলে মৃত্যুর কারণ বুঝবে, তারপর যদি আত্মীয় স্বজনের খোঁজ পাওয়া যায়, তারা রাজি থাকলে তাদের কাছে লাশ বুঝিয়ে দিবে, না হলে ময়না তদন্তের জন্য মর্গে নিয়ে যাবে, ময়না তদন্ত শেষ হলে আত্মীয় স্বজন লাশ নিয়ে বাড়ি চলে যাবে।
তবে থানা-পুলিশের আগেই শাহীনের ঘটনা জানা। অন্য দিন হইলে সে নিজেই আগ বাড়িয়ে গিয়ে ঘটনার বৃত্তান্ত পুলিশ স্যারদের জানাত। তাদের সবার সাথে তার ভালোই খাতির। স্টেশন মাস্টারও তাকে ভালো করেই চিনে। কিন্তু আজকে মেয়ের জন্য তার মনটা খারাপ ছিল বিধায় আগ বাড়িয়ে সে যায় নি। এখানে বসে লেবু-চা খাচ্ছে, আর দূর থেকে ঘটনা দেখতেই ভালো লাগছে। ঘটনা আজকে তার চোখের সামনেই ঘটেছে বলা যায়। সবসময় যে এমন চোখের সামনে ঘটে তা না, মাঝে মাঝে ঘটে। বাচ্চুর চায়ের দোকান শাহীনের রোজকার আস্তানা। স্টেশনে আসলে সে এই জায়গাতেই বসে। বাচ্চুর সাথে কথা বার্তা বলে। কাস্টমার এই দোকানে ভালোই থাকে। তবু যে শাহিন একটা জায়গা পাকাপোক্ত কইরা বইসা থাকে তাতে বাচ্চু কিছু মনে করে না। তো ঘটনা যেইটা ঘটলো তার চোখের সামনেই। একটা ইয়াং মত পোলা, কানের মইদ্দে হেডফোন গুজাইয়া দিয়া দৌড়াইয়া রেল লাইন পার হইতে ছিল, উষ্ঠা খাইয়া এক্কেবারে লাইনের উপর, তারপর সাই কইরা টেরেন চইলা গেলো। এক্কেবারে তিন টুকরা। মাথাটা এক্কেবারে আলগা হইয়া ছিটকাইয়া দূরে। এইসব বেকুব পোলাপানের বুদ্ধি সুদ্ধি কবে অইবো। শালারা! শাহীন একটু লজ্জিত হয়, মৃত মানুষকে গালি দেওয়া জায়েজ না। কিন্তু শাহীন গালি না দিয়ে পারলো না। কর্মের ফল।
-আরো কত আজব কিসিমের লোকজন যে আছে। কোন কোন হালায় ফোনে কতা কইতে কইতে ধ্যান্দার মতন হাটতে হাটতে লাইন পার অয়। কি জন্মের কথা যে কয়। কিছু কিছু মক্কেল আছে আবার টেরেনের লগে সেলফি তুলবার যায়। সেলফি তুলবি গার্লফেরেণ্ডের লগে তোল, বউ-পোলাপানের লগে তোল, টেরেনের লগে কিয়ের পিরিত। বাহাদুরী দেখাইবার আর জায়গা পাস না। কেউ কেউ আছে আবার ডার্লিঙের কাছে ছ্যাকা খাইয়া, নাইলে বউয়ের লগে ক্যাচাল কইরা ঝাঁপ দেয়। বেক্কলের দল কোনহানকার। বাইচ্চা থাকলে কত গার্লফেরেণ্ড আইবো, যাইবো। মরার কি দরকার। অবশ্য সব হালা যে মরে তাও না। দুই একটার হাত-পা কাডা যায়, পঙ্গু অয়, কিন্তু বাইচ্চা থাকে। বাইচ্চা গিয়া মরে আরকি, সারা জীবন লুলা অইয়া বাচে। কর্মফল। কিন্তু একবার এক জনের চিৎকার দেখে শাহীন তবদা খেয়ে গেছিল। যখন দেখলো মরে নাই, সে যে কি খুশি। পা দুইটা গেছিল, রক্তে ভাসতেছিল, তারপরেও বাঁচনের আনন্দ। হায়রে জীবন!
ঘটনা ঘটলেই শাহীনের ডাক পরে। অনেক সময় রেলওয়ে পুলিশ কিংবা রেলওয়ে অফিসার আসার আগেই সে চলে আসে। বাচ্চু খবর দেয়, কিংবা অন্য কেউ। তার কাছে খবর আগেই চলে যায়। শাহীনও চলে আসে তার ভটভটি নিয়ে। স্টেশন থেকে লাশ মর্গে নেওয়া, তারপর আত্মীয় স্বজনের খোঁজ মিললে তাগো বাড়িতে পৌছাইয়া দেওয়া। আয় মন্দ না।
ফাড়ির পুলিশ দূর থেকে ডাক দেয় – ঐ শাহীন, চল রওয়ানা দে। লাশ মর্গে লইয়া চল।
– আইতাছি স্যার। চা’ডা শেষ কইরা লই। একটা মিনিট।
শাহীন চায়ে চুমুক দেয় দ্রুত। সন্ধ্যা নাগাদ ডিউটিডা শেষ করতে পারলে ভালোই পয়সা পাওন যাইব। জে মরছে তাগো আত্মীয়-স্বজনের অবস্থা ভালোই মনে হইল। পয়সা ভালোই মিলব। এই বিপদে শাহীন ছাড়া গতি কি। মরা লাশ নিয়া যাওনের আর কোন উপায় নাই। জিন্দা মানুষের সঙ্গ দেয়নের মানুষের অভাব নাই, কিন্তু মরা মানুষের কোন সঙ্গী নাই। এই স্টেশনে কাডা পড়লে উপরে আল্লাহ আর নিচে শাহীন মিয়াই ভরসা। মাইয়াডারে কাইলকাই বড় একটা ডাক্তারের কাছে লইয়া যাইতে অইবো।
কিছুটা উৎফুল্ল মনে শাহীন লেমন চায়ের গ্লাসে শেষ বারের চুমুক দিয়ে যায়। কিছুটা চা বাকী আছে। চায়ের দিকে চোখ পড়তেই হঠাত মনে হইলো চায়ের রঙ কেমন জানি বেশি লাল, রক্তের লাহান। একটুখানি থমকে যায় শাহীন মিয়া, শেষ চুমুকটা আর দেয় না, চাটা পায়ের কাছে ছুঁড়ে ফেলে দেয়।
কনস্টেবল হাক দেয় – কি, চা খাওয়া শেষ হয় নাই?
আইতাছি স্যার, বলে শাহীন কোমর থেকে গামছা খুলে একটা ঝাড়া দিয়ে গলায় ঝুলায়। মাটিয়ে পড়ে থাকা চায়ের দিকে আবার তাকায় সে, রঙ কেমন আরো বেশি লাল দেখায়।