শনিবার, ০৩ জুলাই ২০২১, ১১:০৪ পূর্বাহ্ন
নিভৃত সেই কুঠুরি
মাথার ওপরে ভারী কোন কিছুর চাপ অনুভব করলো নিলয়, কোথায় আছে বুঝতে পারলো না। চারদিক মনে হচ্ছে নিকষ কালো অন্ধকার। আস্তে আস্তে আলোটা চোখে সয়ে আসতেই দেখলো দু’জন লোক পাশে বসে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। একজন তার কপালে কাপড় চেপে চেপে জলপট্টি দিচ্ছে, তাতেই মনে হচ্ছে যেন মাথার ভেতর চাপ-চাপ ব্যথা তৈরী হচ্ছে। সারা শরীরেও তীব্র ব্যথা; হাতটা নাড়াতে চাইলো, কিন্তু এক চুলও পারলো না। তাকে চোখ খুলতে দেখে একজন বলে উঠলো, ‘যাক, জ্ঞান ফিরছে তাইলে! কথা কইয়েন না ভাই। জ্বরে আপনার গা এক্কেরে আগুনের লাহান তাইতা আছে। আমরা পানিপট্টি দিতাছি, আপনে এবার কিছু একটা খাইয়া লন। তাইলে একটা ওষুধ খাওয়াইতে পারবো, তই জ্বরটা কমবো মনে লয়।’ নিলয় ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। কে এরা, কী বলছে কিছুই বুঝতে পারে না।
‘আমি কোথায়?’ বলার চেষ্টা করলো, কিন্তু ঠোঁট দুটোই নড়লো শুধু, গলা দিয়ে কোন শব্দ বের হলো না। পাশের ছেলেটা খেয়াল করলো যে, সে কিছু বলার চেষ্টা করছে। মুখের কাছে কান নিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো; বুঝতে না পেরে বললো, ‘এহন থাউক, আপনে এটটু সাইরা ওঠেন, তারপর কথা কইয়েন। বেবাক জানতে পারবেন তহন, এহন চোখ বুইজা থাহেন।’
আবার ঘুমের অতলে তলিয়ে গেল নিলয়। ঘুম যখন ভাঙলো তখন সকালের রোদ ঝকমক করছে চারদিক। মাথার চাপটা কমেছে, শরীরটাও মনে হচ্ছে একটু নাড়াতে পারছে। হাতটা নাড়ানোর চেষ্টা করলো, নড়ছে। চোখটা পিটপিট করে আরো ভালো করে একটু দেখার চেষ্টা করলো এদিক-ওদিক। মাথার ওপরে টিনের ছাদ, সে যেখানে শুয়ে আছে তার সামনে দুই পাল্লার কাঠের দরজাটা হা করে খোলা। বাইরে একজন মহিলার সাথে কথা বলছে আর-একজন লোক। নিলয় হাতটা একটু তুললো, লোকটা কথা বলতে বলতে ঘরের দিকে তাকাতেই, ওর হাত নাড়ানোটা দেখে তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকলো। কাছে এসে বিছানার পাশে বসে হাতটা ধরে বললো,
‘এই তো ভাই, চোখ খুলছেন! এখন কি একটু ভালো লাগতাছে? যমে-মানুষে ভালোই টানাটানি করলেন কিন্তু! কাইল রাতে আমরা তো ভাবছিলাম আর বুঝি পারলেন না, ডাক্তার সাব খুব ভালো ওষুধ আপনেরে দিছে, ইন্জেকশান দিলো, আরো কত কিই না করলো! মনে হইতাছে ভালোই কাজ দিছে ওষুধে।’
নিলয় কষ্ট করে বলতে পারলো, ‘আমি কোথায় আছি?’ ‘এইডা কড়াইল বস্তি, আপনে এহন আমগো ঘরে আছেন ভাই। পাশের বিল্ডিং-এ আগুন ধরছিল, আপনেরে আমরা ঐ বিল্ডিং-এর পাশের একটা নালার ধারে অজ্ঞান অবস্থায় কুড়াইয়া পাইছিলাম। বড় বাঁচা বাইচা গেছেন! কত মানুষ যে পিঁপড়ার লাহান মরলো! ইসস্! কীভাবে যে কী হইলো!’
এক নিমেষে নিলয়ের মনে পড়ে গেল সবকিছু। এক ট্রাভেল এজেন্সি’র অফিসে গিয়েছিল ও; অনেকদিন ধরে যাদের সাথে কথা চলছে সিংগাপুরে কোন কাজ নিয়ে যাওয়া যায় কিনা সেজন্যে। ইতিমধ্যেই বড় অংকের টাকা-পয়সাও জমা দিয়েছে অনেক কষ্ট করে; আরো কিছু বাকি আছে, পরে যা কাজ করে শোধ দেয়ার কথা। অফিসেরই আজাদ নামে একজনের সাথে ওর একটু বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কও তৈরি হয়েছে। ঐ দিনই মোটামুটি নিলয় জানতে পারে যে, এক মাসের মধ্যেই ওর যাওয়ার একটা সম্ভাবনা আছে। খুব খুশি মনে আজাদের সাথে প্রয়োজনীয় কিছু কাজ শেষে, দু’জনে বসে যাওয়ার নানা খুঁটিনাটি বিষয়ের প্রস্তুতি নিয়ে কথা বলছিল। হঠাৎ একটা চিৎকার, শোরগোল শুনতে পায়। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ইলেক্ট্রিসিটি অফ হয়ে গেল। কোন্ দিক থেকে জানি ধোয়া এসে ঘর ভরে গেল। পাগলের মত দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে দৌড় দিয়েছিল; কী হয়েছিল কিছুই আর এখন মনে পড়ছে না।
‘আমি কতদিন আছি এখানে?’ নিলয় জিজ্ঞাসা করলো ছেলেটাকে। ‘আইজ ধইরা সাত দিনের দিন চলতাছে ভাই।’ ছেলেটা উত্তর দিলো।
নিলয় শূন্যদৃষ্টিতে টিনের ছাদের নিচে তাকিয়ে থাকে। ওর বাড়ীর লোকজনের কথা মনে হল। বাড়িতে মাকে বলে এসেছিল যে, ওখানে সে যাচ্ছে। বাড়ির লোকজন তাহলে তো খোঁজ করেছে ওখানে। অবশ্য যদি কারো সময় থাকে–সবাই যার যার কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে–কারো জন্যে কারো তেমন সময় নেই। এমনিতেই ওর উপর সবাই চরম বিরক্ত। ২৫ বছর পার করে ফেললো, এখনও সংসারের তেমন কোন কাজেই সে লাগতে পারছে না। হাবীবুল্লাহ বাহার কলেজ থেকে ডিগ্রিটা শেষ করে এমএ-তে ভর্তি হয়েছে। পড়ার পাশাপাশি একটা বই-এর দোকানে পার্টটাইম চাকরি, আর মাসে একটা টিউশনি করে নিজের হাত খরচটা চালাতে পারে অবশ্য। সেটার জন্য আর মায়ের কাছে হাত পাততে হয় না; তবে বাবার হোটেলেই খেতে হচ্ছে এখনও। বাবা ত্যক্ত বিরক্ত হয়ে যার নাম দিয়েছেন ‘লিল্লাহ বোর্ডিং’। বড়ভাইটাও ছোট একটা চাকরি করে, কিন্তু ভাবী আর তিন বছরের ছোটমেয়ে ঝুমুরকে নিয়ে তাদেরও বাবার হোটেলের ওপর ভরসা করতেই হয়। বাবার পেশকারের স্বল্পবেতনের চাকরিও আছে আর মাত্র বছর দুয়েক; তারমধ্যেই দুই ভাই সংসারের হাল ঠিকমতো ধরতে না পারলে সংসার চালানোই মুশকিল হবে। ছোটবোন মুক্তিটাও এ-বছর ভালো একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার জন্য প্রাণপণ খেটে মরছে, দুই ভাই যেটা পারেনি, মুক্তিকে নিয়ে বাবা মার সেই আশা যদি মেটে।
‘কাছের মানুষ দূরে থুইয়াআ… মঅঅরি আমি ধরফরাইয়া রেএএএ্’…নিলয় শুয়ে শুয়ে ঘরের একটু খুলে রাখা দরজার ফাঁক দিয়ে দেখে, একটু দূরে বহুতল এক ভবনে কেউ একজন দড়ির মই-এ ঝুলতে-ঝুলতে বাড়ির গায়ে রং লাগাচ্ছে, আর উদাত্ত গলায় গেয়ে যাচ্ছে। অন্যের বাড়ির গায়ে রং মাখাতে মাখাতে, না জানি কোন্ ভালোবাসার মানুষের কথা মনে ক’রে তার বুকের ভেতর এই ধড়ফড়ানি। রোদশি’র কথা মনে হলো নিলয়ের। সাতদিন ধরে যে ওর কোনও খোঁজ নেই। রোদশি’র কী অবস্থা কে জানে! প্রায় আড়াই বছরের সম্পর্ক তাদের, কিন্তু এর পরিণতি কি সেটা দু’জনের কারোরই জানা নেই। রোদশি’র কাছে নিলয় দুর্বোধ্য এক মানুষ; দু’জনে খাচ্ছে-দাচ্ছে-ঘুরছে-ফিরছে একসাথে, কিন্তু সম্পর্কের পরিণতির ব্যাপারে নিলয় একদম স্পিকটি নট। আসলে নিলয় জানে না যে, রোদশি’কে সে কী বলবে। কারণ ওর সামনে খুবই অনিশ্চিত এক ভবিষ্যৎ! প্রাণপণে একটা ভালো বেতনের চাকরি জোটানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে, কিন্তু কোথাও থেকে তেমন কিছু হচ্ছে না। ঐ এক টিউশনি আর বই-এর দোকানের ছোট্ট চাকরি সম্বল করেতো আর মেয়েটাকে বলা যায় না–‘চলো বিয়ে করি।’
রোদশিও ওদের বাড়ির অবস্থা বেশী কিছু জানে না, খুব একটা সেটা নিয়ে কথাও হয় না। তবে মাঝেমাঝে রোদশিদের মোটামুটি স্বচ্ছল পরিবারের গল্প শুনতে শুনতে নিলয় ভেতরে ভেতরে আরো গুটিয়ে যায়। ওর নিজের বাড়ির কোনও কথা রোদশি-কে জানানোর মতো কোনও পরিস্থিতিই তৈরি হয় না। রোদশি’রও আসলে এসব দিকে ভ্রূক্ষেপ একটু কমই; সে তার লেখাপড়া আর নানারকম গান, কবিতার অনুষ্ঠান নিয়ে মেতে থাকে; আর পাগলের মত ভালোবাসে নিলয় আর তার কবিতাকে, যা নিয়ে তার উচ্ছ্বাসের সীমা নেই। দেখা হলেই তার প্রথম কথা–‘বলো নতুন কী লিখেছ, তাড়াতাড়ি দেখাও।’ নিলয়ের কবিতা নিয়ে তার যত আগ্রহ! কিন্তু সে জানে না বাইরে থেকে দেখতে মিষ্টি চেহারার একটু কেয়ারলেস কেয়ারফুল নিলয়ের জীবনটা কবিতার মতো এত সুন্দর নয়। সেখানে অনেক কাঁটা ফুটে থাকে অহরহ, যেটা রোদশি দেখতে পায় না; কিন্তু নিলয় সেসব আঘাতে বিপর্যস্ত এক প্রাণ।
দু’জনের পরিচয় হয়েছিল বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের এক স্বরচিত কবিতাপাঠের অনুষ্ঠানে। নিলয়-এর কবিতা শুনে মুগ্ধ রোদশি কাছে এসে পরিচয় দিয়ে ভালোলাগার কথা বলেছিল। সেই শুরু… তারপর মাঝে মাঝে ফোনালাপ, মেসেন্জারে যখন-তখন কাব্যিক অনুভূতির আদান-প্রদান করতে করতেই, কখন দু’জনে কাছাকাছি চলে এসেছে। বাস্তব জীবনের কুশ্রী বিষয়গুলো থেকে পালাতে নিলয়ের একমাত্র আশ্রয় তার এই কাব্যজগৎ, যার প্রাণভোমরা হলো রোদশি। এটা তার পরম আরাধ্য জায়গা, খুব মমতা আর ভালোবাসার জায়গা। এখানে তার কোনও ফাঁকিঝুকি নেই, কিন্তু এটা তো তার পেটের ভাত জোগাতে পারছে না; তার আপাত বাহ্য হতশ্রী জীবনটাকে একটু সুশ্রী করতে পারছে না। সেটার জন্য তাকে অন্য কিছুর ধান্ধা তো করতেই হবে, নাহলে এই ভালোবাসার জায়গাটাতেও তো কয়েকদিন পর প্রবেশ নিষেধ হয়ে যাবে–যেটা সে চায়না–আর চায়না বলেই নিলয় জানে তার জীবনের সাথে কিছুতেই রোদশি-কে জড়ানো চলে না; অন্তত এই মুহূর্তে। অথচ ওকে ছাড়া জীবন কাটানোর কথা ভাবলে তার বুকের ভেতরটা খালি হয়ে যায়। কিন্তু সে জানে রোদশি’র মতো এমন রোমান্টিক স্বভাবের একটা মেয়ে তাদের বাড়িতে একদিনও থাকতে পারবে না। যে- বাড়িতে প্রতিদিন সকাল শুরু হয় বাবা-মার বিশ্রী বাকযুদ্ধ দিয়ে, সারাক্ষণ এটা নেই সেটা নেই, নেই নেই নেই….বাড়িটাতে যেন জীবনই নেই! নিলয়ের মনে হয় ‘দান্তে’র ‘ডিভাইন কমেডি’র সেই বিখ্যাত উক্তি তাদের এই বাড়ির জন্যেই লেখা হয়েছিল—‘সব আশা ত্যাগ ক’রে তবেই এখানে ঢোকো হে বাছা’… তো এরকম একটা বাড়িতে রোদশি-কে ঢুকতে বলার কথা নিলয় কল্পনাও করতে পারে না। দু’জনে যে নিজেদের মতো করে জীবনটা শুরু করবে, সেই আর্থিক সংগতির ধারে কাছেও সে এখন নেই বলেই, রোদশি-কে নিয়ে কোন ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করার কথা সে ভাবতেও পারছে না। পারছে না মেয়েটাকে কোনও প্রতিশ্রুতিও দিতে। নিজের ভেতর শুধু ছটফট করে মরে, আর ভেতরে ভেতরে এ-জীবন থেকে পালানোর পথ খুঁজে বেড়ায়! সেদিনও তো সেই পথ খুঁজতেই না ঐ ট্রাভেল এজেন্সিতে গিয়েছিল! কিন্তু কী হতে কী হয়ে গেল!
খুবই সুশ্রী, পেটোয়া স্বাস্থ্যের একজন মহিলা হাসি-হাসি মুখে ঘরে এসে ঢুকলো। সকালে এর সাথেই এই ঘরের লোকটা (যার নাম পরে শুনেছে মনির না কী যেন) কথা বলছিল দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে। মাথাভর্তি সুন্দর চুলগুলো তেল দিয়ে টানটান ক’রে পরিপাটি করে আঁচড়ানো। চোখভর্তি কাজল। ফিরোজা আর লাল রং-এর সালোয়ার কামিজ পরনে, ’একেবারে গোবরে পদ্মফুল!’ ভাবলো নিলয়। ওকি ওদের ঘরটা দখল করে রেখেছে নাকি পুরোটা? মনির ছেলেটাকে রাতে মেঝেতে শুতে দেখেছে পাটির উপরে কাঁথা পেড়ে। ও নিজে ঘরের একমাত্র চৌকিতে শুয়ে আছে। চৌকিটা যথেষ্টই আরামদায়ক বলতে হবে। ইটের গাঁথুনি আর টিনের চাল দেয়া ঘরটার চারদিক একেবারে পরিপাটি করে রাখা। ঘরের এক কোনে দড়িতে দু’জন মানুষের কাপড়চোপড় গুছিয়ে রাখা, তার পাশে একটা ছোট টিভি, আরেক পাশে একটা কাঠের তাকের ওপর হাড়িপাতিল, খাওয়া-দাওয়ার জিনিসপাতি গুছিয়ে রাখা। নিলয় যেখানে শুয়ে আছে, সেখানে মাথার ওপর একটা ছোট ফ্যানও হালকা করে চালিয়ে দেয়া আছে। পুরো ঘরটায় যে একজন গোছানো মানুষের হাতের ছোঁয়া আছে, সেটা নিলয় দুপুরে তাকিয়ে তাকিয়ে খেয়াল করছিল। মেয়েটা এসে ওর কাছে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে হাতের চেটো উল্টে ইশারা করলো, ‘এখন কেমন আছো?’ ‘আরে, বোবা নাকি? কী সাংঘাতিক! মুখের শব্দ বের না হওয়া পর্যন্ত সেটা বোঝার কোন উপায়ই নেই!’
ঠিক তখনই মনির এসে ঘরে ঢুকে মেয়েটার সাথে ইশারা-ইঙ্গিতে অবলীলায় কথা চালিয়ে যেতে লাগলো। ওদের অদ্ভুত কথোপকথন শেষে মেয়েটা আবার নিলয়ের দিকে তাকিয়ে, ঝকঝকে দাঁতগুলো বের ক’রে, একটু শব্দ করে হেসে বেরিয়ে যেতেই, মনির ওর দিকে ফিরে বললো,
‘আমার পরিবার, কথা বলতে পারে না; কানেও শোনে না। কিন্তু ভালো মাইয়া, আপনে এইহানে আছেন বইলা ও পাশের ঘরে অর এক বান্ধবীর ঘরে এই ক’দিন যাইয়া থাকতাছে আর কি!’
নিলয় আস্তে করে বললো, ’আমার জন্যে আপনাদের খুব অসুবিধা হয়ে যাচ্ছে।’
‘না না কী কন … মানুষ মানুষের জন্য এইটুকু করবো না! আপনেরে যে অবস্থায় পাইছি, বাচনেরই কথা না…আজকে তো একদমই সুস্থ দেখাইতাছে। আপনের জামাকাপড়ের পকেট বেবাক হাতড়াইয়াও কোন কিছু পাই নাইককা যে কাউরে খবর দিবো! আপনি কি বাসায় ফোন করতে চান ভাই? আজকে একটু কথা বলতে পারতাছেন?’
এতক্ষণে নিলয়ের ওর ফোনটার কথা মনে হলো! তাইতো! ফোনটা কোথায় গেলো! ওর পকেটে মানিব্যাগ, ফোন সবইতো ছিল! তার মানে ওরা ওকে পাওয়ার আগেই সেগুলো কেউ তুলে নিয়েছে! শালার বাঙালি! একটুও দেরি করেনি, মরা মানুষ হলেই বা কি! তার মানে গত সাতদিন ধরে কেউ জানেই না ওর কী হয়েছে, নিশ্চয়ই ফোনে অসংখ্যবার সবাই চেষ্টা করেছে! তাহলে ও এখন মৃত না জীবিত, এই পৃথিবীর কেউ কিছু জানে না। ওদের কাছে ও হয়তো মৃতই! এমন ভয়ংকর দুর্ঘটনার পর, সাত দিনে কোনো খোঁজ যখন পায়নি, তার মানে ওরা তাকে খরচের খাতায় ফেলে দিয়েছে; কোনও সন্দেহ নেই। ভালোই তো। গভীর ভাবনায় মগ্ন হয়ে গেল নিলয়। সামনের লোকটা ঠোঁট নেড়ে-নেড়ে কী যেন বলে চলেছে! ও আর কিছু শুনতেই পাচ্ছে না। কোন ঘুমের অতলে তলিয়ে গেল আবার!
ফের যখন ঘুম ভাঙলো, তখন ওর অনেক খিদের অনুভূতি হলো। ঘরে কেউ নেই কিন্তু বুঝলো আশেপাশেই লোকজন আছে, কথাবার্তা ভেসে আসছে, পাশেই কোন এনজিও দের স্কুল চলছে মনে হয়, ছোট ছেলেপুলেদের সমস্বরে পড়ার শব্দ আর হৈচৈ কানে ভেসে আসছে। দরজাটা চাপানো, তার ফাঁক দিয়ে বাইরের আলো আসছে। একসাথে অনেক মানুষের কথা বলার আওয়াজ পেল।’ ২৭০০ টাকা রুম ভাড়া দেই। বিদ্যুৎ আর পানি ধইরে প্রায় চার হাজার টাকা খরচা পড়ে; এখেন থেকে সইরে গেলি কমপক্ষে ঘরভাড়া হবেনে পাঁচ হাজার, কুথায় পাবানে সেই টাকা? এত কম ভাড়ায় আর কোথাও থাকতি পারবানে? কুথায় যাবো আমরা? ঢাকায় না থাকতি পারলি মরতি হবেনে, দেশে তো কিছু নেই, খাবোডা কী?’ আরেকজনকে বলতে শুনলো,’ আমরা এনের ভোটার। দেশে কিছু নাই বিদায়, এনে এসে থাকি। আমগোরে উডাইয়া দিবো কইলেই হইবো?’
নিলয় বুঝলো এখানে থাকা নিয়ে এদের কোন সমস্যা চলছে–বস্তি উঠিয়ে দেবে বা এমন কিছু হবে হয়তো। যদিও বস্তি হলেও পরিবেশটা বেশ গোছানো। বস্তিতে থাকবে কখনও কল্পনাও করেনি, কিন্তু থাকতে গিয়ে দেখছে এখানকার পরিবেশ তার বাড়ির পরিবেশের চাইতে ভালো।
শরীরটা এখন বেশ ভালো লাগছে, কিন্তু কিছু খেতে পারলে মনে হয় আরো ভালো হতো। উঠে বসার চেষ্টা করতেই হাতে লেগে পাশে ঢেকে রাখা ম্যালামাইনের গ্লাসটা জোরে শব্দ করে নীচে পড়ে গেল। হন্তদন্ত হয়ে স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই ভেতরে ঢুকলো; মনে হয় তারা আশেপাশেই ছিল।
‘আরে আরে কী করেন? দাঁড়ান ভাই, আমি ধরি,’ বলে মনির এসে ধরলো তাকে। ‘যাক এখন আল্লাই দিলে আপনে ভালোমতো নড়াচড়া করতে পারতাছেন। আগে আপনের কিছু খাওন দরকার।‘ ইশারায় স্ত্রী-কে বলতেই, সে সাথে সাথে ঘরের এক কোনাতে গুছিয়ে রাখা খাবার তার জন্য বেড়ে দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।
নিলয় একা একাই উঠে বসতে পারলো। মনির তার পাশে বসে বললো, ‘আপনের ঘুমডা ভাইঙ্গা গেছে আমগো ক্যাচালের ঠেলায়। আর বইলেন না, বস্তিতে তো এমুনই চলে! আমগো উঠাইয়া দিতে চায় এইহানথন, সেইসব নিয়েই চিল্লাপাল্লা হগলতের। ভোটের সময় ন্যাতারা আমগো কাছে আইসা কত কথা বলে, এহন দ্যাহেন কেউ নাই আমগো পাশে।’
নিলয় চুপ করে শুনতে থাকে ছেলেটার কথা। মেয়েটা একটা প্লেটে সাদাভাত আর মুরগীর মাংস, একটু আলু ভর্তা, আর একটা বাটিতে পাতলা ডাল বেড়ে দিল খাটের ওপরেই একটা পেপার বিছিয়ে দিয়ে। মনিরের কথা শুনতে শুনতে বুভুক্ষের মতো খেতে থাকে সে। মনে হলো, যেন কতকাল পর এমন খাওয়া খেতে পারছে! এভাবে খেতে দেখে মনির তাকে কী ভাববে সেটা ভেবে ওর সাথে একটু কথাও চালানোর চেষ্টা করতে থাকে। জিজ্ঞাসা করে, ‘আপনার চলে কেমন করে? কী করেন?’ মনির যেন ওর সাথে কথা বলতেই চাইছিল। এ-কয়েকটা দিনে তো ওর সাথে ওদের তেমন কোনও কথাই হয়নি। মনির বলে চলে, ‘আমি গাঁও গেরামের পোলা–নানান তালে এইহানে আইসা পড়ছি। বেশি দৌড়ঝাঁপ ভালো লাগে না, তাই এই গুলশান লেকে নৌকা চালাই। গেরামেও এই কামই করতাম। এইডাই আমার ভালো লাগে। একা যা পাই তা দিয়ে চলে না। আমার বউ এই বস্তির মইদ্যে একটা রেসতোরা, মাইনে খাওনের দোকান চালায়। রান্ধনের হাত খুব ভালো, হগলতেই অনেক পছন্দ করে। দুইজনে মিললা চলে আর কি আমগো! বুঝলেন ভাই, এই কড়াইল খেয়াঘাট জানি রাজধানীর মইদ্যে এক টুকরা নদীতীরের গ্রাম। আপনি একদিন চাইলে আমার নৌকায় ঘুইরা আইতে পারেন।’ কথা বলতে বলতে মনির পানির গ্লাস এগিয়ে দেয়; ভাত তুলে দেয়। নাহ! মানুষের মধ্যে এখনও মনুষ্যত্ব যথেষ্টই আছে। পথের ধারে তাকে কুড়িয়ে পেয়ে, ঘরে নিজেরা না থেকে তার শোয়ার ব্যবস্থা করে দিয়ে, আবার তাকে ওষুধ-পথ্য দিয়ে সারিয়েও তুললো এই দুই দয়ালু মানব-মানবী। ভাবলে আশ্চর্যই লাগছে নিলয়ের। কিন্তু আর তো এদের বাড়ি দখল করে রাখা যায় না। তাড়াতাড়ি তাকে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে, ভাবলো নিলয়।
‘ভাই, আপনে বাড়িতে ফোন দেন। নিশ্চয়ই আপনার বাড়ির লোক খুবই চিন্তায় আছে।’
‘হ্যাঁ দেবো, কিন্তু কোনও নাম্বার মনে করতে পারছি না।’ মিথ্যা বললো নিলয়। বাসার সবার আর রোদশি’র নাম্বার তার মুখস্থ। ‘আমি উঠতে পারলেই বাড়িতে যাবো’–ছেলেটাকে যেন আশ্বস্ত করতে চাইলো সে। কিন্তু মনে মনে আসলে অন্যকিছু ভাবছে নিলয়। গভীর ভাবনায় সে আচ্ছন্ন। আজ-কালের মধ্যেই তাকে এই জায়গা ছেড়ে বাড়ি ফিরতে হবে। কিন্তু বাড়ি কি সে আদৌ ফিরবে–এই সিদ্ধান্ত নিতে হবে তাকে। ওই দিন ট্রাভেল এজেন্সি’র সাথে তার মোটামুটি ফাইনাল একটা কথা হয়েছিল সিংগাপুর যাওয়ার ব্যাপারে। আগামী মাসে সম্ভাব্য একটা তারিখও দিয়েছে। এখন খোঁজ নিতে হবে ওই বিল্ডিং-এর কী অবস্থা! আগুনে কতদূর ক্ষতি হয়েছে সবকিছু জানতে হবে। ট্রাভেল এজেন্সির-ই বা কী অবস্থা হলো চিন্তা করে ভেতরে ভেতরে অস্থির হয়ে ওঠে নিলয়। এখান থেকে তাড়াতাড়ি বের হয়ে সবকিছু জানতে হবে তাকে। তবে বাড়ির কাউকেই সে কিচ্ছু জানাতে চায় না এই মুহূর্তে; রোদশি-কেও না। রোদশি’র সাথে সম্পর্কের কোন ভবিষ্যৎ দেখতে পায় না সে! সামনে তার খুবই অনিশ্চিত জীবন। রোদশি’র জীবনটাকেও এত বড় অনিশ্চয়তার মধ্যে কীভাবে টেনে আনবে সে? আর তার পারিবারিক অবস্থা সবকিছু জেনে রোদশি যদি মুখ ফিরিয়ে নেয় সেটাও সে সহ্য করতে পারবে না কিছুতেই। তার আগে সে নিজেই বরং এই সম্পর্ক থেকে বের হয়ে যাবে–যদি কখনও জীবন তাকে সুখের দিন দেখায়, তবেই রোদশি-কে সে তার জীবনে জড়াবে, তার আগে নয়। সেই পথে এখন যেকোন দ্বিধা-দ্বন্ধ সবকিছু সে খড়কুটোর মতো উড়িয়ে দেবে!
খাওয়া-দাওয়া শেষে মনিরের বউ এর দেয়া মনিরের জন্যে রেখে দেয়া পরিষ্কার কাপড়চোপড় নিয়ে সে গোসল সেরে সাফ সুতরো হলো। একটা সিমেন্ট দেয়া ঘিরে রাখা জায়গাতে সবাই এখানে টিউবয়েলের পানি দিয়ে গোসল করে। মনে হচ্ছে তার দ্বিতীয় জন্ম হয়েছে, সবকিছুই নতুন মনে হচ্ছে। দশদিন কেটে গেছে, এখন সে পুরোই সুস্থ। আর অপেক্ষা করা চলে না। এখান থেকে বের হতেই হবে, নাহলে এরাও সন্দেহ করবে কেন সে বাড়ি যাওয়ার নাম নিচ্ছে না! এমনিতেও এখানে উৎসুক মানুষের অভাব নেই। সে বিছানায় শুয়ে শুয়ে খেয়াল করেছে বস্তির অনেকেই তার ব্যাপারে বাইরে মনিরের সাথে কথা বলছে বা খোঁজখবর নিয়েছে। ভেতরে এসে দেখেও গেছে; সে চোখ বুঁজে পড়ে থেকেছে, যাতে ওদের সাথে কথা বলতে না হয়। কাউকে কোনকিছু বলতে চায়নি সে।
খাওয়া, গোসল সেরে যাওয়ার জন্যে প্রস্তুত হলো নিলয়। মনির বললো, ‘ভাই, আপনেরে আমি নৌকায় ওই পারে দিয়া আসি চলেন।’ মনিরের হাসিখুশি বউটার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে খেয়াঘাটে এলো দু’জন। গুলশান লেকের ঘাটে বাঁধা সারি-সারি নৌকা দেখে অবাক হয়ে গেল নিলয়। এই এলাকায় কত কাজে কত-শতবার এসেছে–এখানে যে এমন একটা পরিবেশ আছে কখনও জানা হয়নি। লেকের পানি কুচকুচে কালো। নাক চেপেই নৌকায় উঠলো, আরও দু’তিনজন উঠে পড়লো ওদের সাথে। নৌকা ছেড়ে দিলে মনিরের সাথে কথা বলতে বলতে এগোলো। মনিরের কথা চলতেই থাকে–‘সময় ও খরচ বাঁচাইতে বস্তির লোকেরাই বেশী নৌকায় আসা যাওয়া করে। আবার শখ কইরাও নৌকা নিয়া গুলশান লেকে ঘুইরা বেড়ায় মেলা মানুষ। একশোর বেশি মাঝি আছি আমরা পারাপারের কাজে। আরো ২০-৩০ জন ছুডো পুলাপাইন হাতড়ানি দেয় আমগো লগে। সকাল আর সন্ধ্যায় ভিড় লাইগাই থাকে। অন্যসময় একটু কম। পারাপার চলে এক্কেরে মইদ্য-রাত পর্যন্ত। নৌকা আছে দশ বারোডার মতো। তবে আমরা এগুলো চুক্তিতে ভাড়ায় চালাই। মালিককে ১৫০ টাকা দেওন লাগে। প্রতিদিন হাজার হাজার লোক পারাপার করলেও পুরা দিনের জইন্যে নৌকা জুটে না আমগো কপালে–হেইসম অলস বইসা কাটাই, নয়তো অন্য কাম কাজের ধান্ধা করি আর কী!’
মনিরের কথা শুনতে শুনতে এক বৃদ্ধ মতো লোক বলে ওঠেন, ‘চব্বিশ-পঁচিশ বছর আগে আমরা তখন যুবা, সরকারি জমির এই নিচু জায়গার জংগল পরিষ্কার কইরা এই বস্তি গইড়া উঠছে। আইজকা সেইখানে প্রায় পঁচিশ-ত্রিশ হাজারের মতো লোকের বাস। তহন থেইকাই এইহানে গুলশান লেক পারাপারের জন্য শুরু হয় নৌকার চলাচল। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়া মানুষ বাড়ছে। যাত্রী বাড়ছে, নৌকাও বাড়ছে, দেশে চোখের সামনে কত পরিবত্তনই না অইলো কিন্তু আমগো অবস্থার কোন পরিবত্তন অইলোনাগো।’ নিলয় মনোযোগ দিয়ে ওদের কথা শুনতে থাকে। এই জায়গার উচ্ছেদ নিয়ে পেপারে আগে অনেক কিছু পড়লেও নিজের কোনও বাস্তব অভিজ্ঞতা ছিল না। নিলয় ভাবে, রাজধানীর দরিদ্র-মানুষ, দিনমজুর, ড্রাইভার, গার্মেন্টস শ্রমিক, গৃহপরিচারিকা, রিকশাওয়ালা–এইসব খেটে খাওয়া মানুষগুলোর বসবাস এই বস্তিতে। গুলশান, বনানীর মতো অভিজাত এলাকার খুব কাছে বাস করেও ওদের জীবন শতচ্ছিন্ন, দারিদ্র্যক্লিষ্ট। অথচ এখান থেকে শুধু লেকটা পার হলেই সেই বড়লোকদের পাড়া, যেখানে উপচে পড়ে তাদের বিলাসিতার নহর। অন্যদিকে বন্যা-খরা-জলোচ্ছ্বাস আর নদীভাঙনে সর্বশান্ত হয়ে গ্রাম থেকে বাপ-দাদার ভিটেমাটি ছেড়ে এই বস্তিতে ঠাঁই নেয়া মানুষগুলো অনাহারে-অর্ধাহারে কোনও রকমে তাদের জীবনের চাকা ঘুরিয়ে চলে। রাতদিনের হাড়ভাঙা খাটুনিও তাদের ভাগ্যলিপি পাল্টাতে পারে না। নিলয় বিষণ্ণতার সাগরে তলিয়ে যেতে যেতে ভাবে, ‘আলোর নিচে যেন সবসময়ই কেন এত অন্ধকার!’
নৌকায় মাত্র দশ মিনিটেই পৌছে গেল সড়কে। নৌকা থেকে নেমে মনির একটু ইতস্তত করে তার শার্টের পকেট থেকে একশো টাকার দুটো নোট বের করে বাড়িয়ে দেয় নিলয়ের দিকে, যেন সে বাড়ি ফিরতে পারে। নিলয় একটু হতভম্ব হয়ে একপলক তাকিয়ে থাকে তারই বয়েসী তরুণ ছেলেটার মুখের দিকে। গভীর আবেগে মনিরকে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘আপনাদের কথা কখনও ভুলবো না।’ মনিরকে ছেড়ে সামনে এগিয়ে যেতে-যেতে নিলয় ভাবে, সত্যি এই মানবিকতার গল্প আজীবন মনে থাকবে তার। যেখানে নিজের বাড়িতে ২০০ টাকা প্রয়োজনে চাইতে গেলে একশোটা কথা শুনতে হয়; সেখানে কোথাকার কোন্ অপরিচিত গরীব এক মানুষ তার হাতে অনায়াসে দুশো টাকা তুলে দেয়, যার হয়তো নিজেরই দিন চলে কতই না কায়ক্লেশে! হাঁটতে হাঁটতে বনানী লেকের কাছে গিয়ে ব্রীজের গায়ে হেলান দিয়ে খানিকক্ষণ দাঁড়ায় নিলয়। কী করবে একটু ঠিক করতে হবে। প্রথমে পোড়া বিল্ডিংটার কাছে গিয়ে ট্রাভেল এজেন্সি’র কী অবস্থা সেটা খোঁজ নেয়াটা জরুরি। যা ভাবা সেই কাজ। সাথে সাথে ওই দিকেই হেঁটে রওনা দিল। ২০০ টাকাটা আপাতত যক্ষের ধনের মতো বাঁচিয়ে রাখতে হবে।
বাড়িতে বা তার কাজের জায়গা, কোনও জায়গাতেই সে আর সম্ভবত বেঁচে নেই; সুতরাং এই মুহূর্তে কোনও দিক থেকে তার টাকা পাবারও সম্ভাবনা নেই। যেকোন মূল্যে তার ট্রাভেল এজেন্সি’র ছেলেটাকে বা ওদের যে কাউকে খুঁজে বের করতে হবে–তার এতদিনের কুড়িয়ে-কাড়িয়ে জমানো টাকাটা তো ওখানেই দেয়া। ওটা যদি কোনভাবে আর না হয় আবার তাকে সেই পুরনো ছেঁচড়ে চলা জীবনে ফিরে যেতে হবে। আবার সেই নরকসম প্রতীক্ষা, কোনও এক সুযোগের। নাহ! নিলয়ের সেই ধৈর্য আর নেই। যা করার এখুনি তাকে করতে হবে; ভাবতে ভাবতে পোড়া বিল্ডিংটার সামনে এসে দাঁড়ালো। আগুনে-পোড়া দগ্দগে ক্ষত এখনও গোটা বিল্ডিংটার সারা শরীরে! লোকজনের ভীড় অনেক। সবাই যার যার ক্ষতিগ্রস্ত অফিস বা কাজের জায়গা মেরামত করার চেষ্টা শুরু করেছে। তিন তলায় এজেন্সি’র অফিসটা ছিল । নিলয়ের বুক ঢিপ ঢিপ করতে লাগলো। কী যে দেখবে উপরে গিয়ে! দরজার সামনে যেতেই ভেতরে অনেক মানুষের গলা শুনতে পেল। ‘যাক! লোকজন আছে তাহলে’, ভাবলো সে।
ট্রাভেল এজেন্সি’র ভেতরে ঢুকে পরিচিত একজনের সাথে দেখা হতেই সে বিস্ফারিত চোখে তার দিকে তাকিয়ে রইলো! একটু ধাতস্থ হয়ে অস্ফুটে বলে উঠলো, ‘আপনি বেঁচে আছেন! আমরা তো ধরে নিয়েছি…’ কথা শেষ করতে পারলো না। নিলয় কাষ্ঠ-হাসি হেসে বললো, ‘হ্যাঁ, এইযাত্রা পার পেয়ে গেছি রে ভাই।’ সংক্ষেপে সে তাকে জানালো কী ঘটেছে। আজাদের কথা জানতে চাইলে সে বললো, ‘আজাদ ভাই দৌড়ে নিচে নামতে পেরেছিল। পরে আপনাকে অনেক খুঁজেছে, কিন্তু কোন চিহ্নও তো পাওয়া যায়নি। আপনাকে ফোন করেছি, কোনও সাড়া পাইনি। আমাদের অফিসের খুব বেশি ক্ষতি হয়নি। আপনার কাগজপত্র ঘেঁটে নাম্বার নিয়ে বাসায় খবর দেয়া হয়েছিল, আপনার বাবা আর ভাই এসে সব শুনে অনেক কান্নাকাটি করে ফিরে গেছেন। দাঁড়ান আজাদ ভাইকে ডাকি।’
ভেতরে গিয়ে সে খবর দিতেই আজাদসহ হুড়মুড় করে কয়েকজন আসলো তাকে দেখতে। আজাদ একেবারে জড়িয়ে ধরলো! ‘কী বাঁচা যে বেঁচে গেছি সবাই, আপনার আশা তো ছেড়েই দিয়েছিলাম! উফফ্!’ প্রাথমিক বিস্ময়টা কেটে যেতেই নিলয় আজাদকে তার যাওয়ার ব্যাপারটা জিজ্ঞাসা করে। আজাদ বলে, ‘আজকে থেকেই আবার আপনার ফাইল মুভ করবো, চিন্তা করবেন না। আমরাও খুব দ্রুত কাজ করছি–কারণ আমাদেরও ক্লায়েন্টদের কাছ থেকে টাকা দরকার। বেশকিছু ক্ষতি হয়ে গেছে, সেসব রিকভার করতে হবে। আর আপনার তো টাকা-পয়সা সব দেয়াই আছে মোটামুটি, অল্প কিছু যা বাকি আছে, ওখানে গিয়ে কাজ করে আপনি শোধ করে দেবেন তাড়াতাড়ি। এখন শুধু যাওয়ার অপেক্ষা!’ নিলয় একটু ইতস্তত করে আজাদকে বললো, ‘বেশি কিছু জানতে চেয়েন না ভাই। কিন্তু যাওয়া পর্যন্ত আপনার পরিচিত কোথাও কি আমার থাকার একটু ব্যবস্থা করা যায়?’ আজাদ অবাক হয়ে বললো, ‘আমি তো এই কাছেই একটা মেসে থাকি, চাইলে ওখানে আপনি থাকতে পারেন।’
তারপর দশটা বছর কেটে গেছে! সিঙ্গাপুর ন্যাশনাল লাইব্রেরির ওটিসি ক্যাফের উইন্ডো সাইডে একা বসে, জানালা দিয়ে বাইরের সবুজ গালিচায় স্থিরচোখে তাকিয়ে, আইসড্ কফিতে একটা চুমুক দিল নিলয়। টিং করে একটা মেসেজ এলো হোয়াটস অ্যাপে–মারিয়ার লাভ সাইন আর চুমুর ইমো–সাথে লেখা ’অন দ্য ওয়ে টু ইউ’। মারিয়ার জন্যে অপেক্ষা করতে করতে ভাবলো জীবন তাকে কোথা থেকে কোথায় এনে ফেলেছে! কখনও কখনও জীবনের গল্প রূপকথাকেও হার মানায় বৈকি!
সেদিন আজাদের সাহায্য ছাড়া নিলয় কী করতো সে জানে না। নিজের মেসে নিয়ে গিয়ে পরবর্তী প্রায় একমাস তার থাকার জন্যে আজাদ যা যা করার সবই করেছিল। নিলয় শুধু প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে, সে সিঙ্গাপুর গিয়ে কাজ করে তার ঋণ পরিশোধ করে দেবে। তবে যা সে শোধ দিতে পারবে না কখনও তা হলো–এই উপকারের প্রতিদান, প্রায় অপরিচিত এক মানুষের জন্য।
ওই একমাস সে চোখ বুঁজে চোরের মতো নিজের শহরে কাটিয়েছে কাউকে কোনও খবর না দিয়ে। দরকার ছাড়া এক পা-ও যায়নি কোথাও। সবার কাছে সে মৃত! শুধু রাতের বেলা লেক-এর পাড়ে গিয়ে শূন্য চোখে তাকিয়ে অনেকক্ষণ ধরে বসে থাকতো ধ্যানমগ্ন মুনির মতো। লেকের পাড়ের নৌকাগুলোর আসা-যাওয়া দেখতে দেখতে মনে মনে প্রিয় কবিতাগুলো আওড়ে যেত। রোদশি’র সাথে কাটানো সময়গুলোর কথা মনে পড়তো ভীষণ। দু’জনের খুনসুঁটি, পাগলামি আর কবিতা নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা মেতে থাকার স্মৃতিগুলো তাকে পাগল করে তুলতো। মনে হতো রোদশি-কে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে বলে,
“যদি যেতে হয়, যেতে তো হবেই, তবু এই যাবার প্রসঙ্গ
এত দূরের ও অন্য কারও মনে হয় যে,
তোমাকে এবারের মত বিদায় দিলেও, আশা হয়,
একজীবন শেষে আবার তুমি ফিরে আসবে
এবং আবার একটি জীবনের ভেতর বেজে উঠবে-
আমাদের তুমুল মৃদঙ্গ-“
কী অদ্ভুত একটা মাসই না তার জীবনে কেটেছে তখন! অনেকবার ইচ্ছা হয়েছে বাড়িতে ফোন করার বা রোদশি’র সাথে কথা বলতে। যে মেয়েটা তাকে দু’দিন দেখতে না পারলে অস্থির হয়ে যায়, সে কীভাবে তার মৃত্যুকে মেনে নিয়েছে সেটা তার খুব জানতে ইচ্ছা হয়। তাকে ছাড়া কেমন আছে রোদশি জানার জন্যে মন ছুটে যেতে চায় ওর কাছে; কিন্তু নিজেকে কঠিন ব্রতে বেঁধেছে নিলয়, কিছুতেই তাকে সে ভাঙতে দেবে না এবার। অবশেষে সেই কাঙ্ক্ষিত দিনটা এসেছিল তার জীবনে, সিঙ্গাপুরের উদ্দেশে যাত্রা করেছিল সে। খুব অল্প বেতনে কাজ করা বাংলাদেশি শ্রমিকদের সাথে ভেসে এলো এই দেশে, এক কনস্ট্রাকশন কোম্পানির শ্রমিক হিসাবে।
প্রথমে কোনও কিছুই সহজ ছিল না এখানে। দেশে থাকতে জীবন কঠিন ছিল, কিন্তু এখানে শ্রমিকের জীবন কঠিনতর। প্রথম তিন চার বছর দাঁতে দাঁত চেপে কোনদিকে না তাকিয়ে উদয়াস্ত হাড়ভাঙা পরিশ্রম করেছে। দিনপ্রতি বিশ সিঙ্গাপুর ডলারে কাজ করতো। বাড়তি কাজ করে আরও কিছুটা আয়–মাসে একদিন মাত্র ছুটি–এভাবে কাজ করে আগে এজেন্টের ঋণ শোধ করেছিল, সেই সাথে আজাদের ঋণও। কাজের প্রতি অপরিসীম নিষ্ঠা দেখে তার সুপারভাইজর তাকে আস্তে-আস্তে আরও ভালো কাজ দিয়েছে, সেইসাথে বেড়েছে বেতন। আজ যখন পেছন ফিরে দিনগুলোর দিকে তাকিয়ে নিলয় ভাবে, কী কঠিন ছিল জীবনের ছুঁড়ে দেয়া চ্যালেন্জগুলো তার জন্য! একটু একটু করে এখানে মাটি কামড়ে পড়ে থেকে জীবনটা গুছিয়েছে নিলয়। হ্যাঁ, পেরেছে সে–কিন্তু অনেক বড় মূল্য দিতে হয়েছে।
এখানে আসার চার বছর পরে, সে তার বাড়ির সাথে যোগাযোগ করেছিল। ততদিনে বাবা আর নেই; বড়ভাই সংসারের হাল ধরেছে, কিন্তু খুব ভালো কোনও চাকরি পায়নি। সেই একই টেনেটুনে সংসার চলছে ওদের। বোনটা আর কিছুদিন পরেই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হবে। অসুস্থ মা ফোনে নিলয়ের গলা শুনে একটুর জন্যে হার্টফেল করেননি। নিলয় এখন তার মায়ের ভার নিতে পেরেছে, সাধ্যমতো সংসারের শ্রী ফেরাতে চেষ্টা করেছে। এক বন্ধুর কাছে ফোন করে রোদশি’র খবর নিয়েছিল–যা শুনেছিল তাতে বুক ভেঙে গিয়েছিল; নিলয়ের নিঁখোজ হওয়ার পর বছরখানেক অপ্রকৃতিস্থ ছিল রোদশি, অনেকদিন চিকিৎসার পর সুস্থ হয়। তারও বেশ পরে বিয়ে হয়েছে, এখন আর কোনও খবর জানে না। নিলয়ের মনে হলো এই খবর সে না জানলেই ভালো ছিল। কী লাভ হৃদয় খুঁড়ে আর বেদনা জাগিয়ে!’ জীবনে সবকিছু তো একসাথে পাওয়া যায় না। কিছু পেতে গেলে কিছু ছেড়ে আসতেও হয়; একথা সে জানে, আর মানেও। এদেশে আসার পর থেকেই শুধু কাজ আর কাজের মধ্যে ডুবে যেতে-যেতে কখনও কখনও তীব্র একাকীত্বে পাগল হয়ে যেতো নিলয়। জীবনে কোনও প্রিয় রোদশি ছিল না পাশে। প্রিয় কবিতা-সাহিত্য সব হারিয়ে ফেলেছিল। বুকের ভেতরে সারাক্ষণ হাহাকার করা এক শূন্যতা। নিজের মনে বিড়বিড়
করতো, “হে আমার দুঃখ,তুমি প্রাজ্ঞ হও, স্থৈর্য নাও শিখে।’
তখন থেকেই আবার ডায়েরি লিখতে শুরু করলো নিলয়। ডায়েরি হয়ে উঠলো তার পরম বন্ধু। প্রথম প্রথম নিজের কষ্ট নিয়ে হৃদয় তোলপাড় করা লেখালিখি চললো বেশ কিছুদিন। আস্তে আস্তে ডায়েরি’র পাতা ভরে উঠতে থাকলো প্রতিদিনের কাজের বিভিন্ন বিষয়ের খুঁটিনাটি সব বর্ণনায়। বহু মানুষের সাথে কাজ করতে করতে পরিচয় হয়েছে এই সময় গুলোতে। তাদের সাথে মিশতে গিয়ে দেখেছে প্রত্যেকের জীবনে আছে নানান বঞ্চনা ও কষ্টের গল্প। একজন অভিবাসী শ্রমিক হিসাবে, নতুন একটা দেশে তার অভিজ্ঞতার কথা সে প্রতিদিন লিখতে শুরু করলো। কাজের সাথে সাথে মন-প্রাণ ঢেলে দিল লেখালিখিতে। পাশাপাশি মনের শান্তির জন্য লিখতো কবিতা–ডুবে যেতে চাইতো প্রিয় কবিদের লেখায়;
“আমি যেন অভিশপ্ত, নিঃস্ব চিত্রকর;
পট নেই, শুধু ছায়ার উপর বুলোই তুলি,
রেঁধে খাই নিজ হৃৎপিণ্ডেরই তন্তুগুলি,
আর কোন ভোজ নেই এ-খিন্ন বুভুক্ষার।”
লেখার জন্য সময় বের করা অত্যন্ত কঠিন হলেও লেখা কখনও বন্ধ করেনি নিলয়। মাঝে মাঝে রাতে বারো ঘণ্টার শিফটে কাজ করেও লেখালিখি চালিয়ে গেছে। এমনকি কখনও কম্যুটারে করে কাজে যাওয়া-আসার সময়টাও নষ্ট করেনি–লিখে গেছে–আর সেইসাথে নিজের ফেসবুক পেজেও নিয়মিত অভিবাসী শ্রমিকদের জীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে সে লেখা প্রকাশ করতে থাকে।
এই সময়েই স্থানীয় এক বাংলা পত্রিকা, ‘দৈনিক বাংলার মুখ’ (মূলত শ্রমিক অভিবাসীরাই যার মূল পাঠক) তাদের পত্রিকায় লেখা আহবান করে; আর সেখানে নিলয় তার একটা কবিতা পাঠায়। পত্রিকার সম্পাদক মৃণাল-দা তার কবিতা খুবই পছন্দ ক’রে তাকে নিয়মিত লেখা দিতে বলেন। এখানে নিয়মিত কবিতা ছাপার পাশাপাশি ‘অভিবাসীর গল্প’ নামে তার একটা কলামও লিখতে শুরু করে নিলয়; যেখানে নিজের ও প্রবাসী সহকর্মীদের প্রবাসের জীবন-যাপন ও কাজের নানারকম অভিজ্ঞতাগুলো সে লিখে যেতে লাগলো। স্থানীয় বাঙালি-মহলে লেখাগুলো সবার নজর কেড়ে নেয়, আর ব্যাপক প্রশংসিত হওয়াতে নিলয় আরো বেশি উদ্দীপিত হয়ে ওঠে। লেখাগুলো সংখ্যায় যখন বেশি হয়ে গেল, সে ভাবলো বই আকারে বের করতে পারে। আর যদি ইংরেজিতে অনুবাদ করে, তাহলে আরও অনেক মানুষের কাছে তার লেখাগুলো পৌঁছবে। ধীরে ধীরে সেটার জন্যেই প্রস্তুতি চলতে থাকে তার। এর মধ্যেই আরো চমকপ্রদ একটা ঘটনা ঘটে যায়। ‘কবিতা ও ছোটগল্প’ নামে একটা প্রতিযোগিতায় নিলয় অংশগ্রহণ ক’রে বসে; যেটা অভিবাসী শ্রমিকদের জন্য অনুষ্ঠিত হতো। আর মূলত এই অনুষ্ঠানই তাকে স্থানীয় সাহিত্য মহলের সাথে সব ধরনের যোগাযোগ ঘটিয়ে দেয়, এবং ঠিক সেই সময়েই মারিয়া চেয়েছিল তার সাক্ষাৎকার নিতে।
দূরে পরিচিত একহারা গড়নের শরীরটা এগিয়ে আসছে দেখতে পেল। একটা নীল লংস্কার্ট আর খুবই হালকা গোলাপি রঙের একটা শার্ট পরেছে মারিয়া। আজ ওরা ওদের জীবনের খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা সিদ্ধান্ত এখানে বসে নিতে যাচ্ছে।
হঠাৎ একদিন একটা অপরিচিত নাম্বার থেকে তার কাছে ফোন এসেছিল। “আমি ‘সাপ্তাহিক বাংলার কথা’ থেকে মারিয়া বারি বলছি। আপনার একটা সাক্ষাৎকার নিতে চাই।” নিলয় বিস্মিত হয়েছিল! লেখালিখি করে একটু-আধটু পরিচিতি বাড়ছিল, কিন্তু তার সাক্ষাৎকার নিতে চলে আসবে এতবড় একটা নামকরা পত্রিকা থেকে! ঠিক এই জায়গাতে বসে ঘণ্টা দুই ধরে নিলয়ের জীবনের অনেক গল্প শুনেছিল সেদিন মারিয়া; এখানে উঠতি প্রতিশ্রুতিশীল সাংবাদিকদের মধ্যে খুবই পরিচিত মুখ, সারাক্ষণ নানা কাজ নিয়ে মেতে আছে উদ্যমী মেয়েটা।
‘বলা হয় অভিবাসীরাই সিংগাপুর শহরটাকে গড়ে তুলেছে, কিন্তু তাদেরকে কখনও শহরের মূল অংশ বলে মনে করা হয় না। তাই আমার লেখার মূল উদ্দেশ্য ছিল শ্রমিক অভিবাসীরা দেশে তাদের পরিবার-প্রিয়জনদের ফেলে রেখে, এই শহরটাকে গড়ে তুলতে গিয়ে নিজেরা এখানে কীভাবে জীবন কাটায়–কী কী সমস্যায় পড়ে, বা তাদের জীবনের কষ্টগুলো সবাইকে জানানো।’ দীর্ঘ সাক্ষাৎকার শেষে মারিয়াকে বলেছিল নিলয়।
নিলয়ের ব্যক্তিত্ব আকৃষ্ট করেছিল মারিয়াকে। সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনির পর ঘরে ফিরে যে মানুষ এমন করে কবিতা লিখতে পারে, অন্য মানুষের জীবনের কষ্ট নিয়ে লেখালিখি চালিয়ে যেতে পারে, তেমন একজন মানুষকে পছন্দ না করে পারা যায়! খুব যত্ন করে একটা বড় স্টোরি করেছিল মারিয়া নিলয়কে নিয়ে; যা স্থানীয় মহলে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল।
ঠিক এই সময়েই একজন প্রকাশকের কাছ থেকে লেখা পাঠানোর আমন্ত্রণ পায় নিলয় এবং তার বই বের করার স্বপ্নের দিকে আরো কয়েক ধাপ এগিয়ে যায়। যদিও সেই সময়টাতে কাজের পাশাপাশি এগুলোর পেছনে সময় দেয়া ভীষণ কঠিন ছিল তার জন্য। গড়ে ৩/৪ ঘন্টার বেশি ঘুম হতো না রাতে; সারাক্ষণ এই চিন্তায় অস্থির থাকতো যে, বই বের করা বা লেখা নিয়ে তার এই স্বপ্ন পূরণ হবে কিনা আদৌ! আসলেই এগুলো আলোর মুখ দেখবে কিনা! মারিয়া’র সাথেও একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরী হচ্ছিলো, বা বলা যায় একটু একটু করে দু’জন দু’জনকে জানছিল।
সত্যি সত্যি বই বের হলো–‘আনটোল্ড স্টোরিজ’–তার ‘অভিবাসীর গল্প’-এর ইংরেজি অনুবাদ। সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল লাইব্রেরি বিল্ডিং-এ তার বই-এর প্রকাশনা অনুষ্ঠান হলো; যেখানে বসে হাড়ভাঙা খাটুনির পর ছুটিরদিনে বন্ধুদের সাথে সিঙ্গাপুরের অপূর্ব প্যানারমিক দৃশ্য দেখতে দেখতে কতই না আড্ডা দিয়েছে, মন খারাপ হলে সেখানে এসে বই এর মধ্যে ডুবে থেকেছে। প্রকাশনা অনুষ্ঠানে ডিসপ্লেতে রাখা তার সব বই-এর কপি বিক্রি হয়ে গেল। পাঠকেরা নিলয়ের সাথে ছবি তোলা আর অটোগ্রাফ নেয়ার জন্য উৎসুক হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। এখানকার সাহিত্য অনুষ্ঠানগুলোতে এখন নিলয়ের নিয়মিত উপস্থিতি থাকে। তার বই সিঙ্গাপুরের সব বড় বড় বই-এর দোকানের শোভা বাড়াচ্ছে। এ-বছরই সিঙ্গাপুরে তার বই বেস্ট নন-ফিকশন পুরস্কার পেয়েছে, যা কোনও অভিবাসীর জন্য খুবই গর্বের ব্যাপার।
নিলয় ইন্টারনেটে দেখে দেশের বড় বড় পত্রিকায় তার খবরটা গুরুত্ব দিয়ে ছাপা হয়েছে। সবচেয়ে বড় ঘটনা যেটা হয়েছে সেটা হলো, তার তুলে ধরা সমস্যাগুলোর দিকে কোম্পানিগুলো মনোযোগ দিয়েছে। এখন সে এমন একটা অবস্থানে আছে যে, অভিবাসীদের সেই সমস্যগুলোর সমাধানে তার মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। একটা প্রকাশিত বই এবং তার কারণে খুবই মূল্যবান এক পুরস্কার তার জীবনটাই পাল্টে দিয়েছে কোনও সন্দেহ নেই। সাধারণ এক অভিবাসী শ্রমিক থেকে সে এখন একজন মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কারের অধিকারী লেখকে পরিণত হয়েছে।
কাছে এসে নীল রঙের পার্সটা টেবিলে এক হাতে রেখে, একটু হেসে আর-এক হাতে ধরা একগুচ্ছ লালগোলাপ মারিয়া নিলয়ের হাতে দিয়ে, গালে একটা আলতো চুমু দিয়ে বললো, ‘অনেকক্ষণ এসেছো? একটু দেরি হয়ে গেল!’ নিলয় বললো, ভালোই হয়েছে দেরি করেছো। আমি এখানে বসে ঠিক দু’বছর আগে তোমাকে যে দীর্ঘ সাক্ষাৎকার দিয়েছিলাম, সেটার কথাই মনে করছিলাম। আমাদের প্রথম দেখা হয়েছিল এখানে। তাই এই জায়গাটাই আজকে বেছে নিলাম আরও স্মরণীয় করে রাখার জন্য।’
জীবন তার নিজস্ব গতিতেই চলে। জীবনের অপ্রাপ্তির জায়গাগুলো মারিয়ার সাথে অন্যভাবে ভরে উঠেছে। নিলয় তার এই সাফল্য উপভোগ করে। অনেক কিছুর বিনিময়ে আজ তার এই সফলতা; যাকে পেতে গিয়ে চলে গেছে তার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় আর তার ভালোবাসার মানুষ। রোদশি’র জন্যে হাহাকার আর না-পাওয়ার বেদনা আছে জীবনে। কোথায় যেন পড়েছিল, মানুষের স্বভাবই হচ্ছে ইচ্ছে করে হারিয়ে ফেলা জিনিস আবার হাতড়ে বেড়ানো।
মাঝে মাঝে বুকের খুব গোপন একটা কুঠুরি খুলে রোদশি’র মুখোমুখি হয় সে। কথা বলে ওর সাথে। ওকে বলে, ‘হায়, সব অঙ্গীকার,গন্ধ, আর অনন্ত চুম্বন! অগম্য গহ্বর থেকে আবার কি জন্ম নেবে তারা!’
তারপর আবার সেই কুঠুরিটা সযত্নে বন্ধ করে বুকের মধ্যে লুকিয়ে রাখে। একজীবনে সব কুঠুরিতে বাস করা হয় না মানুষের! আর জীবন তো এমনই!