মঙ্গলবার, ১৩ জুলাই ২০২১, ০১:০৩ পূর্বাহ্ন
শিশির আজম-এর কবিতা
আমরা এক বিশাল সমুদ্রজাতি
আমরা এক বিশাল সমুদ্রজাতি, এ কেউ অস্বীকার করে না। সমুদ্রের ফেনায় নির্মিত আমাদের সত্তা।
হ্যাঁ, আমাদের ডানাই আমাদের সত্তা। হাজার হাজার বছর আমরা ভেসে চলেছি। কখনো হারিয়ে এসেছি আমাদের ডানা গভীর সমুদ্রখাতে, সবুজ শৈবালে মিশে তা আরও উজ্জ্বল।
আমাদের সন্তানগণ সমুদ্রের ফেনার উচ্ছাস। তাদের আছে পাখির ডানা; অপরাধ করবার সাহস, মানুষের ভিতরের অবাধ কুয়াশায় সন্তরণস্পৃহা। গাছকে কী শাস্তি দেব ?
বলতে পার আমরা ভুলের সমাহার, রূপকথার অরণ্য। হ্যাঁ, সত্যি। আমাদের ভাষা, আমাদের গান, আমাদের পার্বণ–রূপকথার সমাহার। আমরা তা সত্যি করেছি।
আমাদের নারীরা আমাদের আকাশ। কত কুয়াশা আসে, ঝড় আসে। নারীরা নক্ষত্রদের ডেকে এনে বসিয়ে দেয় শিশুদের কপালে। তখন শুরু হয় নবান্ন।
আমরা এক বিশাল সমুদ্রজাতি। ফিনিসীয় যুবাটি আমাদের সব গল্পই জানে। সে শুনেছে তার মায়ের কাছ থেকে। নির্জন প্রতিটি সত্তা, গাঁথা একই সুতোয়।
স্বীকার করতে হবে, বারবার আমরা পথ হারিয়েছি; বারবার খুঁজে নিয়েছি পথ। দৈত্যদের দেশ থেকে সাত ভাই চম্পা উদ্ধার করেছে বোন পারুলকে।
আমরা এক বিশাল সমুদ্রজাতি। আমাদের মাথার উপর বিশাল আকাশ। তাকে পালাক্রমে পাহারা দেয় সূর্য আর চাঁদ।
আলপিন
আলপিন আমাকে বলে ভালবাসতে
অশুদ্ধ এই জগৎকে
এই জগৎ অশুদ্ধ
আবৃত দরজাগুলো আগুনের গণ্ডিতে ধ্রুবতারা
আলপিন ভাবে আমি একটা গাছ
আগুনের শিরা-উপশিরাগুলোর ভিতর
আমি ভাবি আমি যদি হতে পারতাম আলপিন
আলপিনের ভিতর নির্জন সূর্যের পর্বত
আমার বাবা বুকে গেঁথে রাখতেন আলপিন
বাবার বাবাও
নিস্তব্ধ গুঞ্জনময় রাতের মতো ধারালো
আর ছোট ছোট অধৈর্য পাথরে বিরাট বিরাট খাদ
তুমি কী পার আলপিন
বুকের ভিতর ক্ষত তৈরী করা ছাড়া
সবাই ক্ষত দেখতে পায় বুকের ওপর
তোমাকে দেখে না
ছায়ার সীমান্ত ছায়ার পাখি
তুমি বললে সহজ এই ছায়াটুকু যেন আমি হারিয়ে না ফেলি। হয়তো এসবের কোন মূল্যই নেই, এই অহংকারের। কেবল ঘৃণা, কেবল অস্বীকার। একটা পাকা পেয়ারার ভিতর কতগুলো বিচি আছে এ তুমি অল্প মেহনতেই গুনে ফেলতে পার; যদি না অসাবধানে খেয়ে ফেল দু’একটা। এতে অবশ্য তোমার কোন দোষ নেই। একেকটা বিচি কোনও অজানা দেশ থেকে, কয়েক মুহূর্তের জন্য এসেছে; আমাদের এই পেয়ারার ভিতর, শীর্ণ-পেট পাখির মতো।
মগজের মাঝ বরাবর সীমান্ত। পেরিয়ে যাচ্ছে আসছে ছোট ছোট পাখি। আর আমি এক কৃত্রিম গ্রহের অভ্যন্তরে ওজনহীন। কিন্তু আমার রযেছে স্মৃতি; পাথরের মতো। সমুদ্রে জন্ম আর উপত্যকা জুড়ে বিধি ও দায়দায়িত্বের আকর। সব তারা-ই ঘুমায় না; আমাদের পাহারা দেয়। আমাদের শেষ মাংসপিণ্ড পর্যন্ত গলতে থাকে আগুনের শিখা হয়ে, মৃত্যুকে সরিয়ে।
ভয় পেয়েছিলে, বনজোনাকির অন্ধকারে যদি পৃথিবী ঝুঁকে পড়ে ভারসাম্যহীনতায়। যদি শিকার থেকে ফিরে আসে সেই জেলেরা, যারা জন্ম নিয়েছে হাঙরের চোয়াল থেকে।
জানালার প্রাচীন ছত্রাকে বিচিত্র রঙের রোদ ভ্রূণ-হস্তশিল্প। তবে সত্যি বললে বলতে হবে, এটা বিমূর্ত। আমি বলছি সেই শিশুর কথা, যে আছে এক নারীর ভিতর; যে-নারী এসেছে বিশাল এক সমুদ্রজাতির ভিতর সাঁতার দিয়ে।
আর দেখ কঙ্কালের শাখা-প্রশাখায় বায়ু ঘুরে ঘুরে ঝুপ্ করে ঘাসে দিয়েছে লাফ; ছায়ার সঙ্গে, বিশাল সবুজের নক্ষত্রপুঞ্জে। এখন সময় মেলানো যাবে না–কারণ ঘড়ির কাঁটাগুলো অবাস্তব। মানুষকে জড়িয়ে রাখে সুদৃশ্য গোলকধাঁধায়। কথিত স্বল্পমূল্যের প্রবণতাগুলো হয়তো আরেকটু মনোযোগ পেতে পারতো।
মনে রাখতে হবে আজ আমরা যে এখানে এসেছি, এ কিন্তু ভালবাসার কারণে। ভালবাসায় কাঁটাও আছে। সময় একটা পিরামিড, এ-সৃষ্টির দায়দায়িত্ব আমাদের সবার, হয়তো কোনও সুড়ঙ্গ রয়েছে, যেখানে নির্জন দুটো পালক লিখে চলেছে নীলচোখ আর অবিশ্বাসের কাহিনী।
শেষ রাতের দিকে আমি ট্রেনের ভিতর শাখা-প্রশাখায় ভাগ হয়ে যাচ্ছি, হয়ে উঠছি গাছ। গাছের ছায়া থাকবে, পাখি থাকবে; যেন আমরা জড়িয়ে-কুড়িয়ে ধাবিত হই সূর্যের সরু আগুনের দিকে।
ছেলেমেয়েরা প্রেমে পড়ে
আমরা চাই ওরা বাঁচুক। ওরা যদি বাঁচতেই চায়, তাহলে ওদের মুঠো যেন বন্ধ থাকে–রাস্তায় গাছ আর কুচি কুচি পাথরের চিৎকার।
রাতের অনেকগুলো স্তর, সেখানে কোথাও সূর্য ওঁৎ পেতে আছে। তাকে খুঁজতে গিয়ে আমি পেয়েছি সমস্ত ঋতু, প্রাণিজগৎ, আর সিঁড়ির নিচু স্বর।
গাছ ঘাড় নিচু করে রয়েছে; প্রাচীন ও বর্তমান সব অপরাধে সে অপরাধী, অজানা গ্রহের ছাই।
ওদের মিলিয়ে দিই সরু রাস্তার ধারে। বৃষ্টিতে লতারা সবুজ, বৃষ্টির সুতোয় জড়ানো।
পাশে সরকারি চিনিকল থেকে বেরিয়ে আসা মুরগিদের মধ্যে ভাগবাটোয়ারায় বচ্সা লাগে, যেখান থেকে কিংবদন্তীর শুরু।
এখন আমরা ভারী বস্তুগুলোর ভিতর থেকে বেরিয়ে আসবো। আমরা হয়ে উঠবো তুলো, আর নিজেরাই উড়বো।
আমি নিশ্চিত, আমাদের বাচ্চারাও অদৃশ্য হওয়া জিনিসের খবর জানবে। বস্তুত ডিমের ভাঙা-খোসা ঝরে পড়ে মুরগিদের বিষাক্ত দাঁত থেকে।
মধ্যরাতের কুয়াশা কারখানা
ঘাসের ভিতর সূর্য আর ছাইপোকা
পৃথিবীর জন্মরহস্যের উঁকি
মশামাছি ঘুমোবে না
যেন রেলগাড়ি সুতোয় জড়ানো
আকাশ বলছে : একটু দাঁড়াও
আমার মেয়েকে ঘুম থেকে তুলে আনি
আমার চুলের মধ্যে
মাছ সাঁতার কাটছে
আকাশের পশ্চিম তারাটি
মা হারানো
আমি খুলে ফেলি আমার পোশাক
চোখ বন্ধ
দেয়ালের ওপাশ নির্জন
নিষিক্ত আলোয় ভবিষ্যৎ জাদুরাস্তা
কাঠপেঁচা গেয়ে ওঠে :
শিশিরে ভিজেছে ডানা
শিশিরে ঘুমায় রাস্তা
আমের বাগানে কুয়াশার কারখানা
যত জন্তু-জানোয়ার
বিষাক্ত ব্যাঙের ছাতা
ভূগর্ভস্থ হাড়
রাফা সীমান্তের চাঁদ