শুক্রবার, ০৯ জুলাই ২০২১, ১১:১৬ পূর্বাহ্ন
নাহিদ ধ্রুব-এর ‘উদাসীনতা, সঙ্গে থেকো’ উপন্যাসের পাঠ-প্রতিক্রিয়া
বইটি ঘরে আসার পর কয়দিন পার হয়ে গেল; পড়া শুরু করতে পারছিলাম না। উল্টেপাল্টে কেবল ছবিগুলো দেখছিলাম। না, প্রচ্ছদের ছবি নয়; ভেতরে আঁকা তেরোটি পেন-আর্ট, তারা মনোহর। দু’টো এই লেখার সাথে জুড়ে দিলাম; বাকিগুলো দেখতে হলে বইটি হাতে নিতে হবে। কীসের ছবি? জাদুঘরের ছবি। কোন্ জাদুঘর? ঐ যে আপনার-আমার-তার-তাদের-ওদের এবং যাদের চিনি না এমন সবার মনের ভেতর যে জাদুঘরটিকে কুয়াশাঘেরা আবছায়া আলোয় দেখা যায়। যে জাদুঘরটি কখনোই সম্পূর্ণ দেখা যায় না, অথচ তার দেয়ালে টাঙানো ছবিগুলো মনে মনে হয়তো আপনিই এঁকেছেন। বইটিতে তেরোটি ছবির বাইরে যা আছে, সেটিও একটি ছবিই।
বর্ণমালা দিয়ে গল্পকার নাহিদ ধ্রুব এঁকেছেন এক বিমূর্ত উপন্যাস। নাম তার ‘উদাসীনতা সঙ্গে থেকো’। সাথে থাকার এমন বিনম্র অনুরোধ না থাকলেও উপন্যাসটি পড়ার সময়টুকু জুড়ে এবং পড়া শেষেও দীর্ঘক্ষণ (হয়তো অবচেতনে অনেক অনেকদিন) পাঠকের সাথেই থাকবে সে। সে যে নির্জন দ্বীপে নির্বাসিত এক বিষণ্ণ বালিকা। যে দ্বীপটি কেউ কোনদিন দেখেনি, দেখবেও না। সে আছে আবার নেই-ও। বলছি তাকে বিমূর্ত উপন্যাস। যে উপন্যাসের চরিত্রগুলো সম্পূর্ণ অবয়ব নিয়ে পাঠকের সামনে আসে না–ভেসে বেড়ায় ভরহীন মহাশূন্যে–সেইসাথে ভাসিয়ে নিয়ে যায় পাঠকের ভাবনা, তাকে বিমূর্ত না বলে উপায় নেই।
উপন্যাসটি আগাগোড়া একটি শিল্প, যা আপনি একবার পড়েই ফেলে রাখবেন না কেবল বুকশেল্ফে সংখ্যা বাড়ানোর জন্য। কিংবা দিয়ে দেবেন না কাউকে চিরতরে। দেবেন-ই বা কীভাবে! উদাসীনতা কি পুরোপুরি ছেড়ে যাওয়ার মত বোধ? এ-যে মাঝেমাঝেই হাত দিয়ে টান মেরে বের (বুকশেল্ফ থেকে) করা পুনঃপাঠের খোরাক।
উপন্যাসটি ত্রিশটি অধ্যায়ে বা পর্বে ভাগ করা। ছোট-ছোট পর্ব, কিন্তু গভীর মনোনিবেশের দাবি রাখে। অযত্নে পড়লে খেই হারিয়ে উত্তর মহাসাগরের কুহেলিকায় আটকে যেতে পারে পাঠকের অনুভব। তাকে বইতে দিতে হবে কুলুকুলু তরঙ্গে। নাহিদ আম-পাঠকের জন্য হয়তো লেখেন না। কিংবা তাদের জন্যই লেখেন, পড়ার পর যারা আর আম-পাঠক থাকেন না। কাফকা’র সৃষ্টি গ্রেগর সামসাকে উৎসর্গ করা এ-উপন্যাসের প্রতিটি পর্বের আগে আছে একটি করে উদ্ধৃতি। এ যেন প্রতিটি পর্বে প্রবেশের আগে পাঠকের প্রস্তুতি, যেমনটি আমরা টিকেট কাউন্টারে যাই ট্রেনে ওঠার আগে। যাত্রা শুরু হয়ে গেলো; আসুন এবার গল্পে ঢুকি।
হে পাঠক, ‘উদাসীনতা সঙ্গে থেকো’র ভবিষ্যৎ পাঠক, আপনারা কি ট্রেনে উঠেছেন? আপনাদের জানিয়ে রাখি, এ-যাত্রায় আপনাদের ভ্রমণ সম্পূর্ণ হবে না। এ-লেখাটি তিনঘন্টার চলচ্চিত্রের তিন মিনিটের ট্রেইলার মাত্র। উদাসীনতার এ-পথে আপনাকে তাই প্রতিটি স্টেশনের ডিটেইলে যেতে হলে চন্দ্রবিন্দু থেকে প্রকাশিত বইটি পড়তে হবে। পড়লে জানতে পারবেন মারিয়া নামের এক নারীর কথা, যার নিষ্ঠুরতার ছাপ পিঠে বয়ে বেড়াচ্ছে উত্তম পুরুষে লেখা উপন্যাসটির বক্তা; মারিয়ার গর্ভজাত সন্তান। যার ভাইয়ের নাম ফ্লেমিংগো। আচ্ছা, নামে কী আসে যায়, হবে আর কী একটা কিছু। বরং গল্পকারের ভাষায় বলি এটি একটি ঘরের গল্প। ঘর থেকে পর কিংবা পর থেকে ঘর হয়ে যাওয়ার গল্প। যেভাবে চতুর্থ পর্বের শুরুতে কবি হাফিজকে বলতে শুনি– “What we speak becomes the house we live in.”
গল্পে আরও চরিত্র আছ–মারিয়ার স্বামীরূপী লম্পট সাইফুর, যার সম্পর্কে তার পুত্রের মন্তব্য, ” যে মরে যেতে পারতো আমার জন্মের আগে, যার মৃত্যু আমাদের জীবনে নিয়ে আসতে পারতো সৌভাগ্য।” আরও আছে বন্ধু জিয়ন ও তার প্রেমিকা সাইয়ারা, যে প্রেমিকের হত্যার বিচার চাইতে গিয়ে মর্গের লাশে পরিণত হয়। এমন অনেক চরিত্র যাদের নামে কিছু আসে যায় না, কারণ চরিত্রগুলো পরিচিত। মারিয়ার নাম জিনিয়া, জিয়নের নাম সায়র হতে পারতো–এমন একটা ধারণা গল্পকার দিয়েই রেখেছেন।
উপন্যাসে ঘটনা আছে, তার প্রবাহ নেই। ঘটনাগুলো সাগরপাড়ে ছড়িয়ে থাকা অজস্র নুড়ি আর ঝিনুকের ফাঁক-ফোঁকড়ে লুকিয়ে থাকা মতিদানার মতো। পাঠকেরা তাই ছোট্ট মেয়েটির মত ঝিনুক কুড়োতে কুড়োতে আলগোছে তুলে নেবেন গল্পের হীরে-মতিদানা। গল্পে যখন আমরা একটা যুদ্ধের কথা পড়ি, তখন মানুষের অন্তর্গত আঁধার দেখতে পাই–
“যারা দোকানে বসে মৃতের সংখ্যা কম হওয়ার আফসোস করছিল কয়েক মাস আগে কিংবা বছর আগে তাদের সন্তানেরা সেদিন লাশ হয়ে ফেরে ঘরে।”
“তল্লাটে যারা এক চায়ের দোকানে বসে করতো মৃত্যু নিয়ে উল্লাস তারাও বিভক্ত হতে থাকলে শ্মশান এসে ঘুমিয়ে পড়ে কবরস্থানে।”
আছে বিভেদের গল্প। ধর্মের প্রাচীর, কীভাবে বুনে দেয়া বীজ মহীরূহ হয়েই উপড়ে ফেলতে পারে বন্ধুত্বের শেকড়। রক্ত-পিপাসা কীভাবে হোলি খেলতে পারে হলি আর্টিজানে। না, গল্পকার হলি আর্টিজেনের নাম নেন নি, আর হ্যাঁ, নামে কী আসে যায়! আর সেসব বিপথগামী তারুণ্য, যারা এ পৃথিবীর বিষাদফুল তাদের কথা হাওয়াদের ভয়ে বলা যায় না। সেসব হাওয়াদের ভয়ে আরও কত
কত করুণ সত্য গিলে ফেলা আমাদের এই নাগরিক সভ্যতা গিলে ফেলে আমাদের বোধ। আমরা আর মানুষ থাকি না। আমরা যে আর মানুষ থাকি না, সেই গোপন কথাটি বলে দেয় সেই জাদুঘরে রাখা ছবিগুলো; চিত্রে আর অক্ষরে।
কী নেই উপন্যাসটিতে? অনেক কিছুই না থাকতে পারে, কিন্তু যা আছে তা চলমান বাস্তবতার যাপিত নির্যাস। আমরা দেখি রাজনৈতিক ফতোয়া কীভাবে দায়মুক্তি দেয় গুম, খুন, ধর্ষণ আর মৃত্যুর কার্যকারণকে। শশশ সরকারের কথা এখানে বলা হচ্ছে না, বলা হচ্ছে সরকার থাকেন ও-পাড়ায় ভদ্রপল্লীতে। যেমনটি বলেছেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, কিংবা আপনি-আমি বলি ঘরের ভেতর ফিসফিস ক’রে। এইসব বলাবলির মাঝেই এ-পাড়ায় নির্বিঘ্নে ঘটে সড়কে মৃত্যু। মশা কিংবা হাতির কামড়ে প্রাণ যায় রিশাদ, কুশল অথবা বশীরের। নামে কী আসে যায়! নাম যে কারও হতে পারে। রিশাদের বদলে আসিফের, কিংবা কুশলের বদলে রশীদের নামও আসতে পারে। এই অনির্দিষ্টতা এ-উপন্যাসের অনন্য বৈশিষ্ট্য।
আছে বন্ধ্যাগ্রামের গল্প–
“একদিন জন্মের কাছে পৌঁছাবে বলে বন্ধ্যাগ্রামের মানুষ বেঁচে থাকতো আঁতুড়ঘরে।” ঠিক এভাবেই কিছু বলার চেষ্টা করা হলো। সেটা কী? পাঠক হয়ে আমি চোখ বুঁজে দেখলাম, পিলপিল করে গ্রাম থেকে ছুটে চলা শহরমুখি মানুষ; শ্রমিক মানুষ, আর শহরগুলো যেন এক একটি মৃত্যুকূপ।
অণুজীবের সাথে চলমান যুদ্ধ কীভাবে স্বার্থপরতাকে উস্কে দেয় সেই ভয়াবহ চিত্রের সাথে উপন্যাসে আছে অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা আর প্রস্তুতিহীনতার সাক্ষ্য।
গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার ও কথা বলার অধিকারের জন্য লড়াই ক’রে হেরে যাওয়া মানুষের ঝোলায় প্রাপ্তি হিসেবে থাকে কেবল অমুক চত্বর, তমুক চত্বর। এইসব বিষাদময়তাকে সাথে নিয়ে পুরো উপন্যাস জুড়ে আছে জাদুঘরটি উন্মোচনের নিরন্তর তাড়না। আর পুরো পাঠপ্রক্রিয়ায় পাঠককে তাড়া ক’রে ফেরে জীপগাড়ি নামক এক ভয়ানক দানব। ‘উদাসীনতা, সঙ্গে থেকো’ তাই কেবল একটি উপন্যাস হয়ে না থেকে হয়ে ওঠে সময়ের দলিল। আটাশতম অধ্যায়ে, নান্দনিক চিঠিগুলো করুণরূপেই উপন্যাসটিকে দিয়েছে বাড়তি ব্যঞ্জনা।