সোমবার, ২৯ মার্চ ২০২১, ০৭:১০ অপরাহ্ন
ত্রিবেণীসঙ্গম
বাসা পরিষ্কার করার পর আমি আর ফিফি কিউয়ি মনটিস বিয়ারে চুমুক দিয়ে উবারে অর্ডার দেয়া থাই খাবারের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। জন্ম সামোয়াতে হলেও ফিফি বেড়ে উঠেছে নিউজিল্যান্ডে। কিউয়ি দেশপ্রেম বলতে তার কাছে কেবল সে-দেশের বিয়ার আর ওয়াইনের প্রতি আনুগত্য।
নিচ থেকে বেল শুনে ভাবলাম খাবার চলে এসেছে। কিন্তু, দরজা খুলে দেখি বিশালদেহী এক সামোয়ান যুবক! ফিফি পরিচয় করিয়ে দিল, ‘এ হচ্ছে আমার বন্ধু ফেতু’। আমি বাকিটা বুঝে নিলাম। আমার সাথে পরিচয় হওয়ার আগে, গত বছর কভিডের লকডাউনের সময়, ফেতুর সাথে ওর বেশ খাতির হয়। ফেতু পেশায় আইনজীবী, অস্ট্রেলীয় সরকারের বৃত্তি নিয়ে মাস্টার্স করছে। লকডাউনের সীমিত সামাজিক যোগাযোগে একসাথে ঘোরাফেরা, বাজার আর ব্যায়াম করার মাঝে ওদের ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। দু’জন একই দেশের, দু’জনেই আইনজীবী, তাই একটা সম্পর্ক ঘনিয়ে ওঠা যেন স্বাভাবিকই ছিল। বাধার মধ্যে দেশে ফেতুর বউ-বাচ্চা, আর ফিফির বাগদত্ত। নিত্যকর্মে, আড্ডায় প্রায়ই দেরি হয়ে যেত বলে ফিফির বাসার সোফায় রাত কাটাতে শুরু করলো ফেতু। বেডরুমের দরজা খোলা রাখতে হতো ফিফিকে, কারণ ঘরের একমাত্র বাথরুমে যেতে হয় বেডরুমের ভিতর দিয়েই।
অনেক সংযমের পরে কোনো এক রাতে নেশার ঘোরে ফেতু তার জন্য নির্ধারিত সোফা ছেড়ে বিছানায় আসলে ফিফিও আর বাধা দিতে পারে নাই। দু’জনেই জানে এই সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নাই, তদুপরি জানাজানি হলে মেয়ে হিসেবে ফিফির কেলেঙ্কারিই বেশি হবে। ওর বাগদত্ত ফিলিপের কানে গেলে তো বিয়ের পরিকল্পনাই যাবে ভেস্তে! তাই যোগাযোগ কমিয়ে দিয়ে সম্পর্কটাকে ক্রমে আনুষ্ঠানিক বন্ধুত্বে নামিয়ে আনতে তৎপর ও অনেকখানি সফল হয় ফিফি। তবে ফেতু ওকে বারবার নক করেই যাচ্ছিল।
এরপর আমার সাথে ফিফির ঘনিষ্ঠতা হয়। আমি ভিনদেশি হওয়ায় নিরাপদ। তাছাড়া আমাদের বোদ্ধিক ও আধ্যাত্মিক সামঞ্জস্য এই সম্পর্কে ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছে। কোনো পরিণয়ের আকাঙ্ক্ষা না থাকায় পরস্পরের কাছে আমরা এতো খোলামেলাভাবে সব কথা বলতে পারছি, যা দু’জনের কারোরই আগে কখনো হয় নি।
আমি ফেতুকে বিয়ার অফার করলাম। সে কিছুটা অপ্রস্তুত বটে; কিন্তু বোকা তো আর না! এই সময়ে আমাকে শর্টস আর টিশার্ট পরে সোফায় গা এলিয়ে বিয়ার পান করতে দেখে বুঝে ফেলেছে আমার সাথে ফিফির কিছু একটা চলছে। আর ওকে দেখে আমার পুরুষসত্তা মুগ্ধ—ছ’ফুট লম্বা পেশিবহুল সুদর্শন যুবক, যে কিনা চাইলে আমাকে এক হাতে তুলে জানালা দিয়ে ছুড়ে ফেলতে পারবে! সে অতীত আর আমি বর্তমান। এই ক’দিনে বুঝেছি, খুব রূপবতী না হলেও ফিফির কাছে যে-কোনো পুরুষ বারবার ফিরে আসবে। পেশাগত ক্ষেত্রে ও অত্যন্ত চৌকস আর সফল, সঙ্গীর প্রতি তার যত্ন প্রায় মাতৃসম, আর বিছানায় ওর দক্ষতা-প্যাশন বাজারের সেরা নটীকেও হার মানাবে। পুরুষেরা আর কী চায় এর বেশি? ফিফি ভয়ে আছে এই ছেলে দেশে গিয়ে কোনো কেলেঙ্কারি করে কিনা।
ফেতু না না করেও একটা বিয়ার নিলো। ফিফি দেশে চলে যাচ্ছে কয়েকদিন পর, তাই বাসাটা সাফ করে দিতে হচ্ছে। আমি সে কাজেই তাকে সাহায্য করছিলাম। ফেতু বিনা নোটিশে রাত ৮টায় এসে বলল সেও হাত লাগাতে এসেছে! আমি আর ফিফি চোখাচোখি করলাম এক পলক। সে আমাকে টেক্সট দিল, ‘অস্বস্তিকর, তাই না?, হা হা’। উত্তরে লিখলাম, ‘চরম অস্বস্তিকর কিন্তু মজাই পাচ্ছি’। ও দেখি আরেক কাঠি সরেস, ‘ত্রিসাম করবে নাকি?’ বললাম, ‘সে মেয়ে হলে রাজি হতাম’।
ফিফি চাচ্ছে ইংরেজিতে আলাপ করতে, আর ফেতু চেষ্টা করছে সামোয়ান ভাষায় কথা বলতে—ব্যাটা আমাকে উপেক্ষা করার তালে আছে! আমি যখন পাকঘরে গেলাম, সে ফিফিকে বলল, ‘আমি কি তোমাদেরকে ডিস্টার্ব করলাম?’ ফিফি কিছু স্বীকার করার পাত্রী না।
ততক্ষণে আমাদের খাবার চলে এসেছে। ফেতুকে অফার করলাম। অনেক জোরাজুরির পর সে রাজি হল। দু’জনের খাবার তিনজনে ভাগ করে খেলাম। আমি ভাবলাম, আমরা কতো ভালো, বর্তমান সাবেক সব ভাই ভাই, একসাথে খানা খাই! পরে ফিফি বলেছিল, সব খাবারেও ফেতুর একার পেটই ভরবে না।
আরও কিছু অস্বস্তিকর গাঁইগুঁই পেরিয়ে ফেতু বিদায় নিল। ফিফি তার বিছানা বিক্রি করতে না পেরে শেষে স্যালভেশন আর্মিকে দান করে দিয়েছে। অগত্যা আমরা চাদর বিছিয়ে ফ্লোরে রাত কাটালাম।
সকালে ইউনিভার্সিটির দিকে রওয়ানা দিয়েছি। ফিফি যাবে মেডিক্যাল সেন্টারে। বিশেষ বিমানে ওঠার শর্ত হচ্ছে কোভিড টেস্ট করে নেগেটিভ ফলাফল দেখাতে হবে। আর আমি যাচ্ছি অফিসে।
ফিফিকে বিদায় দিয়ে একটু এগোনোর পর ল’ স্কুলের সামনে মন্ত্রণার সাথে দেখা! ও অন্যদিক থেকে হেঁটে আসছে। এ-সময়ে ওর তো এখানে থাকার কথা না! মন্ত্রণা পিএইচডি করছে কম্পিউটার সায়েন্সে। বছরখানেক আগে ওর সাথে আমার স্বল্পকালীন কিন্তু গভীর প্রেম ছিল, যা খুব দ্রুত তেতো হয়ে ছুটে যায়। কিন্তু ইদানীং সে আবার ভাব করার চেষ্টা করছে। ওকে একটু হাই বলে বিদায় নিলাম।
ওদিকে ফিফি জানালো আমাকে বিদায় জানানোর পাঁচ মিনিট পর তার সাথে পথে ফেতুর দেখা! ওই সময়ে ফেতুরও তো ওখানে থাকার কথা না!
অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যতের ছিন্ন সিন্ধুবেণী একক বিন্দুতে এসে বারাংবার মিশে যাচ্ছে যেন!