মঙ্গলবার, ৩০ মার্চ ২০২১, ১০:২৮ পূর্বাহ্ন
খুঁটি আর পতাকার গল্প
একটি পতাকার গল্প বলবো আজ। পতাকা ও তার খুঁটির গল্প। একটি সবুজ, লাল পতাকা ও তার চকচকে একটি খুঁটির গল্প। গল্পটা অনেক পুরানো। পতাকা অনেক ঝড়-ঝাঁপটা সয়ে যেদিন প্রথম বাতাসের স্বাদ নিয়েছিল, খুঁটিটি যেদিন প্রথম মাটির সংস্পর্শে এসেছিল ঐদিন থেকেই গল্পটার শুরু। খুঁটি আর পতাকা সারাদিন বাতাস, আলো, সূর্য, মাটির সাথে গল্প করত তখন। তাদের পাশ দিয়ে চলে যাওয়া মানুষগুলোর গল্প করত তারা।
আজ আমি পতাকার সবুজ থেকে লাল হয়ে যাবার গল্প, খুঁটিতে জং ধরার গল্প, পতাকা ও খুঁটির গল্প শেষ হয়ে যাবার গল্প, পতাকার আর উত্তর না দেবার গল্প বলবো।
পতাকা আর খুঁটি….
পতাকা বাতাসের শণশণ শব্দে এলোমেলো ভাবে উড়তে থাকে। খুঁটির খুব ভালো লাগছে, পতাকারও। লালে চাঁদ-তারাও আছে। খুব উড়ছিল, পুরাতন রাঙ্গামাটির মগবানের বরাদাম গ্রামে খুব উড়ছিল। হঠাৎ একদিন পতাকা দেখতে পায় চারপাশে খুব হইচই । প্রতিবাদের শব্দ, কান্নার শব্দ, নিজ ভিটে না ছেড়ে যেতে চাওয়ার আর্ত-চিৎকারে বাতাস ভারি হতে থাকে।
ছোটাছুটির সময় দুই বোনের— বনদেবী চাকমা ও মায়াদেবী চাকমা— হাত ছুটে যায়। এই দেখে পতাকার খুব অস্থির লাগে। পতাকা মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে বইতে থাকে। খুঁটি তাকিয়ে দেখে আশেপাশের মাটি সরে যাচ্ছে। কিন্তু তাতে কি!
তখনও মাটির ভিত মজবুত। বাতাসে শোঁ শোঁ শব্দ বাড়তে থাকে। পতাকা পতপত করে উড়তে থাকে। কাপ্তাই বাঁধের পানির নিচে ডুবে যাওয়া গ্রামের মাটির কান্না তাকে ছুঁতে পারেনা আর। কিন্তু কিভাবে জানি মানুষের কান্নার শব্দগুলো পতাকাতে দাগ লাগিয়ে গেল। লাল বিশাল ছোপ। পতাকা কাপ্তাই বাঁধের এপাড় ওপাড় দেখে। পতাকা ভাবে, চলে যাবে এই দাগগুলো, মিলিয়ে যাবে, একেবারে না গেলেও ঝাপসা তো হবেই। কান্না ও ভাঙ্গনের শব্দ কত জোরালো দাগ দিতে পারে আর। খুঁটি তো শক্ত করে মাটিতে পোঁতাই আছে। কিসের ভয়। কোন ভয় নাই। নির্ভয়ে উড়তে থাকে পতাকা। পতপত…প ত প ত…
পতাকা ও খুঁটি…
আজ ও তাদের মনে আছে যেদিন প্রথম উড়েছিল তারা, অনেকেই ছিল। অনেকের হাসির শব্দে শব্দময় ছিল তাদের বাতাস। বাচ্চারা তাড়স্বরে গাইছিল, ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’…পতাকার খুব ভালো লাগছিল গানের তাল। লাল বৃত্তে তার মানচিত্র…সে আরও গর্ব করে উড়ছিল।
হঠাৎ, খুঁটি বলে উঠলো, “আচ্ছা, পতাকা, ও পতাকা, শুনছো? চারপাশে এত গোলমাল চলছে, শুনছো? ঐ যে দেখ, সবাই কেমন জানি জটলা পাকিয়ে কি একটা করছে…”
পতাকা তাকিয়ে দেখে আলো ভয়ার্ত দৃষ্টিতে রহিম দিকে তাকিয়ে আছে। খুঁটি বলে উঠলো, “পতাকা আমি দেখতে পাচ্ছি রহিম কি যেন বলছে। পতাকা একটু শুনো না?” পতাকা কান পাতলো। রহিম মিয়াঁ বলছে, “দেখ আলো, আমি এই দেশের একজন স্বনামধন্য যোদ্ধা। তোর কথা কেউ বিশ্বাস করবে না, তোকে ভালো পাই, তাই বলছি চুপ মেরে যা, যা হবার হয়ে গেছে। আরে বোকা, তুই কারো কথাতেই ভয় পাইস না। ঐ শকুনের দল অনেক ক্ষতি করে গেছে এমন, তোর ঘটনাটাও ওদের উপর দিস। আররে-তুই কি জানিস লোকে তোকে বলবে-‘বীরাঙ্গনা’। অনেক সম্মান পাবি। কথা বলা শেষে রহিম আলোর হাত টেনে আবার ঘরে ঢুকল। পতাকা চুপচাপ শুনল ও দেখল। ভেবে দেখল, রহিমের কথায় যুক্তি আছে। এটা ভেবে সে শান্তিতে আবার পতপত করে উড়তে লাগলো… খুঁটিকে বলল, সব ঠিক আছে, ভাবিস না।
আবার তারা আলো, বাতাসের, মানুষের সাথে গল্প করতে লাগলো।
সেইদিন সন্ধ্যায় এক অদ্ভূত ঘটনা ঘটলো, পতাকার সবুজ চকচকে গায়ে হঠাৎ একটা লাল ছোপ লাগলো। পতাকা খুব চেষ্টা করতে থাকে দাগ মোছার, কিন্তু উঠে না। পতাকা এদিক-ওদিক তাকাতে থাকে, দেখে দূর থেকে কার যেন ঝুলন্ত দুইটা পা দেখা যায়। নিথর, নিস্তব্ধ দুইটা পা। পতাকা চোখ নামিয়ে নেয় এবং আবার উড়তে থাকে। ভাবে কিছু দিন গেলে দাগ ধুয়ে যাবে বৃষ্টির পানিতে। আবার সবুজ হবে…
দিন যায়, পতাকা উড়তে থাকে…পতপত পত পত…
পতাকা ও খুঁটি…
চকচকে সবুজ আর রক্ত লাল, খুঁটিও খুব মজবুত। পতাকা ভাবে অনেক তো হল, আর বুঝি কোন জটলা, শোরগোল, উচ্ছেদ, কান্না, প্রতিবাদ দেখতে হবে না। এখন সারাক্ষণ হাসি আর আনন্দ চলবে…
পতাকা উড়তে থাকে, পত পত পত…
সবুজ তার চির সবুজ থাকবে, লাল ছোপ ছোপ গুলো ঠিক মিলিয়ে যাবে… এই ভাবনায় পতাকা আর খুঁটি গল্পে মশগুল থাকে…কিন্ত না, ধানমণ্ডি, জেলখানা, রেসকোর্স, নূরহোসেন, একুশে আগস্ট, পিল খানা, শাহবাগ, ফেলানি, কল্পনা চাকমা, ত্বকী, সাগর-রুনি, তনু, রাজন, অভিজিৎ সবাই যেন পতাকাকে খুব ছুঁতে চাচ্ছে। পতাকা খুব নড়েচড়ে সরে যেতে চায়, কিন্তু এত লাল থেকে বেরুতে পারে না। তার সবুজ পতাকা লাল লাল ছোপে কালচে লাল হয়ে যায়।
পতাকা ভাবে আর কিছুদিন… ঠিক হাল্কা হয়ে যাবে… পতাকা খুঁটির দিকে তাকিয়ে দেখে। মরচে পড়া, ধুলো মাখা, বিবর্ণ, নড়বড়ে খুঁটি আর কোন গল্প করে না তার সাথে। শুধু ভার বয়ে চলে, শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে দেখে। পতাকা ভাবে খুঁটি একদিন ঠিক তার সাথে কথা বলবে, আবার গল্প হবে। তাকে ছাড়া কোথায় যাবে আর…পালাবার কোন জায়গাতো নাই।
কিন্তু কি এক অদ্ভুত ব্যাপার। এখন পতাকা কেমন জানি হয়ে গেছে। সেও খুঁটির মতো ক্লান্তিতে ভুগে। উৎসাহ নিয়ে কোন শোরগোলেও তাকায় না। জীবন থেকে তারও যেন সব মজা কোথায় হারিয়ে গেছে। কোন কিছুতেই আগ্রহ পাচ্ছে না। সে মিরসরাই এর ৪১ বাচ্চার চিৎকার হোক, তাজরিনের আগুন হোক, রানা প্লাজার ধ্বসে পড়ার শব্দ হোক, বুয়েটের আবরার হোক কিংবা হোক সিনহা, অথবা শহীদ মিনারের পিছনে পড়ে থাকা ফুলবিক্রেতা ধর্ষিতার লাশ। কোন দিকেই পতাকা আর তাকায় না। খুঁটি মৃদু স্বরে পতাকারে ডাকতে থাকে। মুচকি হাইসা খুঁটি পতাকারে কয়, “কি মিয়াভাই! আছেন নি ভালা? খুব তো ফাল মারছিলেন এক কালে! আমি তো ফুরাই গেছি সে কবে। আসেন এক্ষণ আমার দলে…” শুনেও না শোনার ভান করে পতাকা এদিক ওদিক তাকাইতে থাকে।
পতাকা কিছু ভাবে না। শুধু অভ্যস্তভাবে উড়তে থাকে। পতপত পত…পত
হঠাৎ একদিন শুনতে পায় উঁচা গলায় কেউ একজন বলতেছে,
“কোকিলও কি দেশদ্রোহী যদি সে আপন মনে কারো
নাম ধরে ডাকে?
বকুলও দন্ডিত হবে যদি কিনা সেও কোন নিষিদ্ধ কবরে
একা নিরিবিলি ঝরে,
আর এই আকাশও যদি বা তাকে অকাতরে দেয় স্নিগ্ধ ছায়া
তাহলে কি আকাশের দেশপ্রেম নিয়ে কেউ
কটাক্ষ করবে অবশেষে?”
কে বলছে? কে গাইতেছে? গারদের ঐপাড় থেকে কে পড়ছে এই কবিতাটা?
গলার আওয়াজ ক্রমশ নাইমা আসে…
পতাকা ভাবে, আর কতইবা আওড়াবে। কারাগারের ভেতরে ‘উচিত’ আচরণই তো শেখানো হয়…ঠিক শিখে যাবে। শিখে যাবে গলা নামিয়ে কথা বলা, শিখে যাবে চোখ নামিয়ে মেনে চলা, শিখে যাবে কিভাবে সব কিছু মেনে নিয়ে চুপচাপ চুপচাপ…
যদি এই বেকুব কবি নাই শিখে তবে অন্যরা আজ যারা বলছে, লিখছে, আঁকছে, সহজে কোন কিছুই মানছে না, অথবা যারা মুখ বন্ধ রাখছে না, তারা শিখবে কিভাবে? শিক্ষা হবে তোমাদের। আজ গারদের আড়ালে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে বিড়াল। দেখে নাও। কাল তুমিও ঠিক হাঁটা শিখে যাবে কবি….
হঠাৎ একদিন সব আওয়াজ, কবিতা বন্ধ হয়ে যায়। ভাবনা থেমে যায়, কবির কলম আর চলে না। গারদের আড়াল থেকে আর হাসির শব্দ আসে না। থেমে যায় সব, শুধু আরেকটি তাজা লাল ছোপ পতাকাতে লেগে যায়।
খুঁটি নিচ থেকে ঠিক বুঝতে পারে। পতাকায় আর কোন জায়গা বাকি নাই। পতাকার শরীরে সমস্ত সবুজ এখন কালচে লাল…
খুঁটি পতাকাকে আর কিছু বলে না। উপরতলার পতাকাও খুঁটির সাথে গল্প করার আগ্রহ বা ইচ্ছা হারাইছে… চুইয়ে চুইয়ে টপ টপ করে পতাকা থেকে লাল খুঁটিতে পড়তে থাকে আর পতাকা পুরোটা বিষণ্ণ কালচে লাল নিয়া উড়তে থাকে। পত পত পত…
মাঝেসাঝে পতাকা খুঁটির দিকে তাকাইয়া থাকে…চুপচাপ চুপচাপ
কারো চোখে কোন বিকার নাই, আগের মত আর গল্প নাই, নাই কোন ভ্রুক্ষেপ…
কিন্তু পতাকা ঠিকই উড়তে থাকে…পত পত পত… পতাকা নিয়ম করেই উড়তে থাকে। উড়তে হয়।