শুক্রবার, ০৯ জুলাই ২০২১, ১০:৫৯ পূর্বাহ্ন
ভাষা কেন হারিয়ে যায়?
কোনও ভাষা হারিয়ে গেলেই তার মৃত্যু ঘটে না। অন্তত দশজন লোকের কথ্য ভাষাকেও জীবিত ধরে নিতে হবে। অপরদিকে কোনও ভাষার একজন কথকও না পাওয়া গেলে, সে ভাষা স্বভাবতই মৃত বলে গণ্য হবে। স্মর্তব্য যে, ২০১০ সালে ভারতের আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে বোয়া সিনিয়র নামে এক নারীর মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে ‘বো ভাষা’। ৬৫ হাজার বছর বয়সী ‘বো ভাষা’ ধারণ করার মতো এখন আর কেউ নেই।
ভাষাবিদরা অনুমান করেছেন, প্রতি দু’সপ্তাহে একটি ভাষার মৃত্যু হয়। সে হিসেবে একই সময়ের ব্যবধানে দু’য়ের অধিক ভাষা হারানোর বিষয়ে দ্বিমত থাকার কথা নয়। জীবন ও জীবিকার তাগিদে মানুষ নিজের ভাষা ভুলে কখন যে অন্য ভাষার কাছে আত্মসমর্পণ করে তা বোধেও আসে না অনেকের। চাকরিসূত্রে, অভিবাসী অথবা উদ্বাস্তু পরিচয়ে অনেক মানুষ অন্য দেশে পাড়ি দেয়। নতুন দেশে বসতি গড়তে গিয়ে তাদের নতুন ভাষার ডোরেও বাঁধা পড়তে হয়। বাবা-মা কষ্টেসৃষ্টে দেশীয় ভাষা ধরে রাখলেও সন্তানরা ভিনদেশি সংস্কৃতিতে মজে হারিয়ে ফেলে শেকড়। আর ও-দেশের কাউকে বিয়ে করলে তো পুরোপুরি ওদের হয়ে যায়। ফলে ঐ পরিবারের ভাষাটি ক্রমান্বয়ে মৃত্যুমুখে ধাবিত হয়। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ থেকে যারা যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়ায় স্থায়ী হয়েছে তারা মূলত সে দেশের ভাষাতেই আবদ্ধ। যদিও বিভিন্ন অনুষ্ঠান-প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বাংলাচর্চার একটু-আধটু খবর পাওয়া যায়, কিন্তু তা মোটেও আশাব্যঞ্জক নয়। কারণ যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়ার আবাসিক বিদ্যালয়গুলোতে স্বদেশজাত ভাষা শেখার চল নেই। এসব স্কুলে শিশুদের প্রধানত ইংরেজি শিখতে হয়; মাতৃভাষায় কথা বললে মানসিক নির্যাতনের মুখে পড়তে হয়। এই পরিস্থিতিতে ওসব দেশে বসবাসরত ভিন্ন ভাষাভাষীদের বহু ভাষা হারিয়ে গেছে। কিছু ভাষা সংকটকাল অতিক্রম করছে।
পৃথিবীর কিছু অমানবিক ঘটনা যেমন প্রাণিকুল ও উদ্ভিদকুলের জীবন বিপন্ন করে তোলে, তেমনি ভাষাকেও ঠেলে দেয় অচিনপুরে। এর একটি মর্মান্তিক নিদর্শন–তাসমেনিয়ায় ব্রিটিশ উপনিবেশ স্থাপনের সময়কার ‘কালো যুদ্ধ’। ১৮২৭ থেকে ১৮৩২ সাল, মাত্র পাঁচ বছরের ব্যবধানে ৫০ হাজার বছরের পুরনো অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসী তাসমেনিয়ানদের নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়েছিল। সেই হত্যাযজ্ঞের সঙ্গে হারিয়ে গেল পৃথিবীর কত পুরনো একটি ভাষাও। আরও একটি ভীতিকর নিদর্শন হচ্ছে, ১৯৩২ সালের এল সালভেদর গণহত্যা। এই গণহত্যায় ৩০ থেকে ৪০ হাজার আদিবাসী উধাও হয়েছিল। স্বৈরাচারী সরকারের ভয়ে নিজেদের ভাষা ও সংস্কৃতিকে ত্যাগ করে জীবন বাঁচাতে হয়েছিল তাদের। ফলে তারা ব্যর্থ হয়েছে নিজেদের মাতৃভাষা ধরে রাখতে।
১৯৭১ সালে বাংলা ভাষার ক্ষেত্রেও উপর্যুক্ত বিপর্যয়ের সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছিল। ১৯৫২ সালে যখন গুলি চালিয়েও উর্দুকে পূর্ববঙ্গের রাষ্ট্রভাষা করা গেল না, তখন একটা চাপা ক্রোধের আগুন পাকিস্তানিদের ভেতর দাউদাউ করে জ্বলছিল। ঠিক তারই প্রতিফলন দেখা গেল ২৫ মার্চ রাতে। ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে নির্মম গণহত্যা চালিয়ে কীটপতঙ্গের মতো নিরীহ মানুষদের প্রাণপাত ক’রে ওরা রুদ্ধ করতে চেয়েছিল স্বাধীনতাকামী বাঙালির কণ্ঠস্বর, বাংলা ভাষার গৌরবকে। কিন্তু তা সম্ভব হয়নি। বাংলা ভাষার হাজার বছরের সাংস্কৃতিক ভিত্তিকে ধুলোয় মিশিয়ে তাতে রাতারাতি নতুন ভাষাভূমির উন্মোচন মোটেও সহজ ছিল না। কারণ এ-ভূখণ্ডের মানুষের স্বাধীনতার বীজমন্ত্র নিহিত ছিল ভাষা আন্দোলনের ভেতর। বাংলা ভাষার অবিনাশী শক্তি দিয়ে দুর্বার সাহসে মুক্তির গান গেয়েছে আপামর বাঙালি। এজন্যই বাংলাকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করা যায়নি।
কখনও ভাষা, হারানোর ছলে নবজন্ম লাভ করে। ল্যাটিন তেমন একটি ভাষা। রোমান সাম্রাজ্যের পতনের সাথে এ-ভাষার সমস্ত আলো নিভতে থাকে। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, ল্যাটিন বিলুপ্ত হয়ে গেছে। মানুষের মুখের ভাষা না হলেও এখনও বিভিন্নভাবে ল্যাটিন ব্যবহৃত হয়। বিজ্ঞানীরা উদ্ভিদ ও প্রাণীর নামকরণে এ-ভাষার প্রয়োগ করেন। ধর্মের ক্ষেত্রে (বিশেষ ক’রে ক্যাথিলিসিজমের প্রচারে) এ-ভাষার জোরালো উপস্থিতি আছে। ভ্যাটিকান সিটির অন্যতম সরকারি ভাষা ল্যাটিন। এমনকি স্প্যানিশ-ফরাসি-ইতালিয়ান-পর্তুগিজ ও রোমান ভাষাও ল্যাটিনজাত। একই কথা খাটে সংস্কৃত ভাষার বেলাতেও। প্রায় দুই সহস্রাব্দ ধ’রে বিজ্ঞান-ধর্ম-সাহিত্য-প্রশাসন ইত্যাদির বাহন থাকায় এটি ভারত, দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অধিকাংশ ভাষাকেই প্রভাবিত করেছিল। কিন্তু জনপ্রিয়তার তুঙ্গে ওঠা সেই ‘দেবভাষা’ও ভাগ্যচক্রে জায়গা নিয়েছে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্দিষ্ট বলয়ে। ও-ভাষা আর জন-পরিসরে বহুল ব্যবহৃত নয়। তাই ব’লে সংস্কৃত একদম দেবে যায়নি। একালের হিন্দি-বাংলা-মারাঠি-গুজরাটি প্রভৃতি ভাষার ভেতর ঢুকে পুনর্জীবন পেয়েছে; যেমন- কতিপয় আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভাষা: মুণ্ডারি-সাঁওতালি-বিষ্ণুপ্রিয়া-মণিপুরি সংস্কৃত-আশ্রিত। উল্লেখ্য, ল্যাটিন ও সংস্কৃত ভাষা ছিল উঁচু মহলের। লোকসমাজের
নাগালের বাইরে থাকায় এ-ভাষা দুটির পথ কালানুক্রমে সংকীর্ণ হয়ে পড়েছিল। তাই নিজেদের আয়ু বাড়ানোর স্বার্থে অন্য লৌকিক ভাষার সঙ্গে মিতালি ভিন্ন এদের পথ ছিল না।
কোনও ভাষার ওপর ক্ষমতাধর ভাষা জেঁকে বসলে সে ভাষার টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ে। বিশেষত, পূর্বের সাম্রাজ্যবাদ এবং পরে অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদ পোষিত ভাষার প্রবল প্রতাপে অনেক ভাষা বিলীন হয়ে গেছে; যে কারণে এগুলোকে হত্যাকারী ভাষা( killer language)-ও বলা হয়। এই ভাষাগুলোর মধ্যে ইংরেজি-স্প্যানিশ-ফরাসি-মান্দারিন-আরবি-রুশ উল্লেখযোগ্য। এদের মধ্যে আবার ইংরেজির প্রভুত্ব সবচেয়ে বেশি। তবে শোষণের যাঁতাকলে পিষ্ট ভাষাগুলোর সবই ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর ভাষা। সাইবেরিয়ার বিশাল অঞ্চলের ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর ভাষাগুলোর ওপর রয়েছে রুশ ভাষার আধিপত্য। জার্মানির অস্ট্রিয়া অঞ্চলে হাঙ্গেরীয় ভাষা হারিয়ে গেছে। প্রশান্ত মহাসাগরের দক্ষিণে পাপুয়া নিউ গিনিতে ‘টোক্ পিসিন’ নামে এক মিশ্রভাষা কয়েকশ ভাষার প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় ১৯৬০ সালেও প্রায় দু’শো ভাষার অস্তিত্ব ছিল। গত কয়েক দশকে ওই সংখ্যা আশ্চর্যজনকভাবে কমে এসেছে। আফ্রিকাতে মাতৃভাষা ত্যাগ করে স্থানবিশেষে প্রশাসনিক ভাষা ইংরেজির দিকে ঝুঁকছে সবাই। ভারতে এখন ৭৮০টির মতো ভাষা বলা হলেও গত ৫০ বছরে ২২০টিরও বেশি ভাষা হারিয়ে গেছে। বিশেষ করে উপকূলবর্তী অঞ্চলের ক্ষুদ্র ভাষাগুলো ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশে দ্রাবিড় গোত্রের মালপাহাড়িয়া, ভোট-বর্মি গোত্রের খুমি, ঠার/ঠেট, লালং ইত্যাদি ক্ষুদ্র ভাষার অবস্থা মরণোন্মুখ। সিকিমে মাঝি ভাষার চারজন মাত্র টিকে আছে, ত্রিপুরার চইমাল ভাষার আছে চার-পাঁচজন। ভাষাবিদদের আশঙ্কা–পৃথিবীতে এখন যে ৬ হাজার ৯০০টির মতো ভাষা বিদ্যমান, তার অর্ধেকই এই শতাব্দীতে শেষ হয়ে যাবে।
ক্ষুদ্র ভাষাভাষীদের বৃহৎ ভাষার কাছে হেরে যাওয়ার পেছনে নানা কারণ রয়েছে। প্রথমত, এরা শুধু ভাষাগত দিক দিয়েই দুর্বল নয়; এরা অরাজনৈতিক, প্রযুক্তিহীন, অনাগরিক জীবনের অধিবাসী। দ্বিতীয়ত, এরা বিক্ষিপ্ত; এদের সামাজিক সংহতি নড়বড়ে এবং নিজেদের ঐতিহ্যের প্রতিও এরা অননুরক্ত। তবে যেসব ক্ষুদ্র ভাষাগোষ্ঠী আত্মসচেতন ও সুসংহত তাদের কেউ কেউ বৃহৎ ভাষাগোষ্ঠীকেও আকর্ষণ ক’রে থাকে। বৎসোয়ানাতে ক্ষুদ্রতম ভাষা থিম্বুকুশু তাড়িত করছে বৃহত্তর শিয়েরিভাষীদের। ফলে শিয়েরিভাষীরা দ্রুত কমছে, থিম্বুকুশুরা বাড়ছে।
একটি ভাষার টেকসই হয়ে ওঠার পেছনে কাজ করে ভাষাটির ব্যবহার কীভাবে করা হচ্ছে তার ওপর। যখন কোনও ভাষা উচ্চশিক্ষা, উচ্চ-আদালত, প্রশাসনিক ও কূটনৈতিক যোগাযোগ, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-সাহিত্য, ও ধর্মচর্চায় বহুলভাবে ব্যবহৃত হয়, তখন সে ভাষার অবস্থান অনেকটাই নিরাপদ বলা যায়। যদিও সর্বস্তরে চালু হয়নি, তারপরও বাংলাদেশে বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে শঙ্কিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ নেই। সেই ফাঁড়া বহু আগেই বাংলাদেশ কাটিয়ে উঠেছে; তাছাড়া এখানে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃত হওয়ায় যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবেও বাংলার বিকল্প নেই । কিন্তু ভারতের পশ্চিমবঙ্গে বাংলা ভাষা মোটেও সুরক্ষিত নয়। যে পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা একদা ছিল বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের রাজধানী, সেখানেও বাংলার স্রোত রুদ্ধ হয়ে পড়ছে। কলকাতার উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত, মোটামুটি সচ্ছল পরিবারের সন্তানদের শিক্ষার মাধ্যম হয়ে উঠেছে ইংরেজি। এরা বাংলা বই, বাংলা পত্রিকা পড়ে না। আরও আশ্চর্যের কথা, বাংলা না জানাটাও এদের কাছে অগৌরবের নয়। ঊনবিংশ শতকের ইংরেজিয়ানায় আবৃত ইয়ংবেঙ্গল গোষ্ঠীর সদ্যশিক্ষিত যুবকেরা যেভাবে বাংলা ভাষাকে হীন ও গ্রাম্য মনে করেছিল তার পুনরাবৃত্তি ঘটতে দেখা যাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের সর্বত্র। এমতাবস্থায়, আশঙ্কা করা হচ্ছে, আগামী এক যুগ পর বাংলা ভাষা পশ্চিমবঙ্গ থেকে হারিয়ে যেতে পারে। তবে এমনটা যাতে না ঘটে, এই বিষয়ে বাংলা ভাষার পণ্ডিতদের সোচ্চার হতে হবে। সুপরামর্শ দিয়ে সরকারকে সঠিক পদক্ষেপ নিতে সহায়তা করতে হবে। এ-বিষয়ে মার্কিন ভাষাবিদ কেন্নেথ হল (Kenneth Hale)-এর একটি উক্তি স্মর্তব্য–‘যখন একটি ভাষা হারিয়ে যায়, তখন একটি ভূখণ্ডের সংস্কৃতি, বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ, শিল্পকর্মও হারিয়ে যায়। এটা অনেকটা ল্যুভর মিউজিয়ামে বোমা নিক্ষেপ করার মতো ব্যাপার।’
তথ্যপঞ্জি
১.সিকদার, সৌরভ, ২০১২, বাংলাদেশের বিভিন্ন নৃ-গোষ্ঠীর ভাষা, দ্র. ইসলাম ও সরকার (সম্পা.), ২০১২, পৃ ২০৩-২২৬।
২. বসু, বুদ্ধদেব, ভাষা, কবিতা ও মনুষ্যত্ব, বুদ্ধদেব বসুর শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ।
৩. শারদীয় সংখ্যা, অহংকার, বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ (সম্পাদকীয়)।
৪. Carawford, James, Seven hypotheses on Lang loss causes and cures. Google অনুসন্ধানে প্রাপ্ত।
৫. Lam and Beck, language loss and linguistic suicide: a case study from the sierra Norte de Puebla, Mexico. Google অনুসন্ধানে প্রাপ্ত।
৬. Crystal, David, 2003, language death, Cambridge University Press.