সোমবার, ১৫ মার্চ ২০২১, ০৫:২৭ অপরাহ্ন
ফারুক ওয়াসিফের কবিতা
চাঁদ
আমার বুকের থেকে
একটি চাঙর খ’সে
উপগ্রহ হয়ে যায়।
সে যদি আমার না-ই হয়,
কী করে পাথর হবে প্রিয়,
কী করে দুজন থাকি নিকট দূরত্বে?
আর, কী উপায়ে রোজ রাতে চাঁদ
জোয়ারে জোয়ারে সব ঋণ শোধে;
পৃথিবীর ক্ষতস্থান জলে ভরে তোলে!
তিলাঘুঘু
কুয়াশার ঘূর্ণি ঘেরে আমাকে আবার
চিলমারী বন্দরের বালি ধুয়ে যায়
অন্ধকারে ছুটে যায় ভেজা ট্রেন—ডাকে
ট্রেন থামে বৃষ্টি থামে, যাত্রীরাও নামে;
আমি নামি না কোথাও
আমি যাচ্ছি যতদূর ততদূর পিছুডাক এসে
রাখে না পিঠের পরে চেনা হাত,
স্মৃতির ছায়ারা প্রসারিত হয়ে ছুঁতে পারে
এমন গোধূলী সুর্য সেখানে জ্বলে না।
ছোটো ছোটো শহরের আলো-অন্ধকার ছুঁয়ে ছুঁয়ে চলে যাচ্ছি
ঝড়ের শিসের মতো গর্জনিয়া নদী থেকে দূরে,
খাতা খুলে বসে থাকা স্টেশনমাস্টার কি জানে গন্তব্য আমার?
তার লগবুকে লেখা আছে কোন স্টেশনের নাম?
বাতাসের স্রোতে তিস্তার বালু ধুয়ে যায়,
চরের রহস্যরোদে বেদনা-ডালিম কেন ফাটে,
হঠাৎ দৃশ্যটা দেখে ঈশ্বরের মন করে হুহু—
ঘুরে ঘুরে বাথানের বালি খুটে খাই
আমি আর তিলাঘুঘু।
পিঁপড়াকুলের মানুষ
হে বিজ্ঞ পিঁপড়া, আমিও তোমার কুলের মানুষ।
কৃষক যেভাবে উবু হয়ে রোয়া বোনে ধীরে
যেভাবে পুরুষ নতমুখে চুমু খায় আপন নারীকে
আমাকে শেখাও সেসব বিনীত নিয়ম
কতটা সামান্য হয়ে বাঁচা যায় দেখি।
অতিকায় প্রাণীসব উবে গেছে কবে;
হৃদয়ের বনে তবু অতিকায় বাসনারা দেয় ডাক—
ডালপালা ভাঙে…
বড় লোভ, বড় ভয়ে কেবলই বড় হতে চেয়েছে মানুষ;
নিশ্চল সন্ন্যাসে শেষে ঝুলে আছে আকাশের দিকে।
তার নিচে,
পতঙ্গের পায়ে চলা পথে
জলের গড়িয়ে নামা দাগে
রেশমের উড়ালের গানে
অংকুর ফাটার মৃদু শব্দে,
আরম্ভ আজান শুনি আমি।
হে বিজ্ঞ পিঁপড়া,
গাছের বাকল শুঁকে উঠে যাচ্ছ তুমি,
আমাকেও ডেকে নাও তোমাদের ঘনিষ্ঠ সমাজে।
পাথরের ঘ্রাণরেখা ধরে উঠে যাচ্ছ একা,
—উনি বিষাদের নবী।
ম্লান ধ’রে আছে বিলয়ের ভর নিয়ে,
আইসোলেশনে আছেন বহুকাল।
পিঁপড়াকুলের জনসাধারণ, বলো
একাকীত্বে ভয় নাই তোমাদের?
সোরার পাহাড়ে আগুনের তাঁবু গোটাব এবার—
পিঁপড়াকুলের মানুষ ছিলাম আমি, আমাকেও দলে নাও,
ততদূর একসঙ্গে হাঁটি যতদূর জল ও মাটি সহায় ।
অদৃশ্য খুনের সাক্ষি
বিষমাখা এই বরফের ছুরি
তাপানো সন্ধ্যায় হাতে নিয়ে ঘুরি
পদচ্ছাপ ফুরিয়েছে সকালে যেখানে—
যার পরে শুধু কমাচিহ্ন ভরা পাথরের জমি
যেখানে উঠেছে কুয়াশার রক্তহীন শ্বেত স্মরণিকা
আমার সময় সেখানে আবার ফেরত আসবে কাছেই আমার
মৃত কবিদের সমাধি ফলক ধরে ফুঁপিয়ে কাঁদবে সব অমর কবিতা
মুখবন্ধ কুয়া থেকে হারানো গয়না মুখে উঠে আসবে যত কুয়াঝরানি যুবকেরা
বোয়াল, হরিণ আর আনাজের পেট চিরে পড়া হবে সভ্যতার শেষ সতর্ক সংবাদ
গৃহযুদ্ধ আর দাঙ্গার আগুনে পোড়া যত দুহিতা সকল আছড়ে পড়বে উঠানে আমার
ক্ষতচিহ্ন মুখে জন্মানো শিশুরা ঘিরে ধরে বলে যাবে, বুজে দাও বাবা ক্ষতের দোয়াত!
দুঃস্বপ্ন থেকে জাগা বিষাক্ত লতাগুল্মেরা পেঁচিয়ে ধরবে জগতের শুদ্ধতম কবির জবান
আসবে না ফিরে দিন, সময়ের দাঁড় ছেড়ে উড়ে যাবে ইতিহাসভেদী পাখির দল
চোখের পাতার নীচে লেখা হবে গোপন ঠিকানা, শ্বাসে আর মিশবে না কারো শ্বাস
সেদিন আমাকে কিছুই বলার থাকবে না হে কয়লাগুড়া ওড়ানো মহাকাল
বরফের এই ছুরি যদি সেই দিন বিদ্ধ করি ঠিক বুকেতে আমার
বিষমাখা বরফের ফলা ক্বলবে খোদাই করবে নিরাকার নাম
কালের ধুতরা বিষ রক্তে মিশে যাবে মিহি ফোঁটায় ফোঁটায়
শুধু ব্যথা দেখা যাবে, ক্ষতস্থানে ফোটা জবা দেখা যাবে
অদৃশ্য ছুরিটা ধীরে ধীরে গলে যাবে হৃদয়ে আমার।