সোমবার, ২১ জুন ২০২১, ০৫:৩৭ পূর্বাহ্ন
নির্ঝর নৈঃশব্দ্য-এর অনুবাদ কবিতা
A Hard Rain’s A-Gonna Fall
—বব ডিলান
১৬ বছর আগের কথা। আমার ক্যাম্পাসের বন্ধুরা তখন ‘পরস্পর’ নামে একটা ছোটকাগজ করতো। প্রীতম, শাহীন, সুমাদ্রী, বাণীসহ আরও কয়েকজন। ওই কাগজের জন্যেই মূলত বব ডিলানের এই গানটির অনুবাদ করেছিলাম। খাতায় লেখা অনুবাদের তারিখ ৮ মে, ২০০৫ সাল।
‘And it’s a hard rain’s a-gonna fall’–এই লাইনটার অনুবাদ করেছিলাম ‘আর এই মেঘদল কাঁদে আজ ঝুমঝুম কষ্টসুখে’। এটা নিয়ে একটু অসন্তুষ্টি ছিল আমার। মনে হতো মূল ইংরেজির তুলনায় আমার অনুবাদ কোমল হয়ে গেছে। হার্ড রেইনের আসলে কঠিন কোনও অনুবাদই দরকার। এইটা নিয়ে আবার বসার সময়-সুযোগ পাই নাই, বা ওভাবে বসা হয় নাই। এর মধ্যে আমার বন্ধু অরিত্রও একই কথা বললো। তাই লাইনটার অনুবাদ আবার করলাম।
এই গানটা বব ডিলানের হলেও আমার শুরু থেকেই, মানে যখন থেকে শুনি তখন থেকেই জোয়ান বায়েজের কণ্ঠে শুনতে ভালো লাগতো। কেন ভালো লাগতো তার উত্তর আমার কাছে নাই। এখনও জোয়ান বায়েজের কণ্ঠেই ভালো লাগে।
যাইহোক, এই গানের অজস্র বাঙলা অনুবাদ দেশের অনেক বড় বড় কবি ও অনুবাদকের হাতে হয়েছে। সেইখানে আমার মতো অভাজনের এই অনুবাদটাও রইলো। এই অনুবাদ আমি অনেক মমতা নিয়ে করেছিলাম। আর এইটাই খুব সম্ভবত আমার করা প্রথম অনুবাদ।
———
আর ঝমঝম ঝমঝম বৃষ্টি পড়ে পৃথিবীর বুকে
আহা কোথায়, তুমি কোথায় ছিলে আমার নীল নয়ন?
কোথায়, কোথায় ছিলে, ও আমার বুকের ছোট্ট ধন?
আমি হাতড়ে ফিরেছি বারোটি কুহেলি পাহাড় রথে,
হেঁটেছি আমি, হেঁটেছি বুকে, ছয়টি ধূর্ত রাজপথে।
আমি যে হেঁটেছি দুখিনি সাতটি বনের বুক চিরে,
দাঁড়িয়েছি এসে বারোটি মৃত মহা সাগরের তীরে।
দশ হাজার মাইল হেঁটে এসে থেমেছি কবরের মুখে,
আর ঝমঝম ঝমঝম বৃষ্টি পড়ে পৃথিবীর বুকে।
আহা, কী তুমি দেখেছো বলো আমার নীল নয়ন?
কী তুমি দেখেছো ও আমার বুকের ছোট্ট ধন?
আমি তো দেখেছি নতুন শিশু, ঘিরে আছে নেকড়ে দল,
আমি তো দেখেছি হিরে বিছানো রাজপথ—নেই কোলাহল।
আমি তো দেখেছি আঁধার ডাল এক—ফোঁটা ফোঁটা রক্ত ধরে,
দেখেছি ঘরভরা মানুষ, মুগুরে তাদের রক্ত ঝরে।
আমিতো দেখেছি জলে জড়ানো শাদা সিঁড়িটা,
দেখেছি দশহাজার কথক—জিহ্বা কাটা।
আমি দেখেছি শিশু—পূর্ণ দু’হাত তলোয়ার-বন্দুকে,
আর ঝমঝম ঝমঝম বৃষ্টি পড়ে পৃথিবীর বুকে।
আহা, কী শুনেছো বলো ও আমার নীল নয়ন?
কী শুনেছো তুমি, আমার বুকের ছোট্ট ধন?
আমি শুনেছি বজ্রনাদে সাবধান করে কেউ,
শুনেছি সমস্ত ডুবিয়ে গর্জে উঠছে ঢেউ।
শুনেছি শত হাত জ্বলে-পুড়ে বাজায় বাজনা,
শুনেছি হাজার দশ ফিসফাস, কেউ শোনে না।
শুনেছি একজন ক্ষুধায় কাতর, অনেকে হেসে যায়,
শুনেছি এক কবির গান—যে মরেছে নর্দমায়।
শুনেছি এক ভাঁড় হাহাকার করে অন্ধগলির মুখে,
আর ঝমঝম ঝমঝম বৃষ্টি পড়ে পৃথিবীর বুকে।
আহা, কার সাথে দেখা হয়েছিলো, ও আমার নীল নয়ন?
কার দেখা পেয়েছিলে তুমি, আমার বুকের ছোট্ট ধন?
টাটুঘোড়াটির শবের পাশে আমি ছোট এক শিশুতে মিলেছি,
একটি কালো কুকুরের পাশে শ্বেতাঙ্গ এক হাঁটছে দেখেছি।
মিলেছি এক যুবতীর সাথে—যার পুড়েছিলো দেহতনু,
আমি মিলেছি এক কিশোরীর সাথে, সে দিয়েছে রংধনু।
দেখেছি একলা প্রেমিক হয়েছে প্রেমাহত,
আমি দেখেছি আরেকজন ঘৃণাতে আহত।
আর এই ভীষণ ভীষণ ভীষণ, ভীষণ বৃষ্টি বুকে,
আর ঝমঝম ঝমঝম বৃষ্টি পড়ে পৃথিবীর বুকে।
আহা, কী করবে এখন তুমি, আমার নীল নয়ন?
কী করবে এখন, ও আমার বুকের ছোট্ট ধন?
আমি তো ফিরছি, বেরিয়ে ফিরছি, বৃষ্টি নামার আগে,
আমি হাঁটবো গহন কালো বনের গভীর অনুরাগে—
যেখানে অনেক মানুষ আছে—সকলে খালি হাত
যেখানে বিষের বড়ি তাদের ডুবায় জলসাথ
যেখানে পাহাড়ি ঘরখানি মিলে জেলখানার পাঁকে
যেখানে জল্লাদের মুখ চিরদিন লুকোনো থাকে
যেখানে ক্ষুধা বিচ্ছিরি, যেখানে আনমনা
যেখানে রং মানে কালো, নাই মানে গণনা
আর আমি বলবো ভাববো বলবো, নিশ্বাসে নেব সেই কথা,
সবাই দেখবে, পাহাড় হতে প্রতিফলিত হবে সেই কবিতা।
তারপরে সাগরে প্রতীক্ষা—যতকাল ডুবে যেতে লাগে,
গানখানি তবে জেনে নেবোই আমি—গাইবার আগে আগে।
আর এই ভীষণ ভীষণ ভীষণ, ভীষণ বৃষ্টি বুকে,
আর ঝমঝম ঝমঝম বৃষ্টি পড়ে পৃথিবীর বুকে।