সোমবার, ২৯ মার্চ ২০২১, ০৯:১৩ অপরাহ্ন
চোখ
বেশ লম্বা একটা সময় ধরে ছেলেটা পড়ে আছে। লাশকাটা ঘরটায় আজ কতদিন সেটা তার অনুমানের বাইরে। তবে এইটুকু সময়ে, সে কম করে হলেও কয়েকটা লাশের কাটাকুটি দেখে ফেলেছে। আরও কিছু লাশ পড়ে আছে ডোমেদের অপেক্ষায়। আসলে ছেলেটা ভুল করছে; ‘ডোম’ শব্দটার আজকাল তেমন আর ব্যবহার নেই। শব্দটা এখন মর্গ অ্যাসিস্টেন্ট। অবশ্য এটা জানবার কথাও নয় তার। কারণ জানবার আগেই সে তো খুন হয়ে গেল কচি বয়সে।
বিয়ে করতে গেলে নাকি শুভ দিন লাগে, শুভলগ্ন লাগে, তিথি লাগে। এই পৃথিবী অনন্তকাল ধরে চলতে থাকলেও এর শুভ তিথিগুলো হয়তো হাতে গোনা। তাইতো সে দেখে এসছে বিয়ের লগ্নে একই সাথে অনেক বিয়ে হতে। এ-সমস্ত ভাবতে ভাবতে ছেলেটার মনে হঠাৎ প্রশ্ন জাগে—আচ্ছা মৃত্যুর জন্যও কি তিথি লাগে? শুভতিথি? কিংবা খুন হতেও? মরতেও যদি শুভতিথি লেগে থাকে এই সংসারে তবে আজকে হয়তো তেমনই একটা দিন। কারণ এই মোতাবেক তার আশেপাশে আরও অনেক লাশ পড়ে আছে এবং আরও আসছে বলেই সে শুনতে পেয়েছে। আর ডোমদের ব্যস্ততাও কিন্তু একই দিকে ইঙ্গিত করছে বারবার। ডোমদের মধ্যে অনেকেরই উপরি কামাই হচ্ছে দেখে বেশ খুশিতেও আছে; আবার কাজের বাড়তি চাপে খিস্তিও করছে ক’জন খুব। এক কোণায় পড়ে থেকে ছেলেটা তাদের লাশ কাটার ব্যস্ততা দেখছে। হয়তো খুব শীঘ্রই তারও সুযোগ হবে তাদের ব্যস্ততায় সঙ্গী হওয়ার।
আজ থেকে কয়েক সপ্তাহ আগের ঘটনা—একটা বড় ঔষধ কোম্পানির শীতল রুম। করিডোরের আলোতে দেখা যায় সেই রুমের উপরে লেখা “জরুরী ঔষধ সংরক্ষণাগার”। দুটো ছায়ামূর্তি সেই রুমের ভেতরে। তাদের একজনের গায়ে সাদা কোট, বোঝা যাচ্ছে ল্যাবের কেউ। অন্যজনের চেহারা দেখা না গেলেও বেশ বোঝা যাচ্ছে বহিরাগত কেউ। কোটপরা লোকটা একটা বড় বোতল বের করে এনে ওই বহিরাগতকে জিজ্ঞাসা করল, “কতখানি দেব?” চেহারা স্পষ্টভাবে দেখা না গেলেও বোঝা যাচ্ছে লোকটা কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। মনে মনে একটা হিসেব কষার ব্যর্থ চেষ্টা করার পরপরই চটজলদি মোবাইলটা বের করে পর্দায় চকিত চোখ বুলিয়ে দ্বিধাহীনভাবে বলল, “চার আউন্স হলেই হবে।”
কোটপরা মানুষটি কেঁপে উঠলো কথাটা শুনে। একি! এ-তো কোনো পুরুষ কণ্ঠ নয়। স্পষ্ট মনে হল একটা মেয়ে কথা বলে উঠেছে। এতোটা মিহি তার স্বর যেন এইমাত্র কোন গানের পাখির কাছ থেকে কথা শিখে এসছে সে। বড় বোতল থেকে তরল ঢালতে ঢালতে কোটপরা লোকটা কেমন অবিশ্বাস্যভাবে হুডপরিহিত মানুষটার দিকে তাকিয়ে আছে।
গত পরশুদিনের ঘটনা—বিশাল ডাইনিং টেবিলের চার কোণায় বসে আছে চারজন। একজন বেশ সুন্দরী মেয়ে টেবিলে খাবার পরিবেশন করছে। চলে যাবার সময় সে একটা ভ্রু-তোলা হাসি দিয়ে মিহি স্বরে জিজ্ঞাসা করল, “স্যার, এছাড়া আর কিছু কি লাগবে?” প্রশ্নের কোনো উত্তর না পেয়ে সে নীরবে তাদের সামনে সুপের বাটি নামিয়ে রেখে ডাইনিং রুম ছেড়ে যাবার পরপরই পাশের জানলা দিয়ে কিছু একটা বাইরে ছুড়ে ফেলে দিয়ে দরজা দিয়ে সোজা বেরিয়ে চলে গেল। তবে তার হাসিটা খেয়াল করেছিলেন তিনজনের মাঝে শুধু একজন—পূর্বদিকে বসে থাকা বয়স্ক লোকটি।
আগেই বলেছিলাম, ডাইনিং টেবিলের চার মাথায় চারজন মানুষ। অবশ্য কেউ কারো সাথে কথা বলছে না। চুপচাপ খাচ্ছে কিংবা খাওয়ার ভান করছে। তাদের মাঝে একজন আছেন যাকে সুন্দরীই বলা যায়; তিনি কিছুটা চিন্তিতভাবে খাবার নাড়াচাড়া করতে করতে বাকি তিনজনের চোখের দিকে তাকাচ্ছেন বারবার। টেবিলের পূর্বদিকে বসে আছেন যিনি, তিনি একজন সাদা চুলের বয়স্ক লোক, তবে সুঠাম দেহের অধিকারী। চোখে চশমা পরে বই পড়বার ফাঁকে ফাঁকে খাবার খাচ্ছিলেন আর আড়চোখে সুন্দরীকে দেখে বোঝার চেষ্টা করছিলেন কেন সে চিন্তিত। তার চোখ দুটো এতোটা স্বচ্ছ আর পরিষ্কার যেন অন্তর্যামী, যেন সমস্ত ব্রহ্মাণ্ড তার পায়ের কাছে; কিন্তু তাতেও তার কোনো লোভ নেই। ঠিক তার বিপরীতে বসে আছে যে, সে একজন অসম্ভব ছটফটে তরুণ। খেতে খেতেই পা দোলাতে দোলাতে পুরো টেবিল কাঁপাচ্ছে এমনভাবে যেন এটা তার উদ্দাম রক্তের বহিঃপ্রকাশ। এই তরুণের চোখ এতোটাই মায়াভরা যে, যে-ই একবার দেখেছে তার কাছেই মনে হয়েছে কোন অমল স্বর্গীয় আলো দেখছে তারা। টেবিলের দক্ষিণে ওই সুন্দরীর অপর প্রান্তে যিনি বসে আছেন তিনি একজন লম্বা সুদর্শন মানুষ। তার চোখও অদ্ভুত সুন্দর, সেই ছটফটে তরুণেরই মতো। এবং কোথায় যেন একটা সূক্ষ্ম মিল আছে সেই তরুণ আর সুদর্শন মানুষটার মধ্যে, বিশেষ করে মণিজোড়ায়। যদিও এই মানুষের মণি দেখতে অদ্ভুত রকমের শীতল কিন্তু জ্বলজ্বলে। মনে হচ্ছে যেন আস্ত সূর্যকে কেউ শীতল স্বচ্ছ পুকুরে ডুবিয়ে দিয়েছে। ব্যাপারটা এমন যে তাতে সূর্যের মাঝে শীতলতা এলেও উজ্জ্বলতার এতটুকুও কমতি নেই। এই লোকের মধ্যেও ওই সুন্দরীর মতো কোথায় যেন একটা উৎকণ্ঠা খেলা করছে ক্রমাগত। তার সাথে রূপসীর চোখাচোখি হয়ে গেলে তারা একজন আরেকজনের দিকে এমনভাবে তাকালেন যেন নিঃশব্দে কোন ভয়ংকর সিদ্ধান্ত নিয়ে নিচ্ছেন। তাদের এই ভয় পাওয়া চোখাচোখির ব্যাপারটা দেখে ফেললেন সেই সাদা চুলের লোকটি। অন্তর্যামীর মতো কিছু একটা বুঝে নীরবে একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করলেন তিনি।
ছটফটে ছেলেটা সুপটা ফেলে উঠতে গেলেই সুন্দরী কেমন ভয় পেয়েও কণ্ঠস্বরকে যতটা স্বাভাবিক রাখা যায় ঠিক ততটাই স্বাভাবিক রেখে মিহি স্বরে বললেন, “তোমাকে সুপটা পুরোটা খেতে হবে। তুমি জানো তোমায় অনেক ভালবাসি। কিন্তু অন্তত এবার ক্ষমা কর, না খেয়ে তোমার চলে যাওয়ার অনুমতি দিতে পারছি না বলে। রাগ কোরো না লক্ষ্মীটি।” বাধ্য ছেলের মতো টুক করে সুপটা খেয়ে নিয়ে একটা হাসি দিল তরুণ। হাসিটা এমন যেন সে কোন কালেই রাগ করতে জানত না, যেন সে অনুমতি না দেয়ার কারণ সবটাই বুঝতে পেরেছে, যেন সে ভালবাসাটা অনুভব করতে পেরেছে।
ডোমরা খুব ব্যস্তভাবে হাত চালাচ্ছে। মর্গে আজ লাশের ভিড়। অন্য লাশ কাটতে কাটতে এক সময় ছেলেটার কাছে এসে দাঁড়ায় একটা ডোম। লাশের খুলে যাওয়া চোখ দেখে আরেক ডোমকে ডেকে বলে, “দেখ্ দেখ্, চোখগুলা কী সুন্দর! যেন আলো ঝলসায় বাইর হইতেছে। এমনে তাকায় থাকলে তো কাটতে পারুম না রে!” আরেক ডোম যে কাজের চাপে খিস্তি করেই যাচ্ছিল, সে এসে মাথা ঢুকিয়ে প্রথমে ছেলেটার লাশের দিকে তাকিয়ে আবার সতীর্থদের দিকে তাকাল। কিছুটা বিরক্তি নিয়েই হাতের যন্ত্র দিয়ে চোখ দুটোতে সজোরে বাড়ি দিয়ে খিস্তি করল, “চোখ দেইখা লাশ কাটতে পারস্ না? ঢং করস্? এতগুলা লাশ কি তোদের শ্বশুর আইসে কাটবনি রে? যা দেখ্, এক্ষণ চোখও নাই, জ্বালাইবও না।” অন্য ডোমগুলো রেগে তেড়ে উঠলে সে কালচে দাঁত দেখিয়ে বিচ্ছিরিভাবে হেসে বলে, “চিন্তা করস্ ক্যা এত্ত? আত্মীয়-স্বজন জিগাইলে কইবি চোখ পইচা গেছে; আর ডাক্তাররে কইবি এমুন থ্যাতলানোই আইছিল। যা, এইবার কাট্ গা।”
এক চোখের মণি গেলে যাওয়া ছেলেটার আরেক চোখ আধখোলা হয়ে থাকে। সেই চোখ দিয়ে সে তার লাশের ব্যবচ্ছেদ দেখতে থাকে—অবাক, অনুভূতিহীন।