সোমবার, ২৯ মার্চ ২০২১, ০২:৪০ অপরাহ্ন
খেলা শুরু ফাইনাল
১
সেই ছোটবেলা থেকেই বর্ষাকাল আমার কাছে ফুটবল-কাল। আষাঢ় মাস ঢুকলে, প্রথম বৃষ্টি পড়া শুরু হলে মনের গভীরে জাম্বুরা ফুল ফোটে। আষাঢ় গিয়ে শ্রাবণ আসে। একনাগাড়ে বৃষ্টি পড়ে। বৃষ্টি তখন রবি শংকরের সেতার কিংবা আমজাদ আলী খানের সরোদ হয়ে যায়। তাঁদের বাজনা থামেই না। কলি থেকে ফুল হয়। জাম্বুরার গোটা ধরে। তারপর বড় হতে থাকে। তাতে কোষ হয়। পেকে একেকটা কোষ লাল লাল আর রসে টুসটুসে হয়।
আমার ভেতরে শৈশবের ছেলেটি জাম্বুরার চামড়া ছোলে। চোখের সামনে এনে কোষে চাপ দেয়। রস পড়ে চোখে। ঝাঁজের কারণে চোখ বন্ধ করে ফেলি। চোখ বন্ধ করলেই এসে যায় ছোটবেলা। কোষ টিপে জানতে চাই আমাদের দল জিতবে কিনা। রস লাফিয়ে উত্তর দিকে গেলে জিতবে, দক্ষিণে গেলে হারবে। দেখা যায় রস কখনো পশ্চিমে যাচ্ছে, কখনো পুবে। এ নিয়ে হাসি-ঠাট্টা চলে।
বর্ষাকালে আমি জাম্বুরার রসের মতো হয়ে যাই। বৃষ্টি পড়ে আর আমার পা দুটো আপনা-আপনি নাচে। গোলকিপার হলেও আমার কেবল গোল দিতে ইচ্ছে করে। যখন একা হই, ঘরে হোক কি টয়লেটে, নানা কারুকাজ করে মনে মনে বল মারি। কতবার কত চমৎকার সব গোল দিয়েছি, তার হিসেব নেই।
ছোটকালেরও কোনো হিসেব থাকে না। বেহিসেবি সেই দিনগুলো প্রাইমারি স্কুলের মাঠ হয়ে যায়। মাঠে দাঁড়িয়ে কমলা বাঁশিটা ঠোঁটে চেপে বাবু ভাই আমাদের ইশারা করেন। গরু যেভাবে হাম্বা ডাকে, তেমন জোরে ডাক দিয়ে সবাইকে এক লাইনে দাঁড় করান। তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে প্রশ্ন করেন, ম্যারাডোনাকে দেখেছিস?
আমরা মাথা নাড়ি। বেশিরভাগই দেখেছি।
খেলোয়াড় হলে তার মতোই হতে হবে। বলে সবাই লাথি মারতে পারে। আউল-ফাউল লাথি মেরে লাভ আছে?
আমরা বলি, নাই।
ওই বেতঝোপটা দেখ। বেতে কী আছে?
কাঁটা।
বেতগাছে কেউ উঠতে পারবি?
সবাই মাথা নাড়ে।
অশ্বত্থগাছ দুটো দেখ তো। আরেকটু বড় হলেই তরতরিয়ে উঠে যেতে পারবি।
আমি বলি, বাবু ভাই, আলতা মিয়া উঠতে পারে।
তিনি হাসিমুখে বলেন, অশ্বত্থগাছের কোনো অস্ত্র নাই। বেতগাছের অস্ত্র হলো কাঁটা। বল খেলবি, তোদেরও অস্ত্র লাগবে। অস্ত্র হলো কৌশল। অস্ত্র কীভাবে বাড়াতে হয় আমি শেখাব।
আমরা বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। সবার চোখ বাবু ভাইয়ের দিকে। হেঁটে হেঁটে প্রত্যেকের চোখের দিকে তাকিয়ে তিনি বলেন, ছোটকাল হলো ঘাটা পুকুরের আইড় মাছ। থালা (গর্ত) বানিয়ে লুকিয়ে থাকে। জাল দিয়ে সহজে কেউ ধরতে পারে না। মাঠে থাকলেও তোরা নিজেদের লুকিয়ে রাখবি। আর খেলার সময় হবি বাইন মাছ। তোরা তো খুব খেলা খেলা করিস। অনেকের বাবা-মা বাধা দেয়। কিন্তু কেউ তোদের থামাতে পারছে?
সবাই একসাথে চিৎকার করি, না।
তখন বাবু ভাই বজ্রকণ্ঠে গান ধরেন, আমরা করব জয়…।
দুই হাত মুঠো করে আমরাও গাই।
আমাদের খেলা শুরু হয়েছিল কাগজ আর প্লাস্টিক মুড়িয়ে সুতলিতে বাঁধা বল দিয়ে। মা বল বানিয়ে দিত। কখনো আমরা কয়েকজনে মিলে বানাতাম। উঠানে, রাস্তায় আর ফাঁকা পেলে স্কুলের মাঠে চলত আমাদের খেলা। আরেকটু পর জাম্বুরায় এসে ঠেকে। এরপর বড়দের ফেলে দেওয়া পাম্পহীন ‘ফোঁতা’ বল দিয়ে খেলতাম।
আমি তখন পাইভে পড়ি। আমাদের বাড়ির বাবু ভাই কলেজে পড়েন। তিনি ‘সবুজ সংঘ’ নামে একটা দল গঠন করেছেন। দলের খেলোয়াড় পনেরজন। এদের কেউ ফোরে, কেউ ফাইভে, কেউবা সিক্সে পড়ে। স্কুলের মাঠে বড়রা খেলে, তাই সেখানে জায়গা হতো না। হালদা নদীর চরে আমাদের অনুশীলন শুরু হয়।
এভাবে প্রায় এক মাস চলল। বলটা দিয়েছিলেন বাবু ভাই। ওটায় বেশিক্ষণ পাম্প থাকে না। তাই সবার জন্য চাঁদা নির্ধারণ করা হলো। রাতে মাকে বললাম। মা বলল বাবাকে। বাজারে বাবার ছোট একটা দোকান আছে। তিনি রেগে বললেন, টিঁয়া কি গাছর ফাতা?
মা উল্টো খেলখেলিয়ে উঠেন, ফোয়া ন খেলি বুরা খেলিবু না? টিঁয়া দ।
বাবা টাকা বের করে দেন।
কয়েকদিনের মধ্যে টাকা জোগাড় হয়ে গেল। এক রোববার বিকেলে বাবু ভাই আমাদের নিয়ে বাজারে গেলেন। সবাই বলল, বাবু ভাই, ডিয়ার বল কিনেন।
একেক দোকানে যাই, দোকানের বাইরে ঝুড়িতে ঝুলে থাকা বল দেখি। আমাদের মনে হয় পাকা সিঁদুরে আম ঝুলছে। খাওয়ার জন্য সবাই অধীর। বল কেনার পর সবার হাতে হাতে ঘোরে। আমরা বুকে জড়াই, বলের উপর হাত বুলাই। কিছু টাকা হাতে ছিল। হারুন সওদাগরের দোকানে চা দিয়ে তেলে চুবানো গরম গরম পরোটা খাই।
একদিন শুনলাম চৌমুহনী একতা সংঘ একটা টুর্নামেন্ট দিয়েছে। টুর্নামেন্টের নাম ‘পূর্ব ফরহাদাবাদ বিশ্বকাপ’। দল হবে আটটি—আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, ইতালি, জার্মানি, স্পেন, ফ্রান্স, ক্যামেরুন ও বাংলাদেশ।
বাবু ভাই আমাদের পনেরজনের মধ্যে এগারজনকে নিয়ে দল গঠন করলেন। আমাদের দলের নাম ব্রাজিল। ব্রাজিল হওয়ায় সবাই খুশি। ভালো ঠেকাতে পারি বলে প্রথম এগারতে গোলরক্ষক হিসেবে স্থান পেয়েছি।
রাতে ঘুমাতে গেলে স্বপ্ন এসে ঘিরে ধরে। ঘাটাপুকুরের পাড়ে বেতঝোপে হারিয়ে যাওয়া বলগুলো এসে আমার সামনে লাফায়। বাবু ভাইয়ের সব কথা মনে পড়ে। বাবু ভাই বলেন, তোরা তো এখনো বিশ্বকাপের খেলা দেখার সুযোগ পাসনি। আমি দুটো বিশ্বকাপ দেখেছি। জার্মানি, স্পেন— এরা বৃষের মতো দৌড়ে দৌড়ে খেলে। আর ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা হলো ছাগলছানা। মাঠে ছাগলছানা দেখিস না? দুই পা তুলে কীভাবে যে নাচে! ধরতে গেলি দেখবি তোদের নাচাচ্ছে।
বিকেলে হালদার চরে প্র্যাকটিস চলে। আমাদের একেকজনকে পাঠানো হয়। ধরতে যাই। ছাগলছানা একবার এদিকে আরেকবার ওদিকে লাফায়। আমাদেরকেও তিড়িং বিড়িং লাফাতে হয়।
ছাগলছানার ডাইভ দেওয়া দেখলি? বাবু ভাই জিয়লগাছে হেলান দিয়ে জিজ্ঞেস করেন। ছাগলছানার পেছনে যে দৌড়াচ্ছিল তাকে বলেন, যা, জুগিপাড়া থেকে এক জগ পানি নিয়ে আয়।
চিত্ত ডাক্তারের বউ পানির সাথে নাড়ু পাঠান। আমরা মজা করে খাই। খাওয়ার পর বাবু ভাই ছাগলছানার মতো লাফাতে দেন।
টুর্নামেন্টে নাম লেখানোর পর থেকে আমাদের সে কি অনুশীলন! কোনো মায়া-দয়া নাই। নানাভাবে দৌড়ানো, নদীতে সাঁতার কাটা, ডুব দিয়ে থাকা, আকাশের দিকে মুখ করে ভেসে থাকা— কত কী! কত মোষে-জোঁকের কামড় যে খেয়েছি!
একদিন আরেক কাণ্ড। বাবু ভাইদের সাদা-কালো একটা টিভি আছে। তিনি বাজার থেকে ভিসিআর ভাড়া করে আনলেন। কোত্থেকে ক্যাসেটও জোগাড় করেছেন। আমাদেরকে ব্রাজিলের খেলা দেখাবেন। কেউ খাটে, কেউ মোড়ায়, কেউবা পাটিতে বসলাম। শুরু হলো খেলা। সবাই গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখছি। দেখলাম, ম্যারাডোনা বল নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।
বাবু ভাই ‘হায় হায়’ বলে কপাল চাপড়ান। ব্রাজিলের বদলে তাকে দেওয়া হয়েছে আর্জেন্টিনার ক্যাসেট। আর্জেন্টিনা আর ক্যামেরুনের খেলা।
একটু পর তিনি বুঝিয়ে দেন, কোন খেলোয়াড় কীভাবে পাস দেয়, বল এগিয়ে নেয়, শট মারে, হেড দেয়। তারপর তিনি ম্যারাডোনা আর বাতিস্তুতার পায়ের জাদুর ব্যাখ্যা করেন, পেলের কথা বলেন। বলেন, খেললে ওভাবেই খেলতে হবে।
খরগোশের মতো সবার কান খাড়া। খেলা শেষ হলে বলেন, সবচেয়ে বড় কথা হলো মনের জোর। আমি পারব, আমি জিতব— এ বিশ্বাস না থাকলে খেলে কোনো লাভ নাই। বিশ্বাসেই অর্ধেক জয় এসে যায়।
বাবু ভাইয়ের মা সবার জন্য পাটিসাপটা পিঠা বানিয়েছেন। পাটিসাপটা দিতে দিতে বাবুকে বলেন, এবার থাম তো, ওদেরকে একটু ভাবতে দে।
একটু পর আসে ধোঁয়া ওঠা চা। সেই চায়ের সুঘ্রাণ অনেক বছর পরও আমার নাকে রয়ে গেছে।
বাবু ভাইয়ের কষ্টের ফল পেলাম টুর্নামেন্টে। একেক খেলায় জয় আসে আর আমরা বকের মতো উড়ে উড়ে স্বপ্নের ফুল ফোটাই। সেইসব দিন ঘোরের মধ্যে কীভাবে যে কেটেছে! কেবল জপের মধ্যে ছিলাম, ‘আমরা করব জয়।’ আমাদের কথায়, চোখে-মুখে, হাঁটায়-হাসায় রাতকেরানি বা হাৎস্নাহেনা ফুটে থাকত। সেই গন্ধ দিয়ে আমরা বল বানাতাম।
বড়রা সবাইকে উৎসাহ দিয়ে চলেছেন। সবাই বলছেন, আমরা বিশ্বকাপ জয় করব। আমাদের মনজুড়ে বসে থাকত আত্মবিশ্বাসী, শক্তিশালী একজন মানুষ। সে শুধু বলত, জয়, জয়, ব্রাজিলের জয়।
সেমিফাইনালের দিন আর্জেন্টিনার এক খেলোয়াড়ের শট ঠেকাতে গিয়ে ডান হাতের গিরা উঠে গেল। সে খুব কাছ থেকে জোরে শট মেরেছিল।
ভাঙা হাত দেখে মা মারলেন এক থাপ্পড়। বললেন, কোথায় ফাইনাল খেলবি, তা না, হাত ভেঙে বসে আছিস।
আলতা মিয়া ও আরো কয়েকজন আমাকে আফসার চাচার বউয়ের কাছে নিয়ে যায়। চাচি মিষ্টি হেসে বলেন, কোনো চিন্তা নাই। ফাইনালে তোমরাই জিতবে। যেন শিমুল তুলা নিয়ে খেলছেন— এভাবে গিরাটা বসিয়ে ব্যথার তেল মালিশ করে দেন। তারপর দেন ‘বারা বান’। বাঁশ কেটে চিকন ফলা বানিয়ে হাত সোজা করে সুন্দর করে বেঁধে দেন।
চাচি বলেন, আসিফ, হাত নাড়াবে না, এভাবে সপ্তাহখানেক রাখতে হবে। তিনি হাসলেন। কিন্তু আমার মনে কান্না। ফাইনাল যে খেলতে পারব না!
ফাইনাল খেলার দিন ছিল শুক্রবার। সকাল থেকেই বৃষ্টি পড়ছে। সবার মন খারাপ। কেউ বলে, টুর্নামেন্টটা বর্ষার আগে দিলে কী হতো? কেউ বলে, অসুবিধা নাই, আজ হবে কাদামাখা ফুটবল। আমরাই কাপ জিতব।
একনাগাড়ে পড়ে বলে আমাদের এলাকায় এটাকে বলে ‘পেরপেরানি’, মানে বাচাল বৃষ্টি। বাচাল বৃষ্টির মাঝেই অতিথি বক্তব্য দেন। কাদামাঠের এক পাশে দাঁড়িয়ে দুই দলের খেলোয়াড়দের সঙ্গে হ্যান্ডশেকও করেন। জাতীয় সঙ্গীত বাজল, শুরু হলো খেলা। স্বপ্নের ফাইনাল—ব্রাজিল বনাম বাংলাদেশ। চৌমুহনী একতা সংঘ হলো বাংলাদেশ। আমাদের সবুজ সংঘ ব্রাজিল। বাংলাদেশের সাপোর্টারই বেশি। তাদের কেউ কেউ টিটকারি মারে, ব্রাজিল হলো বেরাজ্যে, মানে যাযাবর। কাপ জেতা যাযাবরের কাজ না।
মাইকে বাজছে, খেলা শুরু ফাইনাল/ মাঠ থেকে জয়নাল/ উত্তরে ডালপুরি/ দক্ষিণে ঝালমুড়ি…
মোটা মোটা ঘাসে মাঠটা চমৎকার ছিল। কিন্তু বর্ষায় খেলার কারণে মাঠটা লোম ওঠা কুকুরের চামড়ার মতো হয়ে গেছে। খেলোয়াড়রা চিৎকার করে, বৃষ্টিতে ভিজে আর কাদায় মাখামাখি হয়। রেফারি বাঁশি বাজান। দর্শক হৈ চৈ করে। এর মাঝে কাদা ছিটকে পড়ে ভাষ্যকারের ঠোঁটে। ধারাভাষ্যের মাঝে তিনি ‘থু থু’ করেন আর সবাই হাসে। বল মারলে কাদায় আটকে যায় আর খেলোয়াড়রা ডস খায়। কিছুক্ষণ পর পর তারা আছাড়ও খায়। রেফারি দুইবার খেয়েছেন। তাকে মনে হচ্ছে বিভ্রান্ত চোখে তাকিয়ে থাকা কাদা মাখা মহিষ।
তেরপলের নিচে বসে আছি ভাঙা হাত নিয়ে। সবার চোখ খেলার দিকে। আমার চোখ দিয়ে টুপ টুপ করে পানি পড়ছে। ইচ্ছে করছে চিৎকার করে কাঁদতে। হাত ভেঙে দিয়ে আল্লাহ যেন আমার সাথে দুশমনি করেছেন। বেতকাঁটা নিয়ে খেলোয়াড়দের পায়ে ফুটিয়ে খেলাটা বন্ধ করে দিতে পারলে বেশ হতো।
ততক্ষণে ‘গোল গোল’ চিৎকার শুরু হয়েছে। কারা গোল দিল? গোলের আনন্দে সব চিন্তা টুটে যায়। গোল করেছে আলতা মিয়া। সবাই তাকে জড়িয়ে ধরে কাদায় ফেলে দিয়েছে। দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই বাংলাদেশ গোল দেয়। বিশ মিনিট পর তারা আরেকটি গোল দেয়। আমি থাকলে গোলটা দিতে পারত না।
খেলা শেষে আমরা বৃষ্টির ফোঁটার মতো কাদামাঠে মিশে যাই। কোনো সাড়াশব্দ নেই। আর বাংলাদেশের সে কি উল্লাস! একেকজনের নাচ দেখ, যেন জরিনা সুন্দরী। কষ্টের মধ্যেও আমাদের কেউ কেউ হেসে দেয়।
২
ঝুপঝুপ বৃষ্টিতে আবার এসেছে বর্ষাকাল। চলছে বিশ্বকাপ ফুটবল। চারদিকে মেসি, নেইমার, বল মার, বল মার রব। বর্ষাকাল এলে ঢাকায় থাকতে ইচ্ছে করে না। চাকরি-ফাকরি ভালো লাগে না। ইচ্ছে করে ঢাকার উপর ঢাকনা লাগিয়ে গ্রামের দিকে ছুটি।
আষাঢ়ে গল্পের মতোই বৃষ্টি। বৃষ্টিতে মাঠ-ঘাট ডুবে আছে। আমি হাঁটি। ছোটবেলার কাউকে দেখি না। আলতা মিয়া সৌদি আরব থাকে। তার তিন বছরের একটা ছেলে আছে। বউ মোবাইলে আরেকজনের সাথে প্রেম করে ছেলেকে রেখে পালিয়ে গেছে।
স্কুলের মাঠের পাশে বেতঝোপ নেই। বড় বড় অশ্বত্থ দুটো কখন কাটা পড়েছে জানিও না। মাটি ভরাট করায় গাছের গোড়াও দেখা যাচ্ছে না। হাঁটতে হাঁটতে ইচ্ছে করে অশ্বত্থ ফুলের বাঁশি বাজাতে। বাঁশি বাজালেই সবুজ সংঘের দলটা এসে হাজির হবে আর আমরা খেলতে শুরু করব।
নদীর পাড়ে গিয়ে দেখি যে চরে আমরা প্র্যাকটিস করতাম, চরটার বেশিরভাগ অংশ নদী খেয়ে ফেলেছে। এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকার মতো জিয়লগাছটা কোনোমতে টিকে আছে। বাবু ভাইয়ের কথা খুব মনে পড়ল। তিনি ছিলেন এলাকার সেরা স্ট্রাইকার। তার শট ছিল দেখার মতো। কখনো মিস হত না। একবার একটা শটে স্কুলের বাউন্ডারি দেয়ালে ফাটল সৃষ্টি হয়েছিল।
বাবু ভাইদের ঘরে গেলাম। আমাদের সবাইকে খুব উৎসাহ দেওয়া, আদর মাখা চোখে দেখা ডঁরমা (বড়মা) নেই।
বাবু ভাই দুবাই থাকেন। এখনো বিয়ে করেননি। আমার মনে হয় তিনি নদীর স্রোতের মতো বয়ে যাচ্ছেন। আমি আবার নদীর পাড়ে যাই। নদীর দিকে চেয়ে থাকি। হয়ত তিনি শুশুক হয়ে ভেসে উঠবেন আর গল্প শোনাবেন। গল্পের বেশিরভাগ জুড়ে থাকবে বল। কেননা ফুটবল তার কাছে গতিময় এক জাদুর খেলা। এই খেলা মানুষকে ইচ্ছেমতো নাচায়, হাসায়, কাঁদায়।
ছোটকালে বৃষ দেখলে আমরা বলতাম, জার্মানি। আমাদের ইচ্ছে করত জার্মানির মতো হতে। আবার নিজের দলের কথা মনে পড়লে বলতাম, ছাগলছানা ছাগলছানা/ দুই পা তুলে নাচে। ঘরে এসে দেখতাম, বড় আপা তার ছাত্রীকে পড়াচ্ছে, চলো ওকে ধরি/ কোলে তুলে আদর করি।
আমি জোরে জোরে বলতাম, চলো জোরে ছুটি/ এবার একটা গোল করি।
জীবনে কখনো গোল দিতে পারিনি। তবে এখনো আমাকে নানারকম গোল ঠেকাতে হয়।