সোমবার, ২৯ মার্চ ২০২১, ০৭:২৫ অপরাহ্ন
এ আগুন উত্তর-আধুনিক
রমজান আলী আর ভজন দাশ দুইটারেই আমার ভালো করে চেনা আছে। ফলে শুধুমাত্র তাদের মুখের কথায় না মজে পারসেপসনও কাজে লাগানোর চেষ্টা করবো, এটাই স্বাভাবিক। রমজান আমারে সেদিন কথা প্রসঙ্গে যা জানালো তার মূলকথা- ক্রিস্টিনার সাথে তার ভালোই চলছিল, ভজন মাঝে কাবাবের হাড্ডি হয়ে আইছে। ভজনের বক্তব্য, ক্রিস্টিনা স্বাধীনচেতা নারী। সে তার লগে খাতির দিছে। ভজনের দিক থেকেও কোনো সমস্যা নাই। ‘সো, হু ইজ রমজান আলী?’
আমি কাউরে আগ বাড়াইয়া কোনো উপদেশ দিতে যাই নাই। বিনামূল্যে সে মাল দিতেও আজকাল ভালো লাগে না। সময়টা বাবা বাজারি। নিজমূল্যের দিকেও নজর থাকা চাই। কিন্তু রমজান আলী বিষ খাইয়া যখন হাসপাতালে আসন গাড়লো ক্রিস্টিনা আর ভজন দাশ একের পর এক ফোন দিয়ে আমার কাঁচা ঘুম ছুটায়ে দিলো। মহাবিরক্তি নিয়ে রমজান আলীরে দেখতে গেলাম। টোয়েন্টি-টোয়েন্টির যুগে কি করে না করে! বোকচোদ।
ঢাকা শহরে হাসপাতালে যাবার জন্য গাড়ি ঠিক করা এক মহাপ্যানা। হাসপাতাল শুনলে অনেক গাড়িওয়ালারাই ভাবে, এইলোক ঠেইক্যা গ্যাছে…বাগায় ল…। এক আধবুড়ো রিকশাওয়ালাকে পেলাম। দেড়গুণ বেশি ভাড়ায় যেতে রাজি হলেন। তথাপি তাকে দেখে মনে হলো আমার মতো কৃপণ প্যাসেঞ্জার পেয়ে চরম বিরক্ত। আমিও ততোধিক বিরক্ত থাকার কারণেই কিনা ভদ্রলোক মুখে কিছু বলছেন না। নাহয় আরও দু’চার কথা শুনিয়ে দিতেন।
ঢামেক। গিয়া দেখি রমজান আলী মাটিতে পাটির উপর পড়ে আছে। বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। পাশে বসে ভজন দাশ। ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেছে খুব। কী করবে বুঝতে না পেরেই যেন কিছুক্ষণ পর পর রমজান আলীর কপালে হাত রাখছে। আহারে দরদ! উথলে উথলে পড়িচ্ছে। ভজনের সাথে বিশেষ কথা হলো না।
কিছুক্ষণ পর পারফিউমের কড়া সুবাস সমেত ক্রিস্টিনার সাবলীল আগমন। সে এক তরুণ ডাক্তারকে পাকড়াও করে আনছে। এখানকার এদেরকে পাকড়াও করেই আনতে হয়। আমারে দেখে হালকা হাসির রেখা দেখা গেলো তার ঠোঁটের কোনায়
– দাদা, আসছো?
– হ্যাঁ।
– দ্যাখছোতো কী কাণ্ডটা করছে! ক্যামন যে লাগে…
তরুণ ডাক্তার সব দেখেটেখে বললো, ‘ওয়াস ঠিকঠাক মতো হয়েছে। নো ওয়াটার। পানি খেতে চাইলে ভুলেও দেবেন না…’
ভজন দাশ হঠাৎ করেই বলে উঠলো, ‘ডক্টর আর কোনো স্টেপ নেয়া লাগবে?
তরুণ ডাক্তার তার দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসি হেসে বললো, ‘কী স্টেপ নিতে চান?’
ভজন দাশ একটু থতমত।
– না, মানে অ্যান্টিডোট জাতীয় কিছু ট্রাই করা লাগবে কিনা?
– হ্যাঁ, তা করতে পারেন। লিখে দিচ্ছি। দামটা ভালোই পড়বে।
মানি ইজ নট অ্যা বিগ ডিল, ডক্টর- পাশ থেকে বলে উঠলো ক্রিস্টিনা।
তরুণ ডাক্তার মুখটা হাসি হাসি করে মাথাটা হালকা ঝাঁকালো।
ক্রিস্টিনা তরুণ ডাক্তারের সাথে সাথে চলে গেলো। ওষুধের নাম লিখে আনতে হবে। ইশারায় আমাকেও ডেকে নিলো।
ডাক্তার ক্রিস্টিনাকে জিজ্ঞেস করলো, প্যাসেন্ট আপনার কী হয়?
– বন্ধু
– এটা করলো কেনো?
– ওর ফ্যামেলিতে একটু প্রব্লেম যাচ্ছে।
তরুণ ডাক্তারকে দেখে মনে হইলো না ঠিক বিশ্বাস করছে। ক্রিস্টিনার যেন গলা ধরে এলো। চোখদুটো ছোট করে বললো, বাবা-মার ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় যায় অবস্থা।
– বলেন কী!
তরুণ ডাক্তারের সব অবিশ্বাস মুহূর্তেই যেন উবে গেল। তার বদলে সহানুভূতি ফুটে উঠলো চেহারায়।
নিজের মুখ আয়নায় দেখার উপায় ছিল না। বুঝতে পারছিলাম সেখানে অবিশ্বাসের ছাপ। এভাবে এক নিমেষে নিজেদের ভাঙনের দায় যে বাপমায়ের কল্পিত ভাঙনের ওপর চালান করে দেয়া যাইতে পারে ব্যাপারটা স্বচক্ষে দেখেও ঠিক বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।
ওষুধের নাম লিখে দিয়ে তরুণ ডাক্তার বললো, কাউকে দিয়ে আনিয়ে নিন।
কই কই গেলে পাওয়া যাবে, কতো দাম পড়তে পারে সব বুঝিয়ে দিলো ক্রিস্টিনাকে।
ক্রিস্টিনা মুখে স্মিত হাসি ফুটিয়ে তাকে বললো, ডক্টর, মে আই হ্যাভ ইউর কন্টাক্ট নম্বর, প্লিজ, ফর ইমার্জেন্সি পারপাস?
-সিউর
– থ্যান্কু
ডাক্তার আমার দিকে তাকালো। এতক্ষণে তার নজরে আসলো আমি এই নারীর লগে আসছি। কেউ কিছু বলার আগে ক্রিস্টিনা পরিচয় দিলো, আমার সিনিয়র…মিডিয়ায় জব করেন।
তরুণ ডাক্তারের সাথে হাত মেলালাম। সে হাসলো। সুদর্শন ছেলে, হাসিটাও সুন্দর। মুখে গজ দাঁত আছে। গজ দাঁতওয়ালাদের হাসি সুন্দর হয় বলে কথিত আছে।
রমজানের পাশে ভজন দাশকে রেখে আমি আর ক্রিস্টিনা অ্যান্টিডোট কিনতে গেলাম। বের হয়ে মনে হলো পকেটে টাকা পয়সা নাই। ক্রিস্টিনাকে বললাম, আমি তো টাকা পয়সা বিশেষ আনি নাই।
– নো টেনশন, দাদা। ভজনের কাছে কিছু ছিল আর কিছু রমজানের পকেট হাতিয়ে পাইছি। আপাতত কিছু কিনে আনি, পরে আর লাগলে তোমাকে বলবো।
ওষুধ কিনতে গিয়ে দেখি তরুণ ডাক্তার যা বলছিল দাম তারচেয়ে বেশি। যাই হোক আপাতত কাজ চলার মতো কয়েকটা অ্যান্টিডোট কেনা হইলো। আসার পথে ক্রিস্টিনার আবদার রাখতে একটা কফিশপে ঢুকে পিৎজা আর কফি খেলাম। বিলটা সেই পে করলো। মনে হলো এটা তার ব্যক্তিগত খাত থেকে।
ক্রিস্টিনাকে বললাম, আচছা ব্যাপারটা কী বলো তো? তুমি রমজানের বাপ-মায়ের ডিভোর্স ঘটায় দিছিলা আরেকটু হলে…
– না হলে বিশ্বাস করতো না।
– বিশ্বাস করানোটা খুব জরুরি ছিল?
– হ্যাঁ, প্রোপার ট্রিটমেন্ট এনসিউর করার জন্য এটা দরকার ছিল।
কথা খাঁটি। আগে তো বাঁচা। এথিক্স পরে। সারভাইবেলের প্রশ্ন; ক্রিস্টিনাকে তাই অপছন্দ করতে পারি না।
সে দফা ভজন দাশ নাওয়া খাওয়া বাদ দিয়ে রমজান আলীর পাশে পাশে লেগে ছিল। তাতেও যে তাদের বরফ গলেছিল তা নয়। বরং হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর রমজান আলী কেমন যেন ‘উদাস বাউল’ হয়ে গেল। ক্রিস্টিনাকেও বিশেষ পাত্তা দিত না আর। আমার সাথে একবার দেখা করতে বাসায় এসেছিল। কথার্বাতা বিশেষ হলো না। যাও হলো- এলোমেলো। চা-সিগারেট খেয়ে পরে আবার আসবে বলে চলে গেল।
এরপর এক বৃহস্পতিবার বিকেলে আচমকা বাসচাপা পড়ে রমজান। এবার আর হাসপাতাল নেয়ার সময় পাওয়া গেল না। স্পট ডেড!
রমজানের বাড়িতে যে দিন লাশ নিয়ে যাওয়া হলো, সেদিন বাস্তবকিই সময়টা থমকে গিয়েছিল। পরিবারটিতে রমজান ছিল যক্ষের ধনের মতো। তার আকস্মিক মৃত্যু সবাইকে হতবাক করে দিয়েছে। রমজানের বাবা নির্বাক, মা অচেতন। ফলতঃ তিনিও নির্বাক। বিলাপ করে কাঁদছেন কেউ কেউ। কিছু মুরব্বি গোছের মানুষ সড়ক দূর্ঘটনার বিচার-বিশ্লেষণ করছিলেন। বিষয়টা সবাই হৃদয়বিদারক সড়ক দূর্ঘটনা হিসেবেই নিছে বলে মনে হলো। শুধু ভজনের মুখশ্রী দেখে মনে হলো তার ভেতরে শোকেরও অধিক কিছু খেলা করছে। সে পুরাই চুপ মেরে গেছে। পুরোটা সময় কারো সাথে কোনোপ্রকার কথাবার্তা বলেনি।
আমার শরীর বেয়ে যেন দীর্ঘদিনের জমানো এক র্দীঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। মোবাইলটা হাতে নিয়ে একটা মেসেজ দেখছিলাম কিছুক্ষণ পর পর। রমজানের পাঠানো শেষ মেসেজ- ‘আগুনও নিভে যায় একসময়…’
রমজানের পছন্দের উপমা ছিল আগুন। কোনো বিষয়ে উদাহরণ দেয়া লাগলেই সে আগুনের সাথে রিলেট করে একটা উদাহরণ হাজির করতো। এ নিয়ে তার সাথে কম মজা করা হয়নি। মাঝে মাঝে ঠাট্টা করে বলতাম, রমজানের বাজারে আগুন লেগেছে…’
জীবনানন্দের মৃত্যুর কারণ দূর্ঘটনা হতে পারে, রমজানেরটি নয়।
কত টিকটিকি লেজ নাড়ে, কত সময় চলে যায়…। রমজান আলীর কথাও ভুলে যেতে থাকি। ভুলে যেতে হয়। প্রাত্যহিকতার মাঝেই আমাদের বেঁচে থাকতে হয়। নিত্যদিনের জীবনযুদ্ধে স্মৃতির খাতায় ধুলোর আবরণ জমতে থাকে। তাছাড়া রমজান আলীর এভাবে চলে যাওয়াটা নিয়ে ভাবতে গেলে দম আটকে আসতে চায়। অতএব, ‘ভালো থেকো রমজান’ পর্যন্তই।
শেষের আগে- তরুণ ডাক্তারের সাথে পারিবারিকভাবে ক্রিস্টিনার বিয়ের কথা চলছে। সেদিন ‘কটন কফি শপে’ বসে হাত নেড়ে নেড়ে ক্রিস্টিনা বলছিল, দাদা চাঁদতো অনেক দ্যাখছি। আমরা ভাবছি অমাবস্যার রাতে কোনো একটা পাহাড়ের চূড়োয় বসে বিয়ের রাতটা পার করবো। একসময় ভয় পাবো। তখন দু’জন দু’জনকে ধরে বসে থাকবো।’
– ভালো তো।
– তুমি তো আর বিয়েশাদি করবা না। করলে তোমাকেও বলতাম এটা ট্রাই করতে।
ভাবনার অতলে হারিয়ে যেতে থাকি। ভাবতে থাকি টোয়েন্টি-টোয়েন্টি ক্রিস্টিনার মতো কারো সাথেই যেতো। ইনফ্যাক্ট, ক্রিস্টিনার সাথে কিছুদিন তেমনটাই যাচ্ছিল। মাঝে আমি প্রফেশনাল কাজে কিছুটা ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। তরুণ ডাক্তারের বোধহয় তখন সরকারি ছুটি চলছিল। ক্রিস্টিনার বয়ানে, ‘সে আমাকে অনেক সাপোর্ট দিয়েছে’ শুনে শুনে তেমনটাই লাগে।
সে দিন ক্রিস্টিনা চলে যাবার পর সস্তা মদের জন্য গোটা তিনেক বার ঘুরে এলাম। কী বালছাল অবরোধ লাগছে কে জানে, মদেরও ক্রাইসসি দেখা দিছে।
শেষে এক সাংবাদিক বড় ভাইকে পেয়ে গেলাম। বললেন, এভাবে বারের বাইরে ঘোরাঘুরি করা ঠিক না, আসো, ভেতরে আসো।
বিনে পয়সায় প্রচুর ফরেন পড়েছিল পেটে। রাতে রিকশা করে ফেরার পথে ‘ক্রিস্টিনা, ক্রিস্টিনা’ বলে বেশ ক’বার চেঁচিয়েও উঠেছিলাম।
হাসপাতালে শুয়ে থাকা রমজান আলীকে মাঝে মাঝে মনে পড়ে। রমজান আলীর মতো বিষ খাইতে ইচ্ছে করে। ক্রিস্টিনা জিজ্ঞেস করলে বলতাম, ‘বেশ করেছি বিষ খেয়েছি। তোমার তাতে কী?’
ই-কারের উপর বাড়তি জোর দিয়ে ক্রিস্টিনা হয়তো বলে উঠতো, ‘চিই’প, চিই’প, ভেইরি চিপ…’