সোমবার, ১৫ মার্চ ২০২১, ০৫:২৪ অপরাহ্ন
আহমেদ মুনিরের কবিতা
লকডাউন সিরিজ
১
একটা লোক এত রাতে লকডাউন ডিঙিয়ে হেঁটে যাচ্ছে নির্জন নীরব বাকরুদ্ধ রাস্তা ধরে। পাশে গোরস্তান থেকে মাথা বের করে দেওয়া গাছটা একবার তার দিকে তাকিয়ে ফিরিয়ে নেয় মুখ । বাড়িতে মেলেনি ঠাঁই, হায় কবরে্ও জায়গা হবে না তার।
২
কি নাম লোকটার ভুলে গেছি । এতদিনে মনে আছে শিরোনাম, ‘কেউ লাশ নামাতে দেয় না’। তার মরদেহ নিয়ে বাড়িতে ঢুকলো অ্যাম্বুলেন্স। রাত এগারোটা বেজেছে তখন। অ্যাম্বুলেন্সের ধাতব আওয়াজ শুনে সন্তান, স্ত্রী, ভাই, প্রতিবেশীরাও হাজির সেখানে। না, তারা আসেনি কেউ লাশ নামাতে। এসেছে লাশটি যেন কেউ নামাতে না পারে! একবাক্যে বলে দিলো সবাই, এ লাশ গ্রামে যাবে না দাফন করা। ধান মহালের সামনে আজও তার লাশ করোনার মমি হয়ে আছে।
৩
করোনাকালে কি শিখেছি, জানতে চায় ওরা। আমি বলি, কথা নয়, শিখেছি নানান কাজ। ঘর মুছতে শিখেছি, রান্নাও মন্দ না। এ আকালে খোঁজ রাখে কার কেবা। চাবকে পিঠের ছাল তুলে না দেয়াটাও একটা সেবা।
এয়ার মেইল
যেভাবে পুরোনো খাম পথে পড়ে থেকে
অপেক্ষার সীমা পার হয়
ধরো, এয়ার মেইল লোগো ছেড়ে
বিমানটিও উড়ে গেছে তার
প্রেরকের ঘরে কবেকার জেমকালি
আর কার প্রেমিকার আঙুলের ছাপ
তোমার শরীরে দেখ ঠিকঠাক
রয়ে গেছে তারও কত চিহ্ন।
গ্রামীণ সড়ক থেকে পিচঢালাই উঠে গেলে
সারা রাত বসে থেকে পাশাপাশি
চুমু না খাওয়ার আফসোস বাড়ে
সকল চুম্বন ধুলায় ঢাকা পড়ে যায়
যেহেতু ম্যাকাডাম নেই, ইটের খোয়া নেই
যেহেতু সমুদ্র সরে গেছে আরও ধর তিন মাইল।
স্মৃতির জ্ঞানাঞ্জন রেখে চলে গেছে ঠিকাদারও।
তবু তার চিহ্ন ধরে কত অক্ষরবিহীন
চিঠিতে ভরে উঠেছে শরীর।
স্ফটিক অরণ্যে
(মহশ্বেতা দেবীকে)
হাজার চুরাশির মা পড়তে পড়তে
ভেবেছি, আপনি কেমন মানুষ?
কখনো কোথাও দেখা হলে
কী বলতাম আপনাকে?
তেমন কিছুই তো বলার নেই
আর শুনেছি আপনি উল্টো-পাল্টা
প্রশ্ন করাটা পছন্দ করেন না।
কখনো কোথাও দেখা হলে
কী বলতাম আপনাকে?
সোফার কোনায় বসে খুব
মনোযোগ দিয়ে হয়তো ঘরটা দেখতাম!
দেয়ালে রবীন্দ্রনাথ কিংবা পাঠভবনের
কোনো ছবি থাকলে
সেদিকে তাকিয়ে তাকিয়ে
সময় ক্ষেপণ করতাম
মন উশখুশ করত ফালতু
সব কৌতুহলে-
পাঠভবনের মশাই যে
বাক্সটা বানাতে শিখিয়েছিলেন
সেটা আছে আজও?
সেখানে এখনো শুঁয়াপোকা রাখে কেউ,
আর দেখে প্রজাপতি হয়ে উড়ে যেতে?
কিন্তু নিশ্চিতই জানি, এসব
প্রশ্ন করতাম না আপনাকে
কারণ আপনি উল্টো-পাল্টা
প্রশ্ন করাটা পছন্দ করেন না।
তবু মুখ ফসকে হয়তো বেরিয়ে
পড়ত ব্রতীর কথা
ব্রতীকে আপনি চিনতেন?
তার মতো দেখতে ছিল কী কেউ?
আমি হাজার চুরাশির মা
পড়তে পড়তে ভেবেছি
আপনিই তলপেট চেপে ধরে আছেন,
বাড়িতে ছেলের খুনি-
তার পাতে তুলে দিচ্ছেন সন্দেশ।
মাঝে মাঝে মনে হয় আপনার
সঙ্গে দেখা হয়েছে আমার
বহুকাল ধরে চিনি আপনাকে।
ব্রতীর ময়ের মতো
যন্ত্রণাকাতর মুখ আপনার
সাদা চুল, মুখে ভাঁজ তবু
চশমার ফাঁক দিয়ে
ধেয়ে আসছে ধারালো দৃষ্টি।
সেই দৃষ্টি থেকে বাঁচতে হয়তো
চুপচাপ পেপার ওয়েটের কাচ ঘষতাম
ঘষতে ঘষতে দেখতাম
ভেতরের স্ফটিক অরণ্য,
আর হঠাৎই আবিষ্কার করতাম
সেই স্ফটিক অরণ্যে চোট্টি মুণ্ডা
নিশ্চল পাথর হয়ে আছে।
পাশে ছড়ানো পুরোনো বাঘের
কতকালের জমে যাওয়া আত্মা!
দিনলিপি থেকে
১.
প্রবল বাতাসে যেন উল্টে গেছে ছাইদানি,
এমন মেঘময় এই পাহাড়।
জানালায় রাতের বেড়াল
লাফিয়ে অদৃশ্য হয় ভোরের বাতাসে
অনচ্ছ আলোয় ক্যালেন্ডার পাতা দুলে ওঠে।
আর তার গায়ে মেকি পাহাড়ের ছবিটাও।
২.
শান্তির সকালে বাগান করেছি ছাদে
আমাদের মন আজ
পাখি আর ফুলে
অ্যাকুরিয়ামের মাছে।
সচকিত ড্রোন
পুরোনো পেট্রল বোমা
ফুল হয়ে ফুটে আছে।