বুধবার, ৩১ মার্চ ২০২১, ০৮:৫২ অপরাহ্ন
হাইকু
হাইকু সম্পর্কিত কিছু কথা এবং কয়েকটি হাইকু কবিতা
হাইকু তিন পঙক্তি বিশিষ্ট সংক্ষিপ্ত কবিতা যার উৎপত্তি ঘটেছিল জাপানি কবিদের হাতে। হাইকু তিন পঙক্তির হলেও এটি সামগ্রিক চিত্র এবং সৌন্দর্য বহন করে। ভাবনা-উদ্রেককারীও বটে। হাইকুতে তিনটি পঙক্তি থাকে, যার মাত্রা-বিন্যাস হল ৫-৭-৫ অর্থাৎ প্রথম পঙক্তি হবে ৫ মাত্রার, দ্বিতীয় পঙক্তি ৭ মাত্রার এবং তৃতীয় পঙক্তি আবার ৫ মাত্রার।
সাধারণত হাইকু’র কোনও শিরোনাম থাকে না।
“ঊনবিংশ শতকের শেষাংশে মাসাওকা শিকি নামের একজন কবি ও তাত্ত্বিকের হাতে স্বয়ংসম্পূর্ণ কবিতা হিসেবে হাইকু’র প্রাণ প্রতিষ্ঠা ঘটে। যদিও ‘হক্কু’ নামের কবিতাংশকে ‘প্রাচীন হাইকু’ হিসেবে আজ গণ্য করা হয়, সেগুলো রচিত হয়েছে সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীতে। মাসাওকা শিকি’র কাল থেকে তাঁর নির্দেশিত পথে রচিত তিন পঙক্তির ছোট কবিতাকে বলা হয় আধুনিক হাইকু।”
হাইকু কবিতার জাপানি স্রষ্টাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন- মাৎসুয়ো বাশু, রাইয়নোসুকি, আকুটাগাওয়া, ইয়োসা বুসন, কোবায়াশি ঈসা, কিজো মোরাকামি প্রমুখ।
বাঙলা ভাষায় যথেষ্ট হাইকু রচিত হয়েছে, হচ্ছে (যদিও ফ্রি-স্টাইলে রচিত হাইকু’র সংখ্যাই সর্বাধিক)। ফ্রি-স্টাইল বলতে মাত্রার স্বাধীনতা এবং বিষয়-বৈচিত্র্যের কথা বুঝিয়েছি। ৫-৭-৫ মাত্রার যে গৎবাঁধা ছক, তা ভেঙে অনেকে হাইকু/ হাইকু সদৃশ কবিতা লিখেছেন, লিখছেন এবং তা যথেষ্ট প্রচলিত।
বাঙলা ভাষায় আমরা হাইকু’র কথা প্রথম জানতে পারি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘জাপানযাত্রী’ নামক ভ্রমণ-কাহিনি গ্রন্থখানিতে। হাইকু সম্পর্কে তিনি বলছেন:
“[…] এই যে নিজের প্রকাশকে অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত করতে থাকা, এ ওদের কবিতাতেও দেখা যায়। তিন লাইনের কাব্য জগতের আর কোথাও নেই। এই তিন লাইনই ওদের কবি, পাঠক, উভয়ের পক্ষে যথেষ্ট। […] এ পর্যন্ত ওদের যত কবিতা শুনেছি সবগুলিই হচ্ছে ছবি দেখার কবিতা, গান গাওয়ার কবিতা নয়। হৃদয়ের দাহ এবং ক্ষোভ প্রাণকে খরচ করে, এদের সেই খরচ কম। এদের অন্তরের সমস্ত প্রকাশ সৌন্দর্যবোধে।”
বেশ কয়েকটি হাইকু অনুবাদও করেছিলেন তিনি, যা ‘জাপানযাত্রী’ গ্রন্থখানিতে উল্লেখ করা হয়েছে। মাৎসুয়ো বাশু প্রণীত একটি হাইকু’র অনুবাদ তিনি করেছিলেন এভাবে:
পুরোনো পুকুর
ব্যাঙের লাফ
জলের শব্দ।
কবি আবিদ আনোয়ার প্রণীত “চিত্রকল্প ও বিচিত্র গদ্য” গ্রন্থ থেকে “বাংলায় হাইকু রচনা: ধ্বনিতাত্ত্বিক সমস্যা ও একটি প্রস্তাবনা” শীর্ষক একটি প্রবন্ধের অংশবিশেষ প্রাসঙ্গিক ব’লে এখানে উল্লেখ করছি:
[…] নির্মলেন্দু গুণ-এর লেখায় একটি নতুন তথ্য গুরুত্বপূর্ণ। “ফুল ফুটুক/ না ফুটুক/ আজ বসন্ত,” সুভাষ মুখোপাধ্যায় রচিত এই বহুল উদ্ধৃত পঙক্তিগুচ্ছ মূলত একটি হাইকু-সদৃশ ইংরেজি কবিতার অনুবাদ। ইংরেজি ভাষ্যটি নির্মলেন্দু গুণের মতে:
“Nothing happening/ and yet spring begins/ on this morning.”
এখানে আমার লেখা কয়েকটি হাইকু/হাইকু-সদৃশ কবিতা দিলাম। জানি না, কতটা সরস হয়েছে। হাইকু’র ব্যাপারে বেশ আগ্রহ থাকার কারণে এ-চেষ্টাটুকু করলাম। বাকিটুকু পাঠকের মননের কাছে।
১.
ঘোলাটে ঝিল
ডানা ভাঙা দোয়েল
শিকারি চিল।
২.
পুরোনো ভিটে
কালো মেঘের ভেলা
কাদার ছিটে।
৩.
উড়ছে পাখি
পাখনায় শিকল
শিকারি আঁখি।
৪.
আকাশে মেঘ
আলোড়িত ফড়িং
ডানা কাঁপায়।
৫.
মগজে জল
‘আসমানি ইশারা’
কেউটে দল।
৬.
ভোরের রোদ
শিশুর হাসিমুখে
জলের ছাপ।
৭.
নীরব ঝড়
নুইয়ে পড়া বাসা
বিরান খড়।
৮.
মাটির ঘ্রাণে
মাকড়সার জাল
শিকার খোঁজে।
৯.
পেশীর জোর
কুয়াশার চাদর
নতুন ভোর।
১০.
জলের নুড়ি
চার্বাক কথন
লোহার চুড়ি।
১১.
মাছের ঘ্রাণ
পাতা ঝরার দিন
পেটের টান।
১২.
মাতাল বন
বর্ষণ মুখর
হতাশ ক্ষণ।
তথ্যসূত্র:
১. জাপানযাত্রী— রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কথাপ্রকাশ প্রকাশনী, ২০১১।
২. চিত্রকল্প ও বিচিত্র প্রবন্ধ— আবিদ আনোয়ার, প্রথম প্রকাশ, ২০০৫, আগামী প্রকাশনী।