সোমবার, ২৯ মার্চ ২০২১, ০১:৪৮ অপরাহ্ন
মন্টি পাইথন এন্ড দ্যা হোলি গ্রেইল (Monty Python And The Holy Grail ) রিভিউ
সিনেমার শুরুতেই মেকাররা দরাজ দিলে ঘোষণা করে যে “দেখেন, টেরি গিলিয়ামস আর টেরি জোন্স বাদেও এই সিনেমার ডিরেকশনে ছিল ৪০টা প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত ইকুয়েডরিয়ান লামা, ৬টা ভেনেজুয়ালান রেড লামা, ১৪২টা মেক্সিকান হুপিং লামা, ১৪টা নর্থ চিলিয়ান গুয়ানাকো( এটাও একধরণের লামা ), একটা ব্রিক্সটনের র্যাগ লামা, আর প্যারাগুয়ের “লামা ফ্রেশ” নামক কোম্পানির ৭৬০০০ ব্যাটারিচালিত লামা “।
সিনেমা বানাইতে এত লামার কি দরকার এই কথা চিন্তা করতে করতে আপনি যখন আর্থারিয়ান লেজেন্ড এর উপরে বানানো এই সিনেমা দেখা শুরু করবেন আপনার মাথায় দুইরকম ভাবনা খেলতে পারে ।
প্রথম ভাবনা যেটা সেই সময়ের অনেক ক্রিটিকের মাথায় খেলে গিয়েছিল যে এতটা অতিরিক্ত কাবিল হয়ে, আনকনভেনশনাল হয়ে এন্টি সিনেমা বানাতে গিয়ে এটা আসলে সিনেমাই হয় নাই। বিখ্যাত ফিল্মমেকার ইয়াসুজিরো অজু তার মৃত্যশয্যায় শুয়ে বলেছিলেন “সিনেমা ইজ ড্রামা, নট এক্সিডেন্ট”। কিন্তু এই সিনেমা একটা এক্সিডেন্ট ছাড়া কিছুই না। মনে হচ্ছে অনেকগুলা আলাদা আলাদা কমেডি স্কেচ একসাথে এডিট করে সিনেমা বলে চালায়ে দিচ্ছে । এবং একচুয়ালি এই সিনেমার মেকার মানে “মন্টি পাইথন” নামের কমেডি গ্রুপটি বা কমেডি কালেক্টিভ যাই বলতে চান তারা তাদের এই এবসার্ডিস্ট হিউমার এর জন্যই বিখ্যাত ছিল ।
আবার আপনি যদি সিনেমাকে শুধু এন্টারটেইনমেন্ট হিসেবে দেখেন তাহলে হয়ত আপনার এই সিনেমা দেখে মনে হইতে পারে আরে এইটা তো “মোর সিনেমা দ্যান সিনেমা”।
বহুকাল ধরেই একটা কথা প্রচলিত যে ব্রিটিশ আর আমেরিকান কমেডির মূল পার্থক্য অপ্টিমিজমে। যদিও বর্তমান সময়ে এসে এই পার্থক্য অনেকটা ঘুচে যাচ্ছে। ‘বোজ্যাক হর্সম্যান’, ‘রিক এন্ড মর্টি’ দেখলে যা অল্প হলেও বোঝা যায়। কিন্তু এক্সিকিউশনের দিক থেকেই সম্ভবত বৃটিশ কমেডি একটু অন্যরকম। “দ্যা অফিস” শোটির ব্রিটিশ এবং আমেরিকান ভার্সন দেখলে যা আরো ভালমত চোখে পরে। ব্রিটিশরা মনে করে যে আসলে লাইফের কোন মিনিং নাই, পৃথিবীতে সবকিছুই মূলত অযৌক্তিক এবং এসব কমেডিতে সেসব উঠে আসা উচিত বা কমেডিই হচ্ছে এসবের সাথে ডিল করার একমাত্র উপায়। সেই দিক থেকে আমেরিকা আরেকটু অপ্টিমিস্টিক। এভাবে বললে যদিও জেনারালাইজ করে হয়ে যায়। তবে পার্থক্যটা অনেক ক্ষেত্রেই খাটে।
ব্রিটিশ স্ট্যান্ডআপ কমেডিয়ানদের স্পেশাল আর আমেরিকান কমেডিয়ানদের স্পেশাল শোগুলোতেও এই ব্যপারটা চোখে পরে। জিমি কার, এডি ইজার্ডদের মত ব্রিটিশ কমেডিয়ানদের সাথে তাই সাইনফেল্ড, কেভিন হার্টদের মত আমেরিকান কমেডিয়ানদের কিছু ফান্ডামেন্টাল পার্থক্য আছে। আমেরিকান সফট পাওয়ারের জোরে লাইটহার্টেড কমেডিই পৃথিবীজুড়ে বেশি জনপ্রিয় হলেও ব্রিটিশ কমেডি বহু আগে থেকেই মানুষের মনে বিশেষ এক স্থান দখল করে রেখেছে।
যাই হোক, কমেডির সবচেয়ে বড় সুবিধা হয়ত এই যে একটা কনসেপ্টের সাথে এগ্রি না করলেও সেই কনসেপ্টের প্রেজেন্টেশন দেখে হাসা যায় । যে কারণে লুই সি.কে রেইপ জোক করেও পার পেয়ে যায়। ক্রিস রক নিগ্রোদের নিয়ে জোক করলেও কেউ তাকে রেসিস্ট ডাকে না। কারণ দিন শেষে কমেডিকে জাজ করা হয় আসলে হাস্যরস দিয়ে। ইফ ইট ওয়াজ ফানি অর নট। এই কারণেই প্রচলিত ধারণা থেকে একটু বাইরে, সাররিয়াল বাট ঠিক সাররিয়াল না মোটমাট এবসার্ডিজমের কাতারে পরে এরকম একটা সিনেমা “মন্টি পাইথন এন্ড দ্যা হোলি গ্রেইল” আমেরিকাতে প্রচুর বিখ্যাত হয়ে যায় । এবং ওই সময়ের কমেডি সিনেমাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ইনফ্লুয়েন্সাল সিনেমা হয়ে উঠে ।
‘মন্টি পাইথন এন্ড দ্যা হোলি গ্রেইল’ এর এই কমেডিক ইনফ্লুয়েন্সের ছাপ দেখা যায় এসএনএল (স্যাটারডে নাইট লাইভ) এর বহু স্কেচে, এংকরম্যান টাইপের বিখ্যাত সিনেমায়, হালের নতুন লেজেন্ড রিক এন্ড মর্টিতে, ডেডপুলের ক্রেডিট সিনে, স্টেপ ব্রাদার এর মত মুভিতে, বেসিকালি উইল ফেরেল, ড্যান হার্মন (কমিউনিটি, রিক এন্ড মর্টি এর নির্মাতা) যাই করে তাতেই। এমনকি হলিউড রিপোর্টার্স এর যে বাৎসরিক কমেডিয়ান্স রাউন্ডটেবল হয় সেখানে প্রতি বছরই কেউ না কেউ মন্টি পাইথনের কথা তোলেন এবং বাকিরা শ্রদ্ধার সাথে তাদের স্মরণ করেন।
আর সিনেমা বাদ দিয়ে চিন্তা করলে, স্ট্যান্ডআপ কমিকদের মধ্যে এডি ইজার্ডের মত লেজেন্ডদের কাজেও মন্টি পাইথিনের ছাপ দেখা যায়। এবং জন অলিভার বিভিন্ন ইন্টারভিউ দেখলে বুঝা যায় যে নতুন জেনারেশনের প্রতিটা কমেডিয়ানের উপরেই এদের ইনফ্লুয়েন্স কতটা বেশি।
মন্টি পাইথন এন্ড দ্যা হোলি গ্রেইল এর কাহিনীর ব্যপারে যদি একটু বলতে হয় তাহলে বলি সিনেমার কাহিনী মূলত আর্থারিয়ান লেজেন্ড মানে কিং আর্থারের উপরে ভিত্তি করে। কিং আর্থার তার এক দাসসহ বের হন লোকবল বাড়াতে। তার উদ্দেশ্য তাকে আসন্ন যুদ্ধে সাহায্য করতে পারবে এমন শক্তিশালী যোদ্ধা খুঁজে বের করা। আস্তে আস্তে ঘটনাপ্রবাহে তার সাথে তার সাথে কিছু সাহসী যোদ্ধার পরিচয় হয় এবং সবাই তাকে সাহায্য করবে বলে কথা দেয়। সকল যোদ্ধা কিং আর্থারের সাথে যোগ দেওয়ার পরে কিং আর্থার যখন পরবর্তীতে কী করবেন সে ব্যাপারে দিশেহারা হয়ে যান তখন তাদের উপরে ঈশ্বর কর্তৃক দৈববাণী আসে হোলি গ্রেইল খুঁজে বের করার । এই কারণে তারা আলাদা হয়ে সকলে এই হোলি গ্রেইল খুঁজতে থাকেন। কীভাবে সেটা খুঁজে পান এবং পাওয়ার পথে কী কী সমস্যায় তাদের পড়তে হয় এই নিয়েই কাহিনী ।
তবে এক্ষেত্রে বলে রাখি, যেকোন বিয়েবাড়িতে একচুয়াল বিয়ের কাজে( কবুল, কবুল, কবুল বলা ) তেমন কোন মজা নেই। মজা সব থাকে ইন অল দ্যা শিট দ্যাটস হেপেনিং এরাউন্ড । মন্টি পাইথন এন্ড দ্যা হোলি গ্রেইলেও মূল কাহিনীর থেকেও মজার হচ্ছে অল দ্যা শিট দ্যাটস হেপেনিং এরাউন্ড। সিনেমার প্রতিটা ক্যারেক্টারই এক একজন ইন্সট্রুমেন্ট অফ ক্যাওস। এবং এ কারণেই হয়ত এই সিনেমার রিওয়াচেবিলিটি রেইট এত হাই। কারণ মূল জোক বাদেও পুরো সিনেমাই এত ছোটখাটো জোকে ভরা যে একবার দেখে সব বুঝে ফেলা প্রায় অসম্ভব। পুরনো সিনেমার একটা সমস্যা হচ্ছে জোকগুলা পুরনো হয়ে যায়। সবচেয়ে বড় কথা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায়। সেদিক থেকে “মন্টি পাইথন এন্ড দ্যা হোলি গ্রেইল” ওয়াইনের মত। বয়স তাকে আরো মনোমুগ্বকর করে তুলেছে।
এতটুকু পড়ে অনেকের মনে হতে পারে “ওকে। লোক হাসানো কমেডি ইজ ফাইন । বাট কমেডির তো সমাজের প্রতি একটা দায়িত্ব আছে । এস্টাবলিশমেন্টকে যে কমেডি প্রশ্ন করে না সেটা কোন কমেডিই না” তাদের জন্য আমি মন্টি পাইথন এন্ড দ্যা হোলি গ্রেইল সিনেমারই একটা ছোট সিন দিয়ে দিয়ে শেষ করতে চাই এই লেখা।
“জনৈক লোকঃ আপনি রাজা হলেন কিভাবে? আমি তো আপনাকে ভোট দেই নি।
কিং আর্থারঃ দিঘী থেকে এক পরী উঠে আমার হাতে এক্সক্যালিবার নামক এই তলোয়ার তুলে দেয়। দৈববাণী অনুযায়ী এই তলোয়ার যে পায় সেই রাজা ।
জনৈক লোকঃ (হেসে) দেখো জলপরী কাকে তলোয়ার দিয়েছে এইসব দিয়ে রাষ্ট্র চলে না। এইসবের উপরে ভিত্তি করে সরকার গঠন করা যায় না। আসল প্রশাসনিক ক্ষমতা আসে জনগণের ভোট থেকে, হাস্যকর জলজ পরীদের থেকে না।”
তাই বোঝাই যাচ্ছে এই সিনেমায় কোনকিছুরই যাতে কমতি না থাকে সেদিকে ভালই খেয়াল রেখেছেন মেকাররা। আর এতসবকিছু করতে গিয়েই সম্ভবত প্রস্তাবিত বাজেট থেকে আরো অনেক বেশি বাজেট লেগে যায় এই সিনেমা বানাতে। তখন এই সিনেমার শুট শেষ করার জন্য বাইরে থেকে প্রডিউসার নিতে হয়। এই প্রডিউসারদের মধ্যে ছিল জনপ্রিয় ব্যান্ড পিংক ফ্লয়েড, লেড জেপলিন আর জেনেসিস। রতনে রতন চেনে কথার এর থেকে ভাল উদাহরণ হয়ত আর হয় না।