মঙ্গলবার, ৩০ মার্চ ২০২১, ১০:৫৮ পূর্বাহ্ন
দ্যা নর্থ এন্ড : আখ্যানতাত্ত্বিক পর্যালোচনা ও অন্যান্য
দ্যা নর্থ এন্ড লেখক বর্ণালী সাহার দ্বিতীয় বই, এবং এর প্রকাশকাল ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। মলাটে বইয়ের কাহিনীকে উপন্যাস হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, তাই দ্যা নর্থ এন্ডকে উপন্যাস হিসেবে বিবেচনা করেই এর পর্যালোচনা করার প্রয়াস এই লেখাটি। এখানে উপন্যাসের আধার (Content) ও আধেয় (Form) পর্যালোচনায় জেরার্ড জেনেটের আখ্যানতত্ত্ব (Narratology) এবং এর পাঁচটি ধারণা তথা: Order, Duration, Frequency, Mood ও Voice মূল ভূমিকা রেখেছে। তবে তাঁর আখ্যানতত্ত্বের এই পাঁচটি ধারণার উপর ভিত্তি করে পিটার ব্যারির তৈরি করা ছয়টি প্রশ্ন বর্তমান আলোচনার বিশেষ দিঙ্নির্দেশক। প্রশ্নগুলো হলো: ১. আখ্যানের প্রাথমিক ধরন ‘মিমেটিক’ না ‘ডায়েজেটিক’, ২. আখ্যানটি কিভাবে কেন্দ্রীভূত হয়েছে, ৩. আখ্যানে সময়কাল কিভাবে পরিচালিত হয়েছে, ৪. আখ্যানটি কে বলছেন, ৫. আখ্যানটি কিভাবে সাজানো হয়েছে? এবং ৬. আখ্যানে উক্তি ও চিন্তা কিভাবে উপস্থাপিত হয়েছে (Barry, 2009)? আর এই লেখার শেষ ভাগে স্থান পেয়েছে বর্তমান আলোচকের ব্যক্তিগত পাঠ-প্রতিক্রিয়া ।
আখ্যানের ‘মিমেটিক’ ও ‘ডায়েজেটিক’ ধারণার ব্যাখ্যা জেরার্ড জেনেট উপস্থাপন করেছেন তাঁর বই ন্যার্রেটিভ ডিসকোর্স: এন অ্যাসে ইন মেথড বইয়ের চতুর্থ অধ্যায়ে (জ্যান লেউইন বইটির ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ করেন ১৯৮০ সালে) (Gennete, 1980) । ‘মিমেটিক’ ধরনে আখ্যান উপস্থাপন করা হয় বিস্তারিত আকারে, এবং সংলাপ সংযুক্ত করে নাটকীয় ভাব বজায় রাখা হয়; অন্য দিকে ‘ডায়েজেটিক’ ধরনে আখ্যান উপস্থাপন করা হয় সংক্ষিপ্ত আকারে ও দ্রুত প্রসঙ্গান্তরের মধ্য দিয়ে, কিন্তু কাহিনীর প্রয়োজনীয় ও সংযোগ স্থাপনকারী উপাদানগুলোকে বাদ না দিয়ে। দ্যা নর্থ এন্ড উপন্যাসের শুরুতে আমরা মিমেটিক ধরনটি পাই যেখানে পরিবেশ ও পরিস্থিতির বিশদ বর্ণনা এবং সংলাপের মধ্য দিয়ে কাহিনী উপস্থাপিত হয়েছে। এতে পাঠকদের কাছে শুরু থেকেই মনে হয় ঘটনা তাদের সামনে ঘটছে এবং প্রধান চরিত্রগুলোর মনস্তত্ত্ব তাদের কাছে ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। তবে মিমেটিক ধারা অনুসরণ করে সম্পূর্ণ উপন্যাসটি লেখা হয় নি, এতে ডায়েজেটিক ধারাও যুক্ত হয়েছে। ঘটনার স্থানান্তরসহ ঘটনাকে কালের দিক থেকে সামনে ও পেছনে নেওয়ার সময় ডায়েজেটিকের ব্যবহার অনেক। শেষ সিকোয়েন্সটি, যা আকারে সবচেয়ে বড়, মিমেটিক ধরনে উপস্থাপিত।
এবার দেখা যাক, দ্যা নর্থ এন্ড আখ্যানটির বর্ণনায় কী ধরনের কেন্দ্রীকরণ (Focalisation) ব্যবহৃত হয়েছে। জেরার্ড জেনেটের মতে আখ্যানের কেন্দ্রীকরণকে বলা যায় দৃষ্টিকোণ (Perspective), অর্থাৎ কোন ঘটনা কার দৃষ্টিকোণ বা শ্রুতিকোণ থেকে অবধৃত হ’য়ে কাহিনীতে স্থান পেয়েছে। আর এই কেন্দ্রীকরণকে তিনি ভাগ করেছেন দু’ভাগে: বাহ্যিক কেন্দ্রীকরণ (External Focalisation) ও অভ্যন্তরীণ কেন্দ্রীকরণ (Internal Focalisation)। বাহ্যিক কেন্দ্রীকরণে আমরা পাই বিভিন্ন চরিত্র যেসব কথা বলছে বা যেসব আচরণ করছে তার রূপ। অর্থাৎ ঘটনার সময় উপস্থিত থাকলে যা আমরা শুনতে ও দেখতে পেতাম, তার বর্ণনা। আর অভ্যন্তরীণ কেন্দ্রীকরণ আমাদের সামনে তুলে ধরে চরিত্রগুলি কী ভাবছে বা অনুভব করছে, তার বর্ণনা। অর্থাৎ অভ্যন্তরীণ কেন্দ্রীকরণ এমন বিষয় আমাদের কাছে তুলে আনে যা আমরা ঘটনার সময় উপস্থিত থাকলেও জানতে পারতাম না। দ্যা নর্থ এন্ড উপন্যাসটি মূলত অভ্যন্তরীণ কেন্দ্রীকরণ প্রক্রিয়া অনুসরণ করেছে, এবং প্রধান চরিত্র বর্ণালীর দৃষ্টিকোণ থেকে সম্পূর্ণ কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। অন্যান্য চরিত্রগুলি কী আচরণ করছে তা স্বল্প আকারে তুলে ধরা হলেও প্রধান চরিত্র বর্ণালীর ব্যাখ্যার বাইরে তাঁরা যেতে পারেনি। কারণ তাঁদের প্রতিটি কাজ বা আচরণের বিবরণের পরপরই এর ব্যাখ্যা আমরা প্রধান চরিত্রের কাছ থেকে পেয়ে যাই। বাহ্যিক কেন্দ্রীকরণের ব্যবহার অত্যন্ত সীমিত হওয়ায় এ-আখ্যানে পাঠকের স্বতন্ত্র ব্যাখ্যা বা ভাবনা তৈরির সুযোগ থাকে না বললেই চলে।
দ্যা নর্থ এন্ড উপন্যাসের সময়কাল ২০১৯ সালের অক্টোবর মাস—সুনির্দিষ্ট করে বলতে গেলে ৬ অক্টোবর সকালের শেষভাগ থেকে ৭ অক্টোবর সকালের পূর্বভাগ পর্যন্ত। কাহিনীর বর্ণনা থেকেই সময়কালের এই ব্যাপ্তি স্পষ্ট আকারে পাওয়া যায়। সন্ধিপূজা শেষে মণ্ডপের পাশে প্যান্ডেলে প্রসাদপ্রার্থীদেরকে যেখানে সারি করে বসানো হয়—লেখকের বর্ণনায় “পঙ্ক্তিভোজনে বসানো”—সেখানে উপন্যাসের প্রধান চরিত্র বর্ণালী ও অপর প্রধান চরিত্র রাহাতের দেখা। আসলে রাহাতই দেখা করতে এসেছে বর্ণালীর সাথে, আর এর মধ্য দিয়ে উপন্যাসের শুরু। লেখক হয়তো সচেতনভাবে শুরুতেই সন্ধিপূজার সময়টাকে বেছে নিয়ে থাকতে পারেন, জীবনের গুরুত্বপূর্ণ এক সন্ধিলগ্নে উপন্যাসের প্রধান চরিত্র বর্ণালীর উপনীত হওয়া এবং পরবর্তী কালে তার বোধনের ইঙ্গিত হিসেবে। অষ্টমী তিথির শেষ চব্বিশ মিনিট ও নবমী তিথির প্রথম চব্বিশ মিনিট জুড়ে হওয়া সন্ধিপূজা মূলত দুর্গার তৃতীয় নয়ন থেকে প্রকাশ চামুণ্ডা বা চণ্ডী, যিনি দুই অসুর চণ্ডা ও মুণ্ডাকে হত্যার মধ্য দিয়ে এই নাম পেয়েছেন, তাঁর আরাধনা। বলা হয় চণ্ডী অশুভ-বিনাশী এক শক্তির প্রকাশ। এ-কারণেই হয়তো পশুবলি ও ভোগ দেওয়া সন্ধিপূজার অংশবিশেষ। আজকের দিনে শহরাঞ্চলে ভোগের আয়োজন থাকলেও বলির প্রথা প্রায় অনুপস্থিত; শত শত বছর আগে চালু হওয়া নরবলির তো এখন আর প্রশ্নই আসে না। বনানী পূজামণ্ডপও এর বাইরে না। ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর তারিখে সন্ধিপূজার তিথি ছিল দশটা তিরিশ থেকে এগারোটা আঠারো পর্যন্ত এবং প্রসাদের ব্যবস্থা যেহেতু পূজার শেষেই, তাই ধারণা করা যায় উপন্যাসে দুই পুরনো বন্ধু রাহাত ও বর্ণালীর দেখা হয় ঐদিন বেলা সাড়ে এগারোটার খুব কাছাকাছি সময়ে।
বুঝতে অসুবিধা হয় না যে দু’বন্ধুর সখ্য বহু বছরের, তবে যোগাযোগ থাকলেও প্রাণের বাঁধন ছিল কোথাও-কোথাও কিছুটা আলগা। জীবনের নানান বাঁক পরিবর্তন বা চট্টগ্রাম ও ঢাকা দুই শহরে দুইজনের বসবাস হয়তো এর কারণ। তবে সব পুরোনো বন্ধুত্বের মতোই ‘যেখানে শেষ সেখান থেকে শুরু’ করতে তাদের সময় লাগে না। বাঁধন আবার জোরালো হয়ে ওঠে দ্রুতই, আর ফিরে আসে হারানো উচ্ছলতা। এই সবকিছুই পাঠককে বোঝানোর দায়িত্ব লেখক প্রধান চরিত্র বর্ণালীকে দিয়েছেন, নিজে সর্বদ্রষ্টা অন্তর্যামীর ভূমিকা নেন নি। জেরার্ড জেনেটের আখ্যানতত্ত্বের কথন-স্বরের (Voice) তিনটি ভাগকে এহসানুল কবির (২০০৪) বাংলায় এভাবে উপস্থাপন করেছেন: “আখ্যানে কথকের উপস্থিতি বা অনুপস্থিতির ভিত্তিতে আখ্যানকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়। যথা: ক. বিষম-স্বরিক: কথক আখ্যানে অনুপস্থিত; খ. সম-স্বরিক: কথক আখ্যানের একটি চরিত্র; গ. স্ব-স্বরিক: মূল চরিত্র কথক উত্তম পুরুষে আখ্যান উপস্থাপন করছেন” (পৃ. ১৩)। বর্ণালীর মোনোলগসহ নানা বর্ণনা ও বিশ্লেষণ উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে উত্তম-পুরুষে আমরা গল্পটি পেয়েছি। তাই বলা যায় ‘স্ব-স্বরিক’ উপস্থাপন ধারায় আলোচ্য উপন্যাসটি রচিত হয়েছে। আর মাঝেমাঝে প্রধান চরিত্র বর্ণালীকে অ্যানালেপ্সিস বা ফ্ল্যাশব্যাক করতে দেখেছি তার বর শাওন ও বিদেশি-প্রেমিক ডেনিশের কথা বলার সময়ে। রাহাতের সাথে বিশ্ববিদ্যালয়-জীবনের স্মৃতি, ডেনিশের দাদি রোজম্যারির মৃত্যু ও এর কারণসহ অন্যান্য অনেক বিষয় অ্যানালেপ্সিসের মাধ্যমেই পাই।
উপন্যাসটি তিনটি অধ্যায়ে ভাগ করা। এমন বিভাজনের পেছনে কী পরিকল্পনা কাজ করেছে তা স্পষ্ট না। আর অধ্যায়ে বিন্যস্ত করার কারণে সমগ্র কাহিনীতে বিশেষ কোনো মাত্রা যোগ হয়েছে ব’লেও মনে হলো না। প্রসঙ্গান্তরের জন্য কথাসাহিত্যের বহুল প্রচলিত কৌশলগুলোর প্রয়োগই উপন্যাসের স্বাভাবিক রসাস্বাদনের জন্য যথেষ্ট ছিলো। তাছাড়া উপন্যাসটির ব্যাপ্তি ও কলেবর অনেক ছোট, আনুমানিক ৩০ হাজার শব্দের, এবং কাহিনী-পরম্পরার উপস্থাপনও বেশ সরলরৈখিক। অধ্যায় বিভাজন তাই বিশেষ কোনো প্রভাব তৈরি করে না, বরং তা পাঠকের চোখ এড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সাহিত্যের বিদ্যায়তনিক শিক্ষায় শিক্ষিত ও আলোচনায় পারদর্শীজনেরা নিশ্চয়ই বলতে পারবেন যে এতো ছোট আকারের কাহিনীকে উপন্যাস অভিধায় বাঁধা যায় কি না। তবে সাধারণ দৃষ্টিতে ছোট কলেবর, সংক্ষিপ্ত ব্যাপ্তি, চরিত্রের সরলরৈখিক উত্থান-পতন ও সাব-প্লটের আপাত অনুপস্থিতির কারণে দ্যা নর্থ এন্ডকে বড় কলেবরের ছোট গল্প ব’লে মনে হতে পারে।
সতেরো ঘণ্টার এই কাহিনীতে অ্যানালেপ্সিসের মাধ্যমে কাহিনীর পেছনেরও অনেক কাহিনী যুক্ত হয়েছে। প্রধান চরিত্র বর্ণালীকে ৭ অক্টোবর ফজরের আজান হওয়ার আগেই, আনুমানিক ভোর সাড়ে চারটায় (২০১৯ সালের ৭ অক্টোবর সূর্যোদয় হয়েছিল সকাল ৫ টা ৫২ মিনিটে, আর ফজরের ওয়াক্তের ব্যাপ্তি ছিল ৪:৩৭ থেকে ৫:৫১ পর্যন্ত), তার দশদিনের জন্য ভাড়া করা অস্থায়ী বাসায় চলে যেতে হয়। এর মধ্য দিয়ে দ্যা নর্থ এন্ডের কাহিনীরও পরিসমাপ্তি হয়। রাহাত ও তার স্ত্রী তিথি চলে যাওয়ার পর বর্ণালী যদি ঘুম থেকে উঠে পাঠকের সামনে বাকি পরিকল্পনা নিয়ে দাঁড়াতো, তবে এই কাহিনীর ব্যাপ্তি ভিন্নতর মাত্রা পেতে পারতো। জেরার্ড জেনেটের ভাষায় কাঠামো আখ্যানটি (Frame Narrative) প্রোথিত আখ্যানকে (Embedded Narrative) জোরালো ক’রে তুলতে পারতো। যদিও বইয়ের ফ্ল্যাপ থেকে আমরা জানতে পারি এই উপন্যাসে রয়েছে ত্রাণের রাজনীতি, উন্নয়ন ও উত্তরের বিত্তের ভাগ-বাটোয়ারা। আরও বলা হয়েছে যে, “এক বিবাহিত বাঙালি উন্নয়নকর্মীর সঙ্গে তার প্রেমের পরিণাম চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা হয়ে কোপেনহেগেন পর্যন্ত একটা বক্ররেখায় সঞ্চারিত” হওয়ার গল্প এটি। এই সব কিছুরই আভাস আছে উপন্যাসটিতে, কিন্তু বোধের জায়গায় তা ধরা দেয় না । কারণ প্রোথিত আখ্যানটি কাঠামো আখ্যানের তুলনায় অনুজ্জ্বল এবং তা যতটা গভীরতানুসন্ধানী তার চাইতে বেশি বিচারমূলক ব’লে মনে হয় ।
কাহিনীর সরলরৈখিকতা কমাতে নানা অনুষঙ্গের যোগান ছিল, কিন্তু তার একটিও বিস্তার লাভ করে নি। উক্তি ও চিন্তা বেশির ভাগ সময় বিবরণ আকারে প্রকাশিত হয়েছে, কাহিনীর ওপর প্রধান চরিত্র বর্ণালীর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার প্রয়াস হিসেবে। ‘রানিয়া’ চরিত্রটি আগাগোড়া একটি সুপরিচিত নির্দিষ্ট মাত্রায় উপস্থিত থাকলো। প্রথমদিকে বর্ণালীর মোনোলগে এবং পরে বর্ণালী ও রাহাতের কথোপকথনে। এমনকি শেষ দিকে রানিয়া যখন দুজনেরই সামনে উপস্থিত তখনও তাকে বর্ণালীর সনাতন ব্যাখ্যার বাইরে যেতে দেওয়া হলো না। বর্ণালীর কাছ থেকে নানান কিছু শোনার পরও রানিয়াকে সামনাসামনি দেখে ‘কী মনে হচ্ছে’ তা যদি রাহাতকে বলতে দেওয়া হতো, তাহলে রানিয়া চরিত্রটি ভিন্নতর ব্যঞ্জনায় পাঠকের কাছে ধরা দিতে পারত। একই কথা বলা যায় তিথি চরিত্রটির ক্ষেত্রেও। তিথিও গভীরতার দিকে যেতে পারল না। হিরো ভাইকে মনে হলো সময় অতিবাহিত করার অনুষঙ্গ, কাহিনীতে তার ভূমিকা প্রায় শূন্যের কোঠায়। তবে উত্তরপ্রান্তে টাকার অবাধ বিচরণের আরেকটি উদাহরণ হিসেবে তিনি থেকেছেন হয়তো। মনে হয় লেখক শুধু রাহাত ও বর্ণালীকেই কিছু স্বাধীনতা দিয়েছেন, তাদেরকে স্বতঃস্ফূর্ত বা সাবলীল হতে দিয়েছেন। বাকি চরিত্রগুলোর উপরে লেখকের কঠোর নিয়ন্ত্রণমূলক প্রখর নজরদারির ফলে ওরা সাবলীল ও সাধারণ হতে সাহস পেলো না। শাওনের ক্ষেত্রে বলা যায় যে স্ত্রীর ব্যাখ্যায় তার চরিত্রের একটি বৃত্তাকার কাঠামো তৈরি হয়। কিন্তু আবার স্ত্রীর সাথে তার মিথস্ক্রিয়ার বর্ণনায় সে বর্গাকার রূপে সামনে আসে, এবং কোণাগুলোর কারণে তা আর বৃত্তে খাপ খায় না। ডেনিশের পরিণতিও তাই হয়েছে। তবে সফলভাবে উৎরে গেছে রোজম্যারি চরিত্র। লেখকের হয়তো চাওয়া ছিল গল্পের কেন্দ্রবিন্দুতে রোজম্যারিকে রাখা, আর তার মাধ্যমে চ্যারিটি ও এইডকে চরিত্র হিসেবে ধরা। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়েছে চরিত্র হিসেবে রোজম্যারি দারুণভাবে থাকতে পেরেছে, কিন্তু চ্যারিটি বা এইড গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে নি, প্রোপাগান্ডার মতো কিছুক্ষণ বিচরণ করে হারিয়ে গেছে।
প্রসঙ্গক্রমে নানা বিষয়ের অবতারণা হয়েছে দ্যা নর্থ এন্ডে যার বেশিরভাগেরই কারণ বুঝা কঠিন। ওষুধ কোম্পানির দুর্নীতি নিয়ে কথা উঠলো, কিন্তু যা বলা হলো জনপরিসরে মানুষ তার চেয়ে বেশি জানে। রাহাত ভেতরের মানুষ হিসেবে আরও অজানা ও গোপন কিছু বলতে পারতো। তাপমাত্রার রিডিং বিষয়ক দুর্নীতির বর্ণনাকে মনে হলো যেন অভিনেতাদের ন্যাকামি। অভিনেতাদেরকে ‘নিজের একটি দোষের কথা’ বলতে বললে যেমন প্রায়ই পাওয়া যায় ‘আমি যেকোনো মানুষকে সহজে বিশ্বাস করে ফেলি’-ধরনের দোষের উল্লেখ। এটা কী ধরনের দোষ কে জানে! একবার আসলো ডেনিশ ও বর্ণালী একসাথে জিজেক ও তালেব পড়ছে এবং রাজনীতিবিষয়ক পডকাস্ট দেখছে কোনো তর্ক-বিতর্ক ছাড়া। কিন্তু পরে মনের গভীর কোণে গিয়ে সে যা ভাবে ব’লে জানালো তাতে বুঝা মুশকিল আগের কথাগুলোর হেতু কী ছিলো। কেনইবা পুরো নাম ‘স্লাভয় জিজেক’ বা ‘নাসিম নিকোলাস তালেব’ এভাবে বলতে হলো? এমনটা কি হতে পারে যে শাওনের সাথে থাকার কারণে জানার ইচ্ছায় একটা বাধা ছিল সবসময়, ডেনিশের কারণে সে-বাধা খুলে গেছে? বিষয়টা আরও পরিষ্কারভাবে জানতে পারলে ভালো লাগতো ।
আরও ভালো লাগতো কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যা ও শব্দতরঙ্গতত্ত্ব হিসেবে যা বলা হয়েছে সেটা বুঝতে পারলে । তবে প্রধান চরিত্র বর্ণালী জানিয়েছে যে প্রেমে বুঁদ হওয়ায় বৈজ্ঞানিক গোঁজামিলও তখন মনে ধরতো—এটাই হয়তো কারণ। ‘সাড়ে চুহাত্তর’ সিনেমা দেখা ও তার বর্ণনা অকস্মাৎ কেন এলো তাও অস্পষ্ট থাকল। একবার মনে হয়েছিল ‘এ মায়া প্রপঞ্চময়…’ গানের ব্যাখ্যায় চণ্ডীরূপী মা-কালীর কোনো ব্যাখ্যা তুলে ধরা হবে সন্ধিপূজার দিনকে মনে রেখে। পরে দেখা গেলো এটা শুধু রাহাতকে জ্ঞান দেওয়ার উছিলা। নানান কিছু বলা হলো কিন্তু ‘মলিনা দেবীর’ কথা কেন বললো না, কে জানে! আর ‘মাতৃসাজে সেজেছিস মা…’ লাইনেরইবা বিভ্রান্তিকর ব্যাখ্যা কেন করল, বুঝা গেল না। আরও কয়েকটি বিষয় অস্বাভাবিক লেগেছে। যেমন নয় দিনের মধ্যে কোপেনহেগেন চলে যাওয়ার পরিকল্পনা কি করা যায়, ভিসা পাবো এই আশায়? কিংবা শুরুর দিকেই রাহাতকে জানানো হয় যে শাওন জানে বর্ণালী প্রেম করছে এবং শাওন “তোমারে ভুলতে শুরু করেছি কয়দিন হইল” এই বলে টেক্সট মেসেজও পাঠায়, তাহলে বর্ণালী কেন এ-বিষয়ে দ্বিধান্বিত যে শাওন জানে কি না যে বর্ণালী তার সংসার ছেড়ে যাচ্ছে? সেই স্বপ্নদৃশ্য যেখানে রোজম্যারি আপন দিদিমা হয়ে ধরা দেয়, তা চলচ্চিত্র ও সাহিত্যে ইতোমধ্যে অতিব্যবহারের ভারে নূব্জ।
ভালো লেগেছে পুরনো প্রেম ভেঙে যাওয়ার বা যৌথজীবন থেকে সরে আসতে চাওয়ার কারণের ব্যাখ্যা—যা একসময় আকর্ষণ ছিল তাই হয়তো মনঃপীড়ার অন্যতম কারণ এখন। নতুন প্রেমের কারণও খুব চমৎকার যৌক্তিকতায় তুলে ধরা হয়েছে। যদিও বলা হয়েছে এই প্রেমে “কোনো আপাত কার্যকারণ সম্বন্ধ নাই” (বর্ণালী সাহা, ২০২০, পৃ. ৯৭), তবু কাহিনীতে ধরা দেয় যে প্রাত্যহিক চিরায়তের ব্যাপারে উদাস অনুভব, আর অবাধ অনধীনতা ও অকপটতার প্রতি আকর্ষণ এর চালিকাশক্তি। মধ্যবিত্ত মিলেনিয়াল তরুণদের স্ববিরোধিতার উপস্থাপন এবং সময়পরিক্রমায় পরিবর্তনের সাথে খাপ খাওয়ানোর সক্রিয় প্রচেষ্টার বর্ণনা বিচিত্র ও গুরুত্বপূর্ণ চিন্তার যোগান দেয়। পুরো উপন্যাসে ভাষার ব্যবহার সযত্ন মুন্সিয়ানার সুলক্ষণবাহী। দৃশ্যকল্প সৃষ্টির অভিনবত্বও বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। একটি উদাহরণ দেওয়া যাক: “একটি অনির্দেশ্য হাসিহাসি মুখ করে ডানে বাঁয়ে সামনে পিছে তাকিয়ে গাড়ির স্টিয়ারিং হুইল মৃদু ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সাবধানী চালে গাড়িটাকে হামা দেওয়া প্রাণীর মতো দুইটা বাসের চিপায় মোলায়েম করে রাখলো (বর্ণালী সাহা, ২০২০, পৃ. ১০)” । এরকম ভাষা প্রয়োগ উজ্জ্বলতা ছড়িয়েছে উপন্যাসের বহু জায়গায়। শেষত, উপন্যাসের নাম ও রূপ দেখে মনে হয় লেখকের বিশেষ কিছু এবং আরও বিস্তারিত কিছু লেখার পরিকল্পনা ছিল। কেন তিনি সেই বিশেষ কিছু লিখা থেকে বিরত রইলেন, তার উত্তর হয়তো ভবিষ্যতের কোনো আখ্যানে প্রকাশিত হবে।
তথ্যসূত্র
Barry, P. (2009). Beginning theory: An introduction to literary and cultural theory. Manchester University press.
Gennete, G. (1980). Narrative discourse: An essay in method (J. E. Lewin, Trans.). Cornell University Press. (Original work published 1972).
এহসানুল কবির (২০০৪)। প্রমথ চৌধুরীর ছোটগল্প : আখ্যানতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন [অপ্রকাশিত মাস্টার্স অভিসন্দর্ভ] । চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম।
বর্ণালী সাহা (২০২০)। দ্যা নর্থ এন্ড । সমাবেশ।