সোমবার, ২৯ মার্চ ২০২১, ০৩:১০ অপরাহ্ন
পাঁচকন্যা পরিবার
১ : কুড়ি বছর আগের এক বিকেলে
বন্ধু নাগার সঙ্গে একটা বাড়ির সামনে দাঁড়িয়েছিলাম। এমন হতশ্রী বাড়ি গোটা এলাকায় আর একটাও ছিল না।
মরচে ধরা টিনের চালা বেরিয়ে আছে। দেয়ালের ইটের ওপর সিমেন্ট বালুর স্তর খসে গিয়ে শ্যাওলার মখমল পড়েছে। দেয়ালের ঠিক মধ্যখানে নেতিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ধূসর কাঠের দরজা। আধখাওয়া গরাদ নিয়ে আধখোলা পড়ে আছে দুটো জানালা।
এ বাড়ির সামনে আসার কারণ ছিল উঠোনকোণের এক মাঝবয়েসী গাছের মিষ্টি বড়ই। আর কোনো কারণ আমাদের আসার পেছনে না থাকলেও, পাড়ার অন্য ছেলেদের সবার মনের কথা তা ছিল না। বাড়িটাকে এলাকার লোকে পাঁচকন্যার বাড়ি বলে ডাকত। যদিও পাঁচজনকে আমি কখনো একসঙ্গে দেখিনি।
সবার বড় মেয়েটার বয়স বোধয় ছিল পনের-ষোল। আমাদের তখন বারো বছর বয়েস। নারীপুরুষ কেন্দ্রিক আকর্ষণের বিষয়টা তেমন স্পষ্ট নয়। নারী দেখলে সটকে পড়ি। নাগার কথা জানি না।
কিছুক্ষণ পর আমাদের খেলতে যাওয়ার কথা। মাঠটা দূরে তুরাগ নদের পারে। সবাই চলে গেছে আগেই। দুই বন্ধু এসেছিলাম বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে। মিষ্টি বড়ই যদি ভাগ্যে জোটে, দুই বন্ধু খেতে খেতে যাব। খেলার মাঠে পৌঁছুনোর আগেই শেষ করে ফেলব, কাউকে ভাগ দেবো না।
নাগার পকেটে থাকত পেয়ারা গাছের ডালের গুলতি। একটা পলিব্যাগে থাকত কিছু মাটির গুলি, হাতে তৈরি করে রোদে শুকিয়ে শক্ত করে তোলা। চড়–ই পাখি শিকার, ফল পাড়া, কারো ফুলদানি কিংবা টেকো মাথা লক্ষ করে ছুড়ে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করা, এসব কাজে সদ্ব্যবহৃত হতো।
বড়দের মতো ঠোঁট উল্টে নাগা বলল, ‘গুলতিতে সুবিধা হবে না। ঝাঁকাতে হবে। গায়ের জোর দরকার। তুই পারবি?’
শুনে ভালো লাগল আমার।
‘অবশ্যই! না পারার কী আছে!’
বলার সময় তো বলেছি। কিন্তু ঠেলার সময় কা-টা জড়িয়ে ধরার পর বুঝতে পারলাম যা বোঝার। তবু মুখচোখ বিকৃত করে সব শক্তি খাটিয়ে যা করলাম তাতে গাছের পাতারাও কিছু টের পেল না।
নাগা বলল, ‘বুঝেছি। অন্য চিকিৎসা লাগবে। জুতা চিকিৎসা।’
পায়ের স্পঞ্জ স্যান্ডালের একপাটি উঠে এলো আমাদের হাতে। ডাল লক্ষ করে ছোড়ার আগ মুহূর্তে যখন ওর শরীরটা টানটান হয়ে উঠেছে, ঠিক তখনই ঘরের দরজাটা খুলে গেল।
নীল শাড়ি পরা এক মোটাসোটা মহিলা বেরিয়ে এলেন, আগুনের গোলার মতো চোখ, কাঠের মুগুরের মতো হাত, আর পায়ের নিচে যেন চাকা লাগানো।
দু’জন দু’দিকে ফসকালাম।
আমি এক দৌড়ে পাশের লেনে যাওয়ার সরু কালো গলিতে। এক লাফে যখন বুদ্বুদ ওঠা নর্দমাটা পেরোচ্ছি নিজেকে বেশ নায়ক নায়ক মনে হলো। দুই রাস্তা পরে গিয়ে দুজনের দেখা। নাগা হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ‘কঠিন শাস্তি দেবো, কঠিন শাস্তি!’
তুরাগের পারে যাওয়ার চওড়া রাস্তায় উঠেও ওর ক্ষোভ কমল না। ‘কোন ভবিষ্যতের আশায় বড়ই ওরা গাছে রেখে দিয়েছে কে জানে। নিজেরাও খায় না, মানুষকেও দেয় না। একারণেই ওদের কেউ দেখতে পারে না।’
‘নাহ, সাঙ্ঘাতিক মহিলা।’ আমিও একমত হলাম নাগার সঙ্গে। ‘কী শাস্তি দেওয়া যায়?’
‘কঠিন শাস্তি। স্বর্ণলতা তুলে দেবো গাছে। মজা টের পাবে তখন।’
নাগা কোন আত্মীয়ের বাগান থেকে স্বর্ণলতার গাদাখানিক লতা এনে, এক রাতে, পাশের বাড়ির গ্রিল বেয়ে টিনের চালে উঠে গাছের ওপর ছড়িয়ে দিলো।
পরদিন বিকালে আমি আর নাগা পাঁচকন্যার বাড়ির সামনের দিয়ে নির্বিকার মুখে হেঁটে গেলাম। টিয়েসবুজ স্বর্ণলতাগুলো বিকেলের সোনালি আলোর অলংকার পরে আছে। আমি অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। নাগা আমাকে টেনে নিয়ে গেল।
২ : এক হঠাৎ–সন্ধ্যায়
প্রতি রাতে মাপা একটা সময় শহর অন্ধকার হয়ে যেত। লোডশেডিঙের ওই সময়টা ছিল জন্যে সবচেয়ে আনন্দের। নক্ষত্রের আলোর নিচে আমরা লুকোচুরি খেলতাম, রাস্তায় চালতা গাছের ছায়া দেখে ভয় পেতাম, একে অপরের কানে ঠোঁট গোল করে শিষ শোনাতাম, বাঁশবনে ভূতের হাওয়া!
তেমনই এক আনন্দসন্ধ্যায় নাগা আমাকে একা করে দিয়ে মামার বাড়ি গিয়েছিল। মামার বাড়িটা ছিল শহরের আরেক প্রান্তে- রামপুরা। তখন মনে হতো রামপুরা বোধয় পৃথিবীর আরেক প্রান্তে।
সেই রাতে আমি আর অন্যদের সঙ্গে খেলাধূলায় মাতলাম না। চলে এলাম আরো পুবে। পুবের ওই জায়গাটাকে আমরা বলতাম রাস্তার মাথা। সেখানে উত্তর দক্ষিণ সার বেঁধে নানা সব দোকানপাট। মাঝখানের পাকা রাস্তা দিয়ে গাড়িঘোড়া চলে। দোকানে দোকানে তেলের বাতি জ¦লছিল। একটা দুটো দোকানে চার্জলাইট। দেখতে দেখতে হাঁটছি, এমন সময় আমার পাশ দিয়ে দবদবিয়ে এগিয়ে যেতে থাকা এক মহিলার আঁচলের গিঁট থেকে ঝনঝনিয়ে একটা কিছু খসে পড়ল। এভদ্রমহিলা কী ভাবছিলেন কে জানে, টেরই পেলেন না।
‘এই যে! এই যে!’
অনির্দিষ্ট ডাক। কে শুনবে? দৌড়ে গিয়ে তার সামনে দাঁড়ালাম। চাবির গোছাটা বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, ‘আপনার শাড়ি থেকে পড়ল।’
মহিলা গোছাটার দিকে ঝুঁকে তাকিয়ে চমকে উঠলেন।
‘এ কী! কোথায় পেলে!’
‘এইতো, এইমাত্র…’
ভদ্রমহিলা আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন, ‘লক্ষ্মী ছেলে। এটা আজকে কোথায় পেতাম! আল্লা ভালো করুক।’
ওই মুহূর্তে বিদ্যুৎ চলে এলো। পথের দু’পাশের দোকানপাট সব ফকফকিয়ে উঠল আলোয়। সেই আলোয় ওই মহিলা আমাকে দেখে এবং আমিও তাকে দেখে চমকে উঠলাম!
‘তুমি!’
পালানোর পথ খুঁজছি।
‘তুমি ওই নাগার বন্ধুটা না?’
‘নাগা? কে নাগা?’
ভদ্রমহিলার চোখে এবার কৌতুক খেলে গেল। নরম গলায় বললেন, ‘তুমি বাসায় এসো। বন্ধুকে এনো না। শুধু তুমি আসবে।’
‘কেন?’
‘বড়ই দেবো। মিষ্টি বড়ই।’
৩ : গিয়েছিলাম, তবে
নাগার টেনিস বল হারিয়ে ফেলেছিলাম বলে আমার সঙ্গে একচোট ঝগড়া হয়ে গেছে। অনেকের সামনে ও চিৎকার করে আমাকে বলেছে, ‘তুই আমার টেনিস বলের টাকা দিবি!’
দুশ্চিন্তায় আমার ঘুম হারাম হয়ে গেল। নাগা আমাকে খেলতে যেতে আর ডাকত না। আমিও ওর ডাক না পেয়ে অভিমানে মাঠে না গিয়ে রাস্তায় রাস্তায় হাঁটতাম।
একদিন একটা ডাক শুনতে পেয়ে থমকে দাঁড়ালাম।
‘এই ছেলে এই! এই ছেলে!’
পাঁচকন্যার বাড়ির সামনে চলে এসেছি।
খানিকক্ষণ পরের দৃশ্য। আমার সামনে দুটো পিরিচ। একটাতে ছোট ছোট নোনতা নিমকি রাখা, আরেকটায় ঝাল চানাচুর। চানাচুর থেকে বেছে বাদাম মুখে দিচ্ছিলাম। আর মাঝে মাঝে স্বাদ বদলানোর জন্যে চলছিল নিমকি। মাথার ওপর পাখাটা বন্ধ। বিজলির সংযোগ কেটে দিয়েছে নাকি পাখাতেই গ-গোল, জানা ছিল না। আমার সামনে সেদিনের ভদ্রমহিলা বসে ছিলেন।
‘সেই যে বললাম, আর তো এলে না।’
‘জি।’
‘বড়ইয়ের কাল শেষ হয়ে গেল।’
‘সমস্যা নেই।’
পাশের ঘরের দরজার নিচের কাঠামোয় এক পা রেখে আরেক পায়ে নিজেকে ঠেলে দিয়ে নৌকা নৌকা খেলছিল একটা মেয়ে। গোল একটা পেট।
ভদ্রমহিলার কৌতূহল কম নয়। বাবা কী করে, মা কী করে, কার গ্রামের বাড়ি কোথায়, রূপনগরের আগে কোথায় ছিলাম সবাই, বোনের নাম কী, কী করে, কোথায় পড়ে- সব জানতে চাইলেন। খানিক বাদে পরিবার ডিঙিয়ে আশপাশের পরিবারের দিকে এগোল তার আলাপ। কয়েকজনের মুখচোখ পোশাক বর্ণনা করে মহিলা জানতে চইলেন- ওরা কারা, কোন বাড়ির লোক। ওই যে সাদা আড়াইপ্যাঁচে-শাড়ি বুড়ামতন, ওই যে ভুরু তোলা মেয়েটা, ওই ভাঙা ছাতার মুরুব্বি-
সেদিনের পর ছোট ছোট নোনতা নিমকি আমার খুব পছন্দের খাবার হয়ে গেল।
নাগা বলেছিল এদের সঙ্গে কারো সম্পর্ক ভালো নয়। কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে এরা নিমন্ত্রণ পায় না। ঈদে পূজায় স্বাধীনতা দিবসে ওদের কিছু করতে দেখা যায় না। পত্নীর সঙ্গে আলাপ হলেও পতির সঙ্গে আমার তখনও আলাপ হয়নি। ‘ব্যাটা দোতলা বাস চালায়।’ ঠোঁট উল্টে তাচ্ছিলের সঙ্গে একদিন বলছিল নাগা।
সেই বিকেলে দুটো ব্যাপার ঘটেছিল যার জন্যে ও বাসায় পরে আবার যেতে ইচ্ছে করছিল আমার।
এক, সামনের ঘরের জানালার ধারে বেতের তাকের ওপর মলাটখোলা একটা বই চোখে পড়েছিল। হাতে নিলাম। ভদ্রমহিলা বললেন, ‘এই বইয়ে খাঞ্জালির গল্প লেখা। খুব সুন্দর!’
‘অনেক ধূলা।’
‘দাও আমাকে, পরিষ্কার করে দিই।’
বাইরে দাঁড়িয়ে শাড়ির আঁচলে ধূলা সরিয়ে দিলেন। ঘরে এসে আমার হাতে দিতে না দিতেই হাঁচি, পরপর কয়েকটা।
হাঁচির ভাবটা চলে গেলে মুখে হাসি ফুটল এবার।
বইটা উল্টে পাল্টে আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম। প্রথম পাতাতেই একটা ছবি। ভীষণ এক কুমিরের পিঠে বসে ভিনদেশি বিশালদেহী এক মানুষ দাড়িগোঁফের আড়ালে অদৃশ্য ঠোঁটে বন্ধুর মতো হাসছেন। বিরাট এক পাগড়ি মাথায়, হাতে তসবিহ। কুমিরটা হা করে থেকে তার দু পাটির ধারাল দাঁত সব দেখিয়ে দিচ্ছে।
ভেতরে সুন্দর সুন্দর আরো অনেক ছবি। এক রাজার সাথে যুদ্ধ করছেন ওই মানুষটা। সার ধরে দাঁড়ানো গরিব মানুষদের মাঝে খাবার বিলাচ্ছেন। তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে ভীষণদর্শন সব জিন।
হঠাৎ পেছনে শব্দ। তাকিয়ে দেখি দরজার কাঠে পা রাখা ছোট্ট মাঝি মেঝেয় পড়ে গেছে। তাকে তুলতে চেষ্টা করছে খানিকটা বড় আরেকটা মেয়ে। তার মুখচোখের অতিনির্বিকার ভাব। কিন্তু যখন আমার দিকে তাকাল, মনে হলো আমিই যে তার ছোটবোনকে ফেলেছি এ নিয়ে অন্তত তার কোনো সন্দেহ নেই।
এমন সময় দরজায় দেখা দিলেন ওদের বাবা। দেখে আমি ভড়কে গেলাম। খানিক পরে ঘটল দুই নম্বর ব্যাপার।
ভদ্রলোকের মাথাটা স্বাভাবিক আকারের চেয়ে অনেক বড়। বড় টাক আর থুতনির নিচে থলথলে চর্বির দুটা স্তর। ফোলা পেটের ওপর টান টান হয়ে আছে শাটর্, মরি মরি বলে চিৎকার করছে বোতামগুলো। গোমড়ামুখো লোকটা ঘরে ঢুকে আমাকে দেখে স্ত্রীর দিকে তাকাল। পত্নীর হাসি হাসি মুখ দেখে তার মুখটাও নরম হয়ে উঠল কিছুটা।
‘ওই যে সেদিন আমার চাবি খুঁজে এনে দিলো, বললাম না? এই ছেলে।’
এতোক্ষণ আমার সঙ্গে কথা বলে প্রকাশ না পেলেও পতির সঙ্গে কথা বলার সময় গলার ওঠানামায় পাবনার দিককার টান টের পাওয়া গেল।
লোকটা আমার দিকে একবার তাকিয়ে পরমুহূর্তে পকেটে হাত দিয়ে কিছু একটা খুঁজতে শুরু করল। যখন পুরুষ্টু খয়েরি রগরগে হাতটা বেরিয়ে এলো, দেখলাম সেখানে একতাড়া হলুদ চৌকো কাগজ, সরকারি বাসের সিলমোহর বসানো টিকিট।
তাড়াটা আমার দিতে বাড়িয়ে দিয়ে লোকটা বলল, ‘নাও। খেইলো।’
আমি টিকিটগুলো নিয়ে বললাম, ‘ধন্যবাদ!’
‘ভদ্রঘরের ছেলে।’
যাওয়ার আগে টেবিলের ওপর রেখে এলাম খাঞ্জালির বইটা। যদিও মনটা তাতে পড়ে রইল।
৪ : জীবনের ওপর–ঢেউ, নিচ–ঢেউ
খান জাহান আলীর গল্পের টানে আমি আবার ওই বাসায় উপস্থিত হলাম। একবার, দু’বার, তিনবার। সামনের ঘরের বেতের চেয়ারে বসে বসে পড়তাম বইটা।
ভদ্রমহিলাকে আমি ইতোমধ্যেই খালাম্মা বলে ডাকতে শুরু করেছিলাম। খালাম্মার মেয়েদের ভাবগতি আমার কাছে খুবই অসুবিধাজনক ঠেকছিল। মনে হচ্ছিল ওরা কেউই দেখতে পারে না আমাকে। একদম যে বড়, পনের বছরের অলি। তার ব্যাপারে কিছুটা সন্দেহ ছিল, বুঝি সে আমাকে তত অপছন্দ করে না। সেই অলি একদিন আমার সামনে জলভরা সবুজাভ কাচের গ্লাস নামিয়ে রাখার সময় কিছু জল ছলকে পড়ে গেল। তখন কেন যেন মনে হলো, সেও সহ্য করতে পারছে না।
একেবারে ছোট যে, বছর পাঁচের মতো বয়স, তার আমি ভীষণ শত্রু। থেকে থেকেই চিলের মতো ছুটে এসে আমার চুলে হ্যাঁচকা টেনে পালিয়ে যায়। চতুর্থদিন মেজো মেয়েটা দরজা খুলে বলল, ‘বইটা নাই।’
‘কোথায়?’
‘হারিয়ে গেছে।’
খালাম্মা এসে আমার হয়ে ওদের অনুরোধ করতে থাকলেন, ‘ওটা ওকে পড়তে দে মা, এমন করিস কেন? ও তো তোদের ভাই!’
মেজ মেয়েটা দরজা ধরে দাঁড়িয়ে ছিল। বলল, ‘ও ভাই না। আমাদের ভাই তোমার পেটে।’
চমকে উঠে মহিলার পেটের দিকে তাকালাম। তাইতো! কেন আগে চোখে পড়ল না?
মেজো মেয়ের উত্তর শুনে হাসতে হাসতে বেতের চেয়ারে বসে পড়লেন ভদ্রমহিলা।
গত সপ্তাহে এসে দেখেছিলাম নিত্য পরে থাকার শাড়ি আর পরনে নেই ভদ্রমহিলার।র্ একটা ঢিলেঢাল জোব্বার মতো সবুজ জামা পরেছেন। জামার জমিনে সুতোয় ফুটিয়ে তোলা ফুল পাতার নকশাটাই কেবল ভালো লেগেছিল। আর কিছু মনে আসেনি। আজও সেই সবুজ ঢিলে জামাটাই পরনে।
আপাতত এখানে আমার সময় ঘনিয়ে এসেছে। একপক্ষের সমর্থনে বেশি সময় টিকে থাকা যাবে না। আজ আঘাত পরোক্ষভাবে এলো। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ওরা আমাকে কিছু বলছে না। যেদিন বলবে সেদিন মাথা কাটা যাবে।
আমি চলে আসছিলাম। খালাম্মা পেছন থেকে ডাকলেন।
‘এই বাবু, এই!’
আবার গেলাম।
তিনি আমার দিকে বইটা বাড়িয়ে ধরে বললেন, ‘নিয়ে যাও। বাসায় প’ড়ো। নয়ত ওরা নিয়ে নেবে। আমার মেয়েরা খুব দুষ্টু।’
বইটা নিয়ে প্রথমে কয়েক পা হেঁটে চললাম। হঠাৎ দৌড়–তে শুরু করলাম। তার কোনো মেয়ে এসে যদি ছিনিয়ে নেয়? এক দৌড়ে বাসায়। ঝাঁপিয়ে পড়লাম বিছানায়।
এবং লম্বা সময়ের জন্যে বিছানা নিলাম এরপর।
ব্যাপার হলো, হঠাৎ একদিন পিঠ ফুসকুড়িতে ভ’রে গেল।
অগ্রপথিক মেডিসিন হলের ডাক্তার জাফর ঘোষণা করলেন, ‘হাম হয়েছে।’
দুষ্টু ফুসকুড়ি পিঠ থেকে সারা শরীরে ছড়িয়ে গেল। নিয়মিত জ¦র আসে। আমাকে আবোল তাবোল বকিয়ে বিদায় নেয়।
দিন কুড়ির ভেতর জ¦র নিয়ন্ত্রণে এলো। মরে কালচে হয়ে থাকা ফুসকুড়িগুলো ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেতে থাকল।
এরপর জন্ডিসে পড়লাম।
জন্ডিস আমার বাকিটুকুও নিঙড়ে বের করে নিলো। ডাক্তার জাফর এসে দেখে বললেন, ‘এই ছেলের আঙুল নাড়ানোও নিষেধ!’
খাঞ্জালির বইটা হারিয়ে ফেলেছিলাম। শিয়রে এখন ‘ম্যান এগেইনস্ট দ্য সী’। আমি জাহাজের কাঠের পাটাতনের ওপর শুয়ে থাকা পীত রোগী শেষ নাবিক। সঙ্গীরা মারা গেছে সবাই। দোলায়মান সাগরের বিশাল বুকে বেঁচে আছি একা। সময় আর খুব বেশি বাকি নেই।
নাগার নানি মালদহের মানুষ। রূপনগরে মেয়ের সঙ্গে থাকতেন। একদিন দেখতে এসে রেগেমেগে বললেন, ‘ছেলেটাকে মেরে ফেলছ তোমরা! লিয়ে চলো যেখানে বলচি সেখানে!’
এক কবিরাজের কাছে আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো। কবিরাজ আমার মাথায় তিনবার কী এক সামুদ্রিক মাছের কাঁটা ফুটিয়ে দিলো। একটা কালো বোতলে ঢেলে দিলো কোন এক অচিন গাছের শেকড় ছেঁচা রস। আর বলে দিলো, ‘প্রতিদিন দুই গ্লাস করে অড়হড় পাতাবাটা রস খাইতে হইব।’
মনে মনে বলতাম, ‘ঈশ্বর, আজ যারা আমাকে অড়হড় পাতার রস খেতে বাধ্য করল, তাদের যেন কোনোদিন ক্ষমা কোরো না।’
বাবাকে একদিন বললাম, ‘বাবা, পাঁচকন্যা পরিবারে যাও। খালাম্মাকে বলো আমার অসুখ। নয়ত তিনি আমাকে খারাপ ভাববেন?’
‘কেন বাবা?’
‘ওই যে বই পেয়ে আর গেলাম না!’
বাবা বললেন, ‘আচ্ছা যাব, যাব।’
একদিন গেল, দুদিন গেল, বাবা আর যান না। ওটুকু গিয়ে একটু বলে আসতে কী এমন কষ্ট?
চতুর্থদিন জিজ্ঞেস করতেই বাবা উঠল ধমকে!
থাক, যেতে হবে না। আমি ভালো হয়ে নিই, নিজেই যাব। ভালো কি হব না? হব তো নিশ্চয়ই।
৫ : পাখি দুটি
স্কুল ভুলেছি, বই ভুলেছি, ভুলেছি খেলাধূলা, বন্ধুর মুখ। প্রায় মাস তিনেকের ধাক্কা।
যেদিন নিজ থেকে উঠে বসতে পারলাম, গোসলটাও নিজেই করলাম। কালো কুয়া থেকে জল তুলে রাখা ছিল। আমি কেবল রুপালি মগ কেটে ঢাললাম। মাথার ওপর আমার প্রিয় আমগাছ। কত দিন পর দেখছি!
দুপুরে খাওয়ার পর মা যেই ঘুমাল, আমি পায়ে স্যান্ডেল গলিয়ে ধীরে ধীরে ছিটকিনি খুলে বাইরে এলাম।
বড়ই গাছটা তেমনই আছে। নাগার দেওয়া স্বর্ণলতা ওরা আর নামায়নি। লতাটা আপনাতেই শুকিয়ে গেছে। বাড়িটা আগের মতই। মলিন, নিঃশব্দ। সবাই দুপুরের সিয়েস্তা দিচ্ছে বোধয়। কড়া নাড়া কি ঠিক হবে?
কড়া কখন নেড়েছি নিজেও বলতে পারি না। টের পেলাম পা ঘষে ঘষে কেউ এগিয়ে আসছে । খালাম্মাই হবেন।
ভেতর থেকে মেজো মেয়েটার কণ্ঠ ভেসে এলো, ‘কে?’
‘ইয়ে, আমি! ওই যে-’
চেয়ার টেনে এনে তার ওপর দাঁড়িয়ে দরজা খোলা হলো। আমার অনুমান ভুল নয়। মেজো মেয়েটিই। কিন্তু এ কী। চোখ বসে গেছে চাঁদ-গলা জামার ওপর দিয়ে কাঁধের হাড় বেরিয়ে আছে। চুলে চিরুনি লাগেনি।
দুপুর তখন বিকেলমুখী, আলো ধীরে কোমল হয়ে আসছে। সেই আলো এসে পড়ল ওই বালিকার চোখে। লাল চোখের মনি, ভারি সুন্দর। এর আগে আর কখনো মনে হয়নি এমন।
মেয়েটা সরে ভেতরে আসতে জায়গা করে দিলো আমাকে।
ভেতরে গিয়ে আমার সেই বেতের চেয়ারে গিয়ে বসলাম। ঘরের বাতাসে একটা কাঁথা-ভেজা স্যাঁতস্যাতে গন্ধ। এরসঙ্গে যুক্ত হয়েছে পাখির গায়ের গন্ধ। কী ব্যাপার?
জানালার কোণে ফড়ফড় শব্দ হলো । তাকিয়ে দেখি বইয়ের তাকের পাশে একটা হেলানভাঙা চেয়ারে রঙওঠা একটা খাঁচা। তার ভেতর উড়ে উড়ে শিকবদল করছে নীল দুটি পাখি। যখনই থামছে, ঘাড় কাত করে চটপট দেখে নিচ্ছে আমাকে।
‘বাহ! খুব সুন্দর তো!’ বললাম আমি। মেয়েটা হাসল।
এরপর হঠাৎ পাশের ঘরে ছুট! কিছুই বুঝতে না পেরে আমি বোকার মতো তাকিয়ে থাকলাম। বসে থাকব না উঠব বুঝতে পারছিলাম না। এমন সময় পাশের ঘর থেকে বেরিয়ে সামনে এসে দাঁড়াল বড় বোন অলি। তার চোখ দুটো ফোলা ফোলা, বোধয় মাত্র ঘুম ভেঙে উঠে এসেছে। তার পেছনে দেখা দিলো মেজো মেয়েটা।
বললাম, ‘খালাম্মা কোথায়?’
মেজো জন আঙুল তুলে পাখির খাঁচাটা দেখিয়ে দিলো। ভুরু কুঁচকে তাকালাম। মানে কী এর। মেয়েটি বলল, ‘মা তোমার জন্যে একটা উপহার রেখে গেছে।’
‘উপহার?’
অলি বলল, ‘অপু, উপহারটা নিয়ে এসো। রনির বিছানার নিচে।’
অপু ভেতরে চলে গেল। বসার চেয়ারের ভাঙা হাতল, ধূলাপড়া বইয়ের তাক, দরজায় ঝোলানো আধভেজা কাপড়, মলিন ওয়েলক্লথের ছেঁড়া প্রান্ত, পলেস্তরাখসা মানচিত্রে ভরা দেয়াল- এসব দেখে ভালো লাগছিল না আমার। জানালার দিক থেকে পাখির ফড়ফড় শব্দ আসছে। আর ঘন কিচিরমিচির।
একটা থেকে লাল মলাটের বই হাতে ঘরে এলো অপু। বাড়িয়ে দিলো। ‘বত্রিশ সিংহাসন’। বইয়ের ওপর উলিপোকা ঘর করেছিল। নখ দিয়ে খুঁটে তুলে ফেলা হয়েছে। মলাটে সরু গোঁফের এক রাজা ঘাড় বাঁকিয়ে পেছনে সিংহাসনের দিকে তাকিয়ে আছে। ভেতরে সবুজ আর নীল কালিতে লেখা। লাল কালিতে আঁকা বড় দাঁতের রাক্ষস আর অতিকায় সব সাপের ছবি। তাদের সঙ্গে যুদ্ধরত নেই সরু গোঁফের রাজা।
আমি বন্ধ করে বললাম, ‘ধন্যবাদ, কিন্তু খালাম্মা কোথায়!’
অলি বলল, ‘অপু তো দেখালই। পাখি হয়ে গেছে। বাম পাশের পাখিটা।’
‘পাখি হয়ে গেছে?’
‘ডানের পাখি আমাদের ছয় নম্বর বোন।’
আমি খাঁচার দিকে তাকালাম। সোনালী আলোয় নীল পাখি দুটো তখনো ঘন ঘন শিকবদল করছে। আর অস্থির কিচির মিচির!
অপু বলল, ‘হাসপাতাল থেকে ওদের খাঁচায় করে নিয়ে এসেছে বাবা।
অলি খাঁচার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলল, ‘প্রথমে কেউ বিশ্বাস করেনি। কিন্তু এটা সত্যি।’
‘কোনটা সত্যি?’
‘এসো?’ অলি পেছন ফিরে হাসল। ‘ডেকেই দেখো না। মা সাড়া দেবে।’
(প্র্যাক্সিসে প্রকাশিত গল্পটি ২০১৮ সালে পরানকথায় ছাপা হওয়া‘পাঁচকন্যা পরিবার’ গল্পের নতুন সংস্করণ : লেখক)