রবিবার, ২৮ মার্চ ২০২১, ০৪:২৮ অপরাহ্ন
দুই পুরুষ-কবির কবিতায় নারীচেতনার স্বরূপ
পৃথিবীর প্রাণ ও সভ্যতার মূল পাদপীঠ মানবঅস্তিত্ব ও মানবতার শেকড় প্রোথিত ‘নারী’ ও ‘পুরুষ’ নামক দুটি পৃথক সত্তার সুষম সমন্বিত চারণভূমিতে। বাস্তবতার নিরিখে এই দুটি মানব সত্তার আদর্শিক মানদন্ডবিহীন পৃথিবীর ইতিহাস পূর্ণাঙ্গ ও সভ্যতার বিকাশ স্বতঃস্ফূর্ত হতে পারে না। ভূলোকের জন্মলগ্ন থেকে আজ অবধি মানবসভ্যতা এই সম্বন্বয়হীনতার সংকটে আবর্তিত। নেপথ্যের প্রধান কারণ মানুষ হিসাবে পুরুষ ও নারীর সমাবস্থানে বৈষম্য। এই বাস্তবতা পৃথিবীর উন্মেষকাল হতে বর্তমান পর্যন্ত পরীক্ষিত এবং স্বীকৃত। বৈচিত্রের অন্বেষণে নয় বরং উক্ত সংকটের পরিপ্রেক্ষিতেই প্রথমত দুই পুরুষ কবির কবিতায় নারীচেতনার বিবর্তন’ গবেষণার বিষয়রূপে গুরুত্ব পেয়েছে। দ্বিতীয়ত বাংলা সাহিত্য তথা বাংলাদেশের সাহিত্যে কবিতা, নাটক, প্রবন্ধ, উপন্যাস, ছোটগল্প অর্থাৎ সাহিত্যের প্রায় সকল শাখায় কমবেশি নারীর অধিকার খর্বায়ন অর্জন-বর্জন, প্রগতি পশ্চাৎপদতা, ইত্যাদি বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে নারীর জীবনবাস্তবতাকে অঙ্কন করা হয়েছে। তবে সবচেয়ে ব্যাপক ও বিচিত্রভাবে তাকে চিহ্নিত করা হয়েছে কবিতায় কিন্তু সবচেয়ে কম গবেষণার বিষয়রূপে উপস্থাপিত হয়েছে এই ভাবনাও এখানে সমানভাবে সমাদৃত। তাই সমকালীন আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটের আলোকে নারীর আত্মিক ও জাগতিক পরিবর্তন অর্থাৎ সংসার-সমাজ স্বভূমিতে নারীর অবস্থান নিয়ে এই দুই পুরুষ-কবির চিন্তার প্রতিফলন ও নারীর জন্য নির্ধারিত স্থানগুলো খোঁজার প্রয়াসও এখানে সমান গুরুত্বের দাবি রাখে। স্বকীয়তায় স্বতন্ত্র, সৃষ্টশীলতায় অনন্য এই দুই পুরুষ-কবি হলেন-শামসুর রাহমান (১৯২৯-২০০৬), আল মাহমুদ (১৯৩৬-) তাঁদের কবিতায় বিবর্তিত নারীর চেতনাবোধকে পরখ ও নিরিখ করার পূর্বে সঙ্গত কারণেই বাংলা কাব্যাঙ্গনে নারীর অবস্থানকে চিহ্নিত করা আবশ্যক। পাশাপাশি পৃথিবীর ইতিহাস তথা ধর্মতত্তে¡র আলোকে নারীর অবস্থান নির্ণয় করা সমান গুরুত্বের দাবি রাখে।
মানবসভ্যতার ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকালে আমরা দেখব স্বাধিকারের প্রশ্নে নারীরা সবসময়ই নিগৃহীত ও বঞ্চিত, তাই দেখি নারী কী বা কে? পুরুষতান্ত্রিক সমাজ এ প্রশ্নের সর্বাপেক্ষা নিকৃষ্টতম ও সবচেয়ে অভিনব-সব উত্তর দিয়েছেন যেমন ‘নারী হচ্ছে জরায়ু’। এখানেই ক্ষান্ত হয়নি পুরুষ। এরিস্টটল বলেছেন, ‘নারী কিছু গুণের অভাববশতই নারী; আমরা মনে করি নারীস্বভাব স্বাভাবিকভাবেই বিকারগ্রস্ত। প্রাকৃতিকভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত।’ সেইন্ট টমাস ঘোষণা করলেন, ‘নারী হচ্ছে বিকৃত পুরুষ’, একটি ‘আকস্মিক সত্তা’ রুশো; শেক্সপীয়র; নীৎশে-বোদলেয়ার এরা তো রীতিমত নারীর খিস্তি করেছেন। ফ্রয়েড বানিয়েছেন নারীকে দেহসর্বস্ব। প্লেটো ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন, তাকে নারী হিসেবে সৃষ্টি না-করার জন্য। করিথিয়ানদের উদ্দেশ্যে লেখা বক্তব্যে জনপল বলেছেন-‘প্রত্যেক পুরুষের প্রভু খ্রিষ্ট আর প্রত্যেক নারীর প্রভু হল পুরুষ’। হিন্দু ধর্মশাস্ত্রের অন্যতম শতপথ ব্রাহ্মণে ‘নারী, শুদ্র, কুকুর ও কালো পাখিকে সমার্থক শব্দ অসত্য, পাপ ও অন্ধকার বলে আখ্যায়িত করে তাদের প্রতি দৃষ্টিপাত করতে বারণ করা হয়েছে।’ বাৎসায়নের কামসূত্র গ্রন্থে পুরুষের ভোগী দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে নারীজাতিকে ভাগ করেছেন- ‘পদ্মিনী, চিত্রিনী, শঙ্খিনী ও হস্তিনী। এই ভাগের মাপকাঠি হচ্ছে নারীর দৈহিক গড়ন, এবং রতিজ আবেদনের রকম ভেদে।’ হিন্দু ধর্মে, শ্রীকৃষ্ণের পরমাত্মায় বিলীন জীবাত্মা হচ্ছে বাধা। ইহুদি-খ্রিষ্টান মুসলমানদের ধর্ম বিশ্বাসে নারী হচ্ছে একটি অশীল বক্র হাড়। বলা হয়ে থাকে যে, হাওয়া বা ঈভ মানবজাতির মাতা। কিন্তু ধর্ম গ্রন্থও যেহেতু পুরুষতস্ত্রেরই অনুশাসনের স্বীকৃতরূপ ফলে মারাত্মক স্ববিরোধিতা। ইহুদি-খ্রিষ্টান-মুসলমানদের ধর্মগ্রন্থে হাওয়া বা ইভের আগে আদমকে তৈরি করে উল্টে দেয়া হয়েছে মানবজন্মের স্বাভাবিক রীতি। নারীকে জন্ম দেয়া হয়েছে পুরুষের দেহ থেকে অর্থাৎ পুরুষই হয়ে উঠেছে নারী জাতির মাতা।
নারীর মিথীয় চরিত্রগুলোতেও তার দৈহিক সৌন্দর্য ও যৌনতার অবাধ অপব্যবহার করা হয়েছে। ভেনাস, আফ্রোদিতি, হেরা, এথেনা, ইকো, হেলেন, দ্রৌপদী, কুন্তী, অহল্যা প্রমুখের কথা বলা যেতে পারে। এরাই আবার দৃশ্যত হয়েছে কবির কবিতায়, চিত্রকরের রংতুলিতে, স্থাপত্যবিদের ইট, পাথর, কাঠ, কাগজে। স্বর্গেও রয়েছে পুরুষের মনোরঞ্জনের জন্য আপ্সরা, হুরদের সমাবেশ। সুতরাং প্রতীয়মান হচ্ছে প্রাচীন, মধ্যযুগ, আধুনিক, সব যুগে সব কালে, সকল ধর্মীয় গ্রন্থ, মিথপুরাণ সবখানেই মোটাদাগে নারী ২/৩টি বাস্তবতায় চিহ্নিত হয়। এক. নারী নিকৃষ্ট থেকে নিকৃষ্টতর এক পশু। পুরুষের সূতিকাগারে পুরুষেরই দেহখÐ থেকে তার সৃষ্টি দুই আবার এই নারীই পুরুষের সবচেয়ে সুস্বাদু ভোগের প্রসাদ; তিন সকল নিন্দাবাদের পরও নারী সর্বকালে সাহিত্যের নন্দিত নিন্দিত লোভনীয় উপকরণ। ‘ভোগায়তনে’র স্তুতিরূপ।
ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞা ও সামাজিক বিধি নিষেধের বেড়াজালে নারীকে ক্যামোফ্লেজ করে রাখে এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা। পুরুষের ভণ্ডামির মুখোশ-উন্মোচনে প্রথম কলম ধরেন বত্রিশ বছর বয়সের তরুণী মেরী ওল্ডস্টোন ক্রাফ্ট রচনা করেন নারীর স্বাধিকারের প্রথম ‘মুখপত্র’ বিপ্লবের বহ্নিস্ফূরণ গ্রন্থ দি ভিন্ডিকেশান অফ দি রাইটস অফ ওম্যান (১৭৯২) এর ১৫৭ বছর পর আবির্ভাব ঘটে আরেক তেজস্বী নারী সিমোন দ্য বোভোয়ারের রচনা করে নারী-অধিকারের অসাধারণ গ্রন্থ ল্য দ্যজিয়েম সেক্স -এই দুইজন অগ্নিশিখার মাঝখানে আলোকিত আরেক অগ্নিকন্যা বেগম রোকেয়া-যার জন্ম ভারতবর্ষের মুসলিম ক্ষয়িষ্ণু সামন্তপরিবারে। অত্যাশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে পৃথিবীর তিন সময়ে তিন মেরু থেকে উঠে আসা এই নারীদের চিন্তার যোগসূত্র ছিল এক ও অদ্বিতীয় আর তা হচ্ছে ‘পুরুষতান্ত্রিকতা’র বিনাশ। বিশ শতকের প্রথমার্ধে পুরুষপ্রদত্ত ‘নারী চিরন্তনী’ ধারণাকে তারা সমূলে উড়িয়ে দেন। সিমোন দ্যা বোভেয়ার যখন বিবৃতি দিয়েছেন ‘কেউ নারী হয়ে জন্ম নেয় না বরং হয়ে ওঠে’।
প্রায় সমসাময়িক কালে বেগম রোকেয়া ‘পাজরতত্ত্বে’র জবাবে দেন অগ্নি উদগারক বিবৃতি, ‘আমাদিগকে অন্ধকারে রাখিবার জন্য পুরুষগণ ঐ ধর্মগ্রন্থগুলিকে ঈশ্বরের আদেশপত্র বলিয়া প্রকাশ করিয়াছে।’ পৃথিবীর অন্ধকার এককোণে উগ্র পিতৃতন্ত্রের দাবানলের মধ্যে একাকী দাঁড়িয়ে মাত্র চব্বিশ বছরের তরুণী বেগম রোকেয়া সরাসরি বাতিল করে দেন, কোনো বিশেষ ধর্মগ্রন্থ নয় বরং মানবসভ্যতার দুটি প্রধান ধর্ম ইসলাম ও খ্রিষ্ট ধর্মগ্রন্থের ‘পাজরতত্ত’কে। বেগম রোকেয়ার পর নারীবাদী রমাবাই নারীমুক্তি সম্পর্কে একটি বক্তৃতা দেয়ার চেষ্টা করেছিলেন ১৮৮৯ সনে। কিন্তু পুরুষাধিপত্যবাদীদের প্রচন্ড বিরোধিতায় বক্তৃতা স্থগিত করতে বাধ্য হয়েছিলেন। সেই সভায় উপস্থিত রবীন্দ্রনাথ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেননি।
কিন্তু পরবর্তীকালে এই বক্তৃতা সম্পর্কে তাঁর যে মত তা পুরুষতান্ত্রিক সমাজের পুরোহিতের কাজই করে- ‘মেয়েরা সকল বিষয়ে যদি পুরুষের সমকক্ষ হয় তাহলে পুরুষের প্রতি বিধাতার নিতান্ত অন্যায় অবিচার বলতে হয়।’ ১৮৯১ সনে রবীন্দ্রনাথ বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন নারীমুক্তির আরেক পথপ্রদর্শক কৃষ্ণভাবিনী দাসের সঙ্গে। নারীমুক্তি আন্দোলনকে তিনি অশ্রদ্ধা দেখিয়ে তাকে বলেছেন ‘কোলাহল’ ‘আজকাল পুরুষাশ্রয়ের বিরুদ্ধে যে একটা কোলাহল উঠছে সেটা আমার অসংগত এবং অমঙ্গলজনক মনে হয়’। যৌবন থেকে বাধর্ক্য পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের মনোচেতনায় নারীর কয়েকটি সুনির্দিষ্ট রূপ গভীরভাবে প্রোথিত। জগত-সংসারের চার দেয়ালে আবদ্ধ কন্যা-জায়া-জননী, কল্পনার স্বেচ্ছাচারিতায় বিলীন মানসী উর্বশী-‘অর্ধেক মানবী অর্ধেক কল্পনা’। বাস্তব ও কল্পনার সংমিশ্রণে তিনি নারীর জন্য মোহনীয় এক রূপ সৃষ্টি করেছেন। পরবর্তীকালে কাব্যাঙ্গনে নারীসত্তার আওয়াজ উত্থিত হলেও, সেখানেও পুরুষের ছায়াতলে কিংবা ধর্মের বেদিতলে নারীকে উৎসর্গিত কিংবা নিখোঁজ হয়ে যেতে হয়েছে। ‘স্ত্রীরপত্র’ ‘গৃহদাহ’-এ নারীর মুক্তি ধর্মের মোহজালে। ‘পয়লা নম্বর‘-এর নারী স্বাধীনতা শূন্যতায় পর্যবসিত। ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’য় ব্যক্তিত্বপূর্ণ নারী চরিত্র ভুল ব্যাখ্যাক্রান্ত।
নারী-পুরুষের মনোদৈহিক ঘনিষ্টতার স্বাভাবিক পরিণতি ‘সঙ্গম’-সেখানেও পুরুষের আধিপত্য। সঙ্গম থেকে নারী-পুরুষের সমস্ত সম্পর্কেকে একটি তাত্ত্বিককাঠামোতে ব্যাখ্যা করেছেন কেইট মিলেট তাঁর সেক্সুয়াল পলিটিক্স (১৯৬৯) বা লৈঙ্গিক রাজনীতি গ্রন্থে।শুরুতেই মিলেট, হেনার মিলারের সেক্সাস, নরম্যান মেইলারের অ্যান আমেরিকান ড্রিম, জাঁ জেনের দি থিকস জার্নাল ও আওয়ার লেডি অফ দি ফ্লাওয়ার্স থেকে নারী-পুরুষের অন্তরঙ্গতম সম্পর্ক অর্থাৎ সঙ্গমে লৈঙ্গিক রাজনীতির পরিচয় দিয়েছেন। দেখিয়েছেন সঙ্গমেও সক্রিয় থাকে আধিপত্য ও ক্ষমতা বা শক্তি। পুরুষতন্ত্রের চূড়ান্ত অভিলাষকেই যেন উন্মোচন করে দিয়েছেন হুমায়ুন আজাদ তাঁর নারী গ্রন্থে ‘পুরুষের চোখে নারীর ভূমিকা চারটি মাতা, কন্যা, বধূ, -এ-তিনটির কোনটি না হলে নারী হয় উবর্শী অর্থাৎ পতিতা। নারী রূপে নারী কোনো মর্যাদা পায় না’।
সমাজ ও রাষ্ট্রের ক্ষুদ্রতম সংস্করণ পরিবারও সমাজে পরিচিত হয় পিতৃতন্ত্র দিয়েই। নারীর পদবীও চিহ্নিত হয় পিতার নামে। এই পিতৃতন্ত্রের চার দেয়ালে নারীর জন্য প্রণীত মর্মান্তিক বিধান : “পিতা রক্ষিত কোমারে ভর্তা রক্ষতি যৌবনে। রক্ষন্তি স্থবিরে পুত্রা ন স্ত্রী স্বাতন্ত্রমর্হতি।” অর্থাৎ কুমারী কালে পিতা যৌবনে স্বামী ও বার্ধক্যে পুত্ররা রক্ষা করবে নারীকে, নারী স্বাধীনতার অযোগ্য। অর্থাৎ নারীর গোটা জীবনের ত্রিকাল তিন পুরুষের নিয়ন্ত্রণাধীন। ইহুদিধর্মে পুরোহিতের অধিকার পেয়ে থাকে পিতা। বাইবেল-এ বর্ণিত আছে : ‘সে তোমার ওপর কর্তৃত্ব করবে।’ কোরানে নির্দেশিত ‘পুরুষ নারীর কর্তা।’ হাদিসে বণির্ত রয়েছে : ‘যদি আমি অন্য কাউকে সিজদা করতে আদেশ দিতাম তাহলে নারীদেরই বলতাম তাদের স্বামীদের সিজদা করতে।’
মূলত উনিশ শতকে দৃশ্যত হয় এক নতুন প্রজাতির নারী। যারা পশ্চিমা সংস্কৃতির অনুকরণে বঙ্গীয় পুরুষের চোখে ‘ভদ্রমহিলা’ নামে পরিচিত। আধুনিক সময়ের পুরুষতান্ত্রিক প্রতিভাবানদের একজন জন রাসকিন তার ভন্ডামির কৌশলরূপে নারীর রোমান্টিক উপাধি দিয়েছিলেন ‘লেডি’। সেকালে শিক্ষিত বাঙালিসমাজ রাসকিনের পরামর্শে তাদের স্ত্রীকে লেডি সম্মোধন করতেন। পূর্বে চার-প্রকোষ্ঠে আবদ্ধ নারীদেরকে অন্তঃপুরিকা, পুরনারী, পুরল²ী, পুরমহিলা, অন্তঃপুরবাসিনী ইত্যাদি স্বরসম শব্দের কাঠিন্য দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছিল বিশেষত বাঙালি উচ্চবিত্ত উচ্চবর্ণের নারীদের । কিন্তু এই নবোদ্ভিত ‘বঙ্গীয় ভদ্রমহিলাদের’ অবস্থা ছিল আরও শোচনীয় অবমাননাকর কারণ তারা শিক্ষিত হয়েও পুরুষের ক্রীড়ানক হয়ে মনোরঞ্জনে নিবেদিত ছিল। তারা ছিল আত্মোজাগরণে ‘মূক’ আর ‘নববাবু বিলাস’ মত্ত বাবুদের মতোই ‘নববিবি বিলাস’ সংস্কৃতিতে ব্যস্ত ।
এই ‘ভদ্রমহিলা’ পুরুষতান্ত্রিকতার যূপকাষ্ঠে বলির শিকার নারীর নব্যসংস্করণ। নব্যশিক্ষিত নারীদের মানসিক হীনম্মন্যতা শিক্ষিতা ‘ইন্দিরা’ দেবীর উক্তিতে স্পষ্ট-“গৃহধর্ম নারীজীবনের সারবস্তু, যাহার জন্য সমাজে নারীর স্থান ও মান।” এ-আধুনিকতার মতে “বঙ্গরমণীর শরীর মন ও ভবিষ্যত জীবনের গঠন স্মরণ রাখিয়া বিশ^বিদ্যালয়ের পরীক্ষার কঠিন সংগ্রামে তাহাদের যোগ দিতে না দেওয়াই ভালো।” রাষ্ট্রের দিকে তাকালে দেখবো ধর্মারোপিত এই বিধানগুলোর পরিপ্রেক্ষিতেই তৈরি হয় রাষ্ট্রীয় বিধান/আইন। তাই স্বভাবতই রাষ্ট্রেও জয় হয় পুরুষতান্ত্রিকতার । সিমোন দ্য বেভোয়ার তাঁর দ্বিতীয় লিঙ্গ গ্রন্থে অস্তিত্ববাদী দৃষ্টিকোণ থেকে নারী-পুরুষের অবস্থান ব্যাখ্যা করে আশাবাদী হয়েছিলে যে, সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন হলে নারী তার অধিকার পাবে। পরে হতাশ হয়ে দেখেছেন যে ‘সমাজতন্ত্রও পুরুষতন্ত্র’। তার এই বাস্তবতা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থাতেও প্রযোজ্য। এছাড়া পেশাজীবীদের পদ ও পারিতোষিকের প্রশ্নেও নারীপুরুষের অধিকারে চরম বৈষম্য।
রাজনীতির ক্ষেত্রে নারীর ব্যবহার সম্পর্কে হুমায়ুন আজাদের বক্তব্য
আধুনিক পুঁজিবাদী দেশগুলোতে নারীদের রাখা হয় সংরক্ষিত হিসেবে। বিপদে পড়লে উগ্র পিতৃতান্ত্রিকদেশগুলোও আবরোধ ও বোরখার ভেতর থেকে বের করে আনে তাদের সতীসাধ্বী নারীদের । যুদ্ধ বা সংকটে সময় পুরুষতন্ত্র ঘর থেকে বের করে এনে নানা কাজে লাগায় নারীদের, আবার শান্তির সময় তাদের দলবেঁধে ঢোকানো হয় ঘরে।
আধুনিক সমাজব্যবস্থায় নারী সবচেয়ে লাভজন উপাদান বিজ্ঞাপন ব্যবসায়। নারীর রূপযৌবন অঙ্গভঙ্গিকে পুঁজি করে ব্যবসায়ীরা আয় করছে কোটি কোটি টাকা।
এবার দৃষ্টিপাত করা যাক বাংলা কাব্যাঙ্গনের অতীত-পরম্পরায় পুরুষের ভাষ্যমতে। পুরুষতন্ত্রের গর্ভাশয়ের অন্ধকূপে পুরুষেরই পাঁজরের অব্যবহৃত যে-হাড় দিয়ে নারীর জন্ম নারীর সেই ‘মাংসপিণ্ড’-কে চর্যাপদের পদাকারগণ নারীর শত্রু বলে চিহ্নিত করেছেন ‘অপনা মাংসে হরিণা বৈরী’। আর নারীর এই মাংসের প্রথম ও প্রধান শিকারী পুরুষ। পরবর্তীকালে মধ্যযুগে বৈষ্ণবপদাবলি, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, পদ্মাবতী, ইউসুফ জোলেখা প্রভৃতি কাব্যে নারীর অঙ্গসুষমার উত্তেজক যৌনতত্তের বিশদ বয়ান বাংলা কাব্য ইতিহাসের একটি সুদীর্ঘ অধ্যায়। এই যৌনরসের সমুদ্রমন্থনের শীর্ষ চূড়ায় দাঁড়িয়ে কোনো কোনো কবির চেতনায় কড়া নাড়ে নারীর মানবসত্তা। তারা যেন হঠাৎ সচেতন হয়ে ওঠে নারীর অস্তিত্ব ও মূল্যায়ন প্রশ্নে। তথাপি শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে রাধাকে কৃষ্ণের কাছে অন্ধভাবে সমর্পিতা নারী রূপে পাঠক আবিষ্কার করে। বৈষ্ণব পদাবলিতেও ‘রাধা’ তার অস্তিত্ব নিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে পারে না। ‘টলায়মান’ নারী-অস্তিত্ব যেন একটা ভিত খুঁজে পায় মনসামঙ্গল কাব্যের ‘বেহুলা’ চরিত্রে কুলক্ষিণী বলে ‘সনকা’র তিরষ্কারে বেহুলার তেজোদৃপ্ত নির্ভীক প্রতিবাদ- “শ্বশুরের কারণে প্রাণনাথ হারাইল।” বেহুলা’র পাশে এসে দাঁড়ালো মধ্যযুগের কাব্য্যাঙ্গনের আরও নারী ‘মহুয়া’, ‘মলুয়া’ ফুল্লরা প্রমুখ। কবি ভারতচন্দ্র রায় গুণাকরকে দিয়েই মধ্যযুগের সমাপ্তি। তার অন্নদামঙ্গল কাব্যে সবকিছুকে ছাপিয়ে সত্য হয়ে উঠেছে নারীর অকৃত্রিম মাতৃত্ববোধ। ঈশ্বরী পাটুনীর আকৃত্রিম আকুতি : ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে।’
যুগসন্ধির কবি ঈশ্বর গুপ্ত, যিনি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও রাজা রামমোহন রায়ের কালে দঁড়িয়েও মধ্যযুগ ও আধুনিক যুগের টানাপোড়েনে ছিলেন প্রবল দ্বিধাগ্রস্ত। নারী এবং নারীর আধুনিক মনষ্কতার বিদ্রুপবাণে জর্জরিত তাঁর যুগসন্ধিকালের কবিতা। আধুনিক যুগের কান্ডারি মাইকেল মধুসূদন দত্ত ধর্ম ও প্রতিমাকেন্দ্রিক কাব্যতত্ত¡কে ভেঙে নারীর কন্ঠে তুলে দিলেন সাহসী উচ্চারণ ‘দানব নন্দিনী আমি রক্ষ: কুলবধূ/আমি কি ডরাই সখি, ভিখারী ‘রাঘবে’?
প্রমিলার একক কণ্ঠ সমবেত কণ্ঠ হয়ে ধ্বনিত হলো ‘বীরাঙ্গনা’ কাব্যেও।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জীবনের অফুরন্ত অভিজ্ঞতায় ‘কন্যা-জায়া-জননীর’ নারীকে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে, শেষপর্যন্ত নারীকে আবিষ্কার করেন সুস্পষ্ট পরিচয়ে, পুরুষের মতই রক্ত মাংস-মেদ-মজ্জা সমেত গোটা মানুষরূপে। সমাপ্তি টানেন বাংলা কবিতার অধরা মানবী, জীবন দেবতা, মানসী তথা ‘অর্ধেক মানবী তুমি অর্ধেক কল্পনা’র নারীকে। রবীন্দ্রকাব্যে নারী শেষপর্যন্ত পুরুষের মিলিত সত্তা হয়ে পাশাপাশি মুখোমুখি দাঁড়ালো মৃত্যুর মুখে দাঁড়ায়ে জানিব, তুমি আছ, আমি আছি।
নারীর অস্তিত্ব পেল পুরুষের মনোযোগ নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবার/কেন নাহি দিবে অধিকার/হে বিধাতা?
তখন স্বাধিকারের দাবীতে নারীর কঠিন আর্তি বিধাতার প্রতি “হে বিধাতা, আমারে রেখো না বাক্যহীনা;/রক্তে মোর জাগে রুদ্রবীণা।”
ধর্মের যাতাকলে পিষ্ট নারীর অসহায়ত্বের বিরূদ্ধে বিদ্রোহিনী রূপ যতীন্দ্রাথ প্রথম দেখিয়েছিলেন তাঁর ‘কৃষ্ণা’ কাব্যে “ধর্ম সে শুধু নরের জন্য/ফিরেও চাহে না নারীর দিকে।”
কাব্যের একটি অংশে কবির প্রশ্ন কৃষ্ণাকে পুরুষ ছিল কি সেই সভাতলে যারে দেখে তুমি লজ্জা পাবে?
যার উত্তর নারী কণ্ঠে প্রতিধ্বনিত হয়, মহাশ্বেতা দেবী’র বিখ্যাত গল্প ‘দ্রৌপদী’তে, যখন ধর্ষিতা, বিবসনা দ্রোপদী বলেছিল, “হেথা কেও পুরুষ নাই যে লাজ করবো।”
এভাবেই ধর্মতত্তে¡র নামে পুরুষতান্ত্রিকতার সম্মিলিত বাক্যবাণে কঠিন কুঠারাঘাত হানে নারী।
যুগযন্ত্রণা আর ব্যক্তিমানস প্রবণতার টানাপোড়েনে বিপর্যস্ত কবি কাজী নজরুল ইসলাম ইতিবাচক, নেতিবাচক মানসপ্রবণতায় নারীকে বিচার করলেও রক্ত মাংসের নারীর অস্তিত্বকে তিনি কখনোই অস্বীকার করেননি। সাম্যবাদ বিশ্বাসী কবি নারী-পুরুষের সমান অধিকারকে সবসময়ই সমর্থন করে গেছেন, “বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যানণকর/অর্ধেক তার গড়িয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।”
শুধু এখানে তিনি থেমে যাননি। নারীর চরিত্রে কলঙ্ক বোঝার সমান দায়ভার তিনি দিয়েছেন পুরুষকে।
জসীম উদ্দীনের গ্রামীণ নারীরাও আপন অনুভূতির প্রকাশে স্বাধীন ও ধারালো মন “সে ত নহে কুমড়ার ফালি, যাহারে তাহারে/কাটিয়া বিলান যায়।”
কবি কালিদাস রায় সমকালীন সমাজের গ্রামের নারীদের শোষণের চিত্র এঁকেছেন নিদারুন ভাবে “এক রাশি এঁটো বাসনের মাঝে একলা পা দুটি মেলে/খিড়কির ঘাটে নূতন বৌটি নয়নের জল ফেলে।
তিরিশ-চল্লিশ দশকের কবিতায় নারীরা এসেছে সমকালীন যুগযন্ত্রণার নির্মম বাস্তবতা হয়ে ‘কল্লোল’, ‘কালি-কলম’ ‘প্রগতি’ অর্থাৎ কল্লোল-কবিরা আধুনিকতার ব্যাখ্যা দিয়েছেন স্বদেশ ও বিশ্বলোকে সংযুক্ত করে নতুন উপলব্ধি বোধের আলোকে।অনিকেত জীবন, মনস্তত্ত্বিক জটিলতার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পাশ্চাত্য রোমান্টিসিজম, ফ্রয়েডিজম, মার্কসিজমের নানা তত্ত¡। তাই তাঁদের কবিতায় নারী স্বতন্ত্র ব্যক্তিসত্তা নিয়ে আবির্ভুত যেখানে গুরুত্ব পেয়েছে নারী-পুরুষের দেহ মনোদৈহিক সম-অধিকার।বুদ্ধদেব বসুর নারীরা কেবল আধুনিক নয়, অনেক বেশি আত্মসচেতন, প্রেমের শোষণ রূপ সম্বন্ধে সর্তক “চেয়েছিলে প্রতি রাত্রে শয্যার সঙ্গিনী/প্রত্যহ পরিচারিকা/সন্তানের মাতা তব, নিপুনা গৃহিণী।”
জীবনানন্দ দাশ, বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণুদের কবিতায় নারীরা অনেক বেশী মানবী সত্ত্বা নিয়ে সুষ্পষ্ট। শাশ্বত নারীর রূপ থেকে বেরিয়ে এসে বুদ্ধদেব বসু তাঁর কবিতায় নারীদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন সুনিদির্ষ্ট নামে- অপর্ণা মৈত্রেয়ী, রমা, কঙ্কাবতী। জীবনানন্দ দাশ সঙ্গে যুক্ত করেছেন নারীর পৈতৃক পদবী বনলতা সেন, শেফালিকা বোস, অরুনিমা স্যানাল, অলকা বসু প্রমুখ। জীবনানন্দ দাশ নারীর মর্ষকামী প্রেমময়ী সত্তাকেই সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব দিয়েছেন। সব কিছুর শেষে নারী তাঁর কাছে স্বস্তির নিঃশ্বাস “আমারে দু’দণ্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন।”
আধুনিক কবিতার একটি প্রধান লক্ষ্য সমাজ ও কাল চেতনাকে একসঙ্গে প্রকাশ করা। তাই দেখা যায় পঞ্চাশ-ষাটের দশকের কবিতায় দেশপ্রেম ও ঐতিহ্য অনেক বেশি সক্রিয়। ৪৭-এর দেশভাগ ৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ, সমকালীন কবিদের চেতনাকে গভীর ভাবে আন্দোলিত করেছে। তাই সমকালিন কবিতায় নারীর ব্যক্তিত্বকে বিকশিত হতে দেখি ভিন্ন-আঙ্গিকে। এখানে নারীর অবস্থান আরও ক্রিয়াশীল আরও তীব্র। নারী সেখানে পুরুষের পাশাপাশি মিছিলের সমবেত কণ্ঠ। অধিকারের প্রশ্নের একই সারিতে দাঁড়ানো। এভাবেই পুরুষতান্ত্রিকতায় সম্মুখ সমরের ভীষণ চক্র থেকে নারী যেন ধীরে ধীরে অনেকটাই মুক্তির পথে। তারপরও হাজারো কৌতুহল রয়ে যায়। সেই অনুসন্ধিসুবোধ আর অন্তর্গত তাগিদ থেকেই এই দুই প্রথিতযশা কবির কবিতায় নারীর অবস্থান অনুসন্ধানের প্রয়াস।
শামসুর রাহমান :
পুরুষ-কবির কবিতায় নারীচেতনার পর্যায়ভিত্তিক পরিবর্তিত রূপ অথার্ৎ বিবর্তনের একটি সুস্পষ্ট ধারা এবং চিত্র অঙ্কনের যোগসূত্র নিরূপনে অনিসুজ্জামানের উল্লেখিত বক্তব্যটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ,
বাংলা সাহিত্যে নারীর এই যে চিত্রণ আমরা পাই, তা কিন্তু প্রধানত পুরুষের রচনা। উনিশ শতকের আগে সাহিত্যক্ষেত্রে নারীর পদার্পণ বিরল ঘটনা। তাই নারীর যে ভাবমূর্তি আমাদের সাহিত্যে দেখা যায় তা বহুলাংশে পুরুষের সৃষ্টি। পুরুষ শুধু নিজের চোখ দিয়ে নারীকে দেখেনি, কি দৃষ্টিতে নারী পুরুষকে অবলোকন করেছেন, পুরুষ সম্পর্কে নিজের সম্পর্কে, জগৎসংসার সম্পর্কে নারী কী ভেবেছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা ব্যাখ্যা করেছে পুরুষই। নারীর নিজম্ব জগতের খতিয়ান এবং নারীর নিবিড়তম অনুভূতির পরিচয় পুরুষ লিখে এসেছে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে। তা যে নারী জীবন ও ভাব জগৎকে বড়োরকম প্রভাবিত করেছে তাতে সন্দেহ নেই। নারী যখন নিজের কথা বলতে শুরু করেছে তখন পুরুষের লেখা থেকে তার জানা হয়ে গেছে, ভালোবাসলে ঘৃণা করলে, কষ্ট পেলে, দু:খ দিলে নারীর অনুভূতি কেমন হয়।
পঞ্চাশ দশকের অগ্রগণ্য কবি শামসুর রহমান। তিনি প্রথমত প্রধানত নারীকে আরাধনা করেছেন প্রেমের পৃথিবী থেকে। তাঁর পূজা ছিল অকপট, নির্ভেজাল। তাঁর কাম্য নারীরা দেহতত্তে¡র উর্ধ্বে নয়। নারীর দেহজ কামনা বাসনাতেই তিনি বেশি প্রলুব্ধ। পুরুষ আরোপিত নারীর চিরন্তন গার্হস্থ্যচরিত্র যেমন তিনি উপভোগ করেছেন তেমনি সন্ধান করেছেন তিরিশের দশকের কবিদের অন্বেষিত রক্ত-মাংস-হাড়-মেদ-মজ্জা, ক্ষুধা -তৃষ্ণা-লোভ-কাম-হিংসা সমেত গোটা মানুষকে নয়, শুধুমাত্র নারীকে, নারী অপাথির্ব নয় বরং পার্থিব হয়েই কবির চেতনায় স্থির,
“আমি নারীকে রক্তমাংসের মানুষ হিশেবেই রাখতে চাই। একটা জিনিশ যোগ করতে চাই, যেটি নারীদের আছে, যেটা অনেক সময়ে কোনো কোনো কবি অবহেলা করেন, সেটি হলো তাদের মেধাও আছে। আমি মনে করি নারী দেহ, মন ও মননটি মেধাসম্পন্ন-আবেগ থাকবেই, মন থাকবে, ভালোবাসা থাকবে, সঙ্গে সঙ্গে মেধাও থাকবে।”
কবি শামসুর রাহমানের আত্মবিবৃতিতে নারী সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি এবং কবিতায় সৃজিত নারী-ভাবনায় বৈপরীত্য সুস্পষ্ট। নারীর মেধার চেয়ে কামজ রূপ তাকে বেশি তাড়িত করে। মধ্যযুগের পাদ্মাবতী, শ্রীরাধা’র অঙ্গ সুষমায় কাতর কবি শামসুর রাহমানও। আধুনিক অনাবৃতা নারীর ভেতর তিনি যেন দেখেছেন মধ্যযুগীয় কবিদের চেতনায় জাগ্রত নারীর নগ্নতা চুপচাপ বসে আছি শোভিত ড্রইংরুমে একা/এবং স্নানের ঘরে তুমি
শাওয়ারের নীচে নগ্ন।/গাছটাকে তীব্র দেখছিলাম তখন।
মনোবিজ্ঞানীরা নারী-সৌন্দর্য থেকে উৎপন্ন আনন্দকে আখ্যায়িত করেছেন যৌনানন্দ নামে। কবিরাও অনিঃশেষ সৌন্দর্যের উপমার গাঁথুনি দিয়ে নির্মাণ করেছেন নারীর যৌনানন্দময়ী রূপ। চর্যাপদ মধ্যযুগ আধুনিক যুগ অতিক্রম করে পঞ্চাশের দশকেও নারীর সৌন্দর্যে মুগ্ধ কবি মন, চেতনার কেন্দ্রবিন্দু একই ‘কামজ নারী’ পরিবর্তিত হয়েছে শুধু প্রকাশের অভিব্যক্তি। কিন্তু লক্ষণীয় যে শালীনতার সংজ্ঞার্থের আড়ালে তাদের অবদমিত আবেগ তারা দমিয়ে রাখতে পারেনি। শামসুর রহমানের নগ্ন আত্মসমপর্ণ “যতদূরে পারে ঠেলে দাও, তবু/তোমার ঘাটেই যাব খেয়া বেয়ে লিবিডোর খালে মেটাবো/মোর আকুল তৃষ্ণা”।
মধ্যযুগের কবিরা স্বর্গের আস্পরাদের সৌন্দর্যে ভোগী হয়েছিল তাঁদের পুরুষতান্ত্রিক চোখ থেকে রেহাই পায়নি অধরা অদৃশ্য সেই নারীরাও। নগ্ন ব্যবচ্ছেদ হয়ে কবিতায় দৃশ্যমান হয়ে স্বর্গের নর্তকী মেনকা, রম্ভা প্রমুখ। আধুনিক নারীর গতিময়তায়ও উপভোগী কবির পুরুষ মন। বিমূর্ত গতি মূর্তমান কবির শব্দশিল্পে চঞ্চলা নর্তকীর মত/কী যে ভালো লাগে।
সৃষ্টিতত্ত্বের মাঝেও পুরুষের কামতত্ত্বের প্রতিক্রিয়া তখন কবিতা লেখাও/ক্লান্ত বারবনিতার সঙ্গে সঙ্গমের মত ঠেকে। নারী নয় বরং পুরুষের অনুভূতি দিয়েই নিয়ন্ত্রিত নারীর মনোদৈহিক জগতÑবরং চুম্বন নাও, আলিঙ্গনে বাঁধো অনুরাগে। এখানেই শেষ নয় মধ্যযুগের বহুলতাকে ছাপিয়ে আধুনিক কবিদের কলমে নতুন নতুন অভিনব উপমায় দৃশ্যত হয়েছে নারীর রূপ। সূ²তার আড়ালে আরও তীক্ষ্ণ তীব্র হয়ে উঠেছে পুরুষের স্থূল আবেগ।
মধ্যযুগের কবি আলাওল যখন পাদ্মাবতীর রূপবন্দনায় শরীরী আবেগে চুঁর। পদ্মাবতীর দেহের এক একটি অঙ্গ পেয়েছে উত্তেজক আবেগাত্মক শব্দের লাস্যময়ী ধ্বনি, কামের কোদÐ ভুরু অলক্ষ্য সন্ধান।/যাহারে হেরিএ তার হানএ পরাণ।।
যখন তিরিশ-চল্লিশ দশকের আধুনিক কবি জীবনানন্দ দাশের চেতনায় নারীর প্রতি সেই একই পুরুষানুভুতি পেয়েছে ভিন্ন চেহারা তবে সেখানেও মূল আকর কামনা বাসনা।পৌরানিক আর দেশীয় ঐতিহ্য ইতিহাসে জীবনানন্দেও নারী কারারুদ্ধÑচুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নেশা/মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য..
তখন, পঞ্চাশের দশকের আরেক আধুনিক কবি শামসুর রাহমানের চেতনার নারী সৌন্দর্য পেয়েছে দেশজ ঘ্রাণ, স্বাদÑসর্ষে ক্ষেতের মত মুখ/সোনালী আঁশের মত চুল,/জেলের ডিঙ্গিও মত ভরু/মেঘনার মত কালো টলটলে চোখ।
নারীর অস্তিত্বের প্রাজ্ঞতায় নয় বরং কামজতার পুরুষ-কবি তার জীবনের ঠিকানা খুঁজে পান। শাশ্বত কামজ পুরুষতান্ত্রিকতায় নারী বারবার ব্যাখ্যাত হয়, যৌনতার আলিঙ্গনে ব্যক্তিসত্তা অগ্রাহ্য “বস্তুত তোমার উপস্থিতি লেখে/জীবনের নাম/আমার নিঃশ্বাসে, তাই তোমাকেই চাই/চুম্বনে, নিবিড় আলিঙ্গনে।”
নারী-পুরুষ সত্তার ব্যবধানের প্রাচীর নয় বরং পুরুষ কবি ভাঙতে চান সুন্দরীতমার সঙ্গে তাঁর কামনার অদৃশ্য দেয়াল “সুন্দরীতমা এসো ভেঙ্গে দেখি/মধ্যখানের পাঁচিল।”
মধ্যযুগীয় মানসিকতা থেকে উদ্ভুত এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর কপাল ভাঙ্গে নানা বিচিত্র পন্থায়। এরমধ্যে একটি হচ্ছে বৈধব্য আরেকটি হচ্ছে আইবুড়ি ভাবনায়। পঞ্চাশের দশকের অত্যাধুনিক কবি শামসুর রহমানের চেতনাও সেই মানসিকতায় আবদ্ধ “কপাল ভেঙ্গেছিল তার/যৌবনের উষায়, তারপর আর কস্মিনকালেও/হাতে মেহেদির ছোপ লাগেনি।”
অর্থাৎ আরেকটি বাস্তবতা এখানে প্রমাণিত উনিশ শতকের প্রারম্ভে বিধবা বিবাহ আইন (১৮৫৬) প্রতিষ্ঠিত হলেও এখনও পুরুষের আকাক্সক্ষার কেন্দ্রমূলে অবদমিত ভোগী নারীর অস্পৃশ্যা আনকোরা যৌনতা। তাই একুশ শতকেও তাদের মানসিকতা একই অন্ধকারে দীর্ণ। পুরুষ নিয়ন্ত্রিত সমাজ-মানসিকতায় পুরুষ, নারীর পূজোর বরসম অর্থাৎ প্রসাদসম। একজন বয়স্কা অবিবাহিতা নারীর চিত্রণে সেই বাস্তবতা সুস্পষ্ট এবং এই ছবি একজন পুরুষ কবির চেতনা থেকে অঙ্কিত “একজন আইবুড়া মেয়ে নিত্য বর প্রার্থনায়/কাটায় সকাল সন্ধ্যা নিভৃতে শহুরে বারান্দায় ।”
‘বিধবা’ শব্দটি নিপাতনে সিদ্ধ। নারীর জন্য পুরুষরোপিত উপাধি অভিনব । যে শব্দের কোনো পুরুষ লিঙ্গ নেই। পুরুষের ক্ষেত্রে ‘বিধবা’র পরিবর্তে ব্যবহৃত হয় বিপত্নীক শব্দটি। অর্থাৎ সে পত্নীবিহীন। তার জন্য দ্বিতীয় দার গ্রহণ সমাজ প্রবর্তিত কিন্তু নারীর জন্য দুষ্কর, দুর্গম। তাই পুরুষ-কবির পর্যবেক্ষণে ‘বিধবা’ নারীর মনস্তত্তে¡ প্রোথিত যৌনাবেগ অস্বীকৃত হয় নি আবার স্বীকার করেছেন স্বামী নামক পুরুষের অধীনে থেকে সন্তান নামক পুরুষের অধীনতাবদ্ধ নারীর জীবন বাস্তবতা। এই একুশ শতকে বাস্তবতায় দাঁড়িয়েও একজন পুরুষ-কবির দৃষ্টিভঙ্গি নারীর সতীত্বকে উৎসর্গের রূপ দিয়ে আঁকতে ভালোবাসে। শুধু এখানেই শেষ নয় পুরুষতান্ত্রিকতার প্রভিভূ হয়ে নারীকে পুরুষের ওপর নির্ভরশীল দেখতেই অভ্যস্ত। নারীর সম্প্রদান তাঁর কাছে সবচেয়ে বেশি স্বীকৃত যার সঙ্গে সহবাসে/ছিলাম একান্ত ডুবে বিশটি বছর, হাড় তার/এখন মাটির নিচে ভয়ানক ধবধবে হয়ে গেছে বুঝি/আমার শাড়ির মতো। হায়, যদি পারতাম হতে/লাশবাহী ভেলার বেহুলা।
শত সহস্র বছরের পুরুষতান্ত্রিকতার রক্তস্রোত কবি শামসুর রাহমানের ধমনীতে প্রবহমান। তাই জীবনের বিচিত্র অনুভুতির মুখোমুখি তাঁর চেতনায় ঘুমন্ত সুপ্ত পৌরুষ জেগে উঠবে এটাই স্বাভাবিক। ফলে নারীর সনাতন রূপ তাকে বারবার আকৃষ্ট করে। কিন্তু উনিশ শতকের আধুনিক সংস্কৃতির রক্তবীজও শামসুর রাহমানের মনস্তত্ত্ব রোপিত তাই নারীর ব্যক্তি স্বাধীনতাও কবির চিন্তায় বিকশিত হবার পথ খুঁজেছে বারবার। ফলে ভিখারিনী নারীর ‘কামজ্বর’-কেও তিনি স্বীকৃতি দিয়েছেন “রাতের আধারে-ফুটপাতে আসে/ভিখিরিনি তার নি-ছাদ ঘরে;/ঘাঘড়া দুলিয়ে কুষ্টরোগীর/ঠোঁট চেপে ধরে কামের জ্বরে”।
পুরুষ প্রদত্ত সনাতন চরিত্র নিয়ে কবির চেতনায় উজ্জাবিত হয়েছে নারীর শৈশবকাল কৈশোর, যৌবন নারীর রুসমতলগ্ন। প্রণয়িনী, জননী, প্রেমিকা, বন্ধু, পুরুষপ্রদত্ত সব উপাধির সমন্বিত রূপ হচ্ছে ‘নারীর সর্বংসহা রূপ’। কী নিঃসংকোচে, কী অসাধারণ দক্ষতায় একুশ শতকের অন্যতম এক পুরুষ-কবির সৃষ্টিতে জ¦লে উঠছে পৌরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীসত্তার কারাগার ও মিথ্যা প্রবোধের স্বীকৃতি “বৃক্ষের গৌরব তুমি দিয়েছ স্বামীকে দীপ্ত কামের মাধবী/শিশুকে সুপুষ্ট স্তন। দাম্পত্যপ্রণয়ে সোহাগিনী/প্রেমিকার মতো হৃদয়ের অন্তহীন জলে, ঢেউয়ে/খর বাসনায় ধুয়ে দান্ত সাধকের ধ্যানে…”
পুরুষের কাছে সর্বাপেক্ষা স্বীকৃত নারীর ধাত্রী রূপ। প্রেমিকা, প্রণয়িনী, মা, বোন, নারীর সকল রূপের মধ্যে তারা সেবিকার প্রতিমূর্তি দেখতে চান, আরোপিত করে দেন “মাঘের সকালে/মায়ের কল্যানী হাতে বোনা হলদে সোয়েটার পরে/যেতাম কিনতে পিঠা কাক ডাকা সচকিত/চাপা ভোরে ।”
নারী, নারী হয়ে উঠার সবচেয়ে শাণিত মধুর বৈশিষ্ট্য হলো তার কলুর বলদের মতো কষ্ট সহিষ্ণু রূপ। নারীর এই নীরব আত্মোৎসর্গকে পুরুষ নাম দিয়েছেন ‘সর্বংসহা’। এই মৃত্তিকা এই ধরিত্রী শত অত্যাচারের মূক, কারণ তাদের ভাষা নেই। নারীও তাদের মতো মূক। নারীকে অন্ধ আবেগে আপ্লুত করার জন্য পুরুষের কৌশলী সমন্বয় নারী ও ধরিত্রী কিংবা নদী ও নারীর সঙ্গে “স্বদেশ মা আমার, মাগো/অথবা, মাকে দেখি প্রতিদিন ধ্যানী প্রদক্ষিণে/ছায়াবৃতা আপন সংসারে।”
বিপন্ন স্বাধীনতাকে পুনরুদ্ধারের নেপথ্যে কবি প্রদত্ত নারীর বিপন্নতার খণ্ডিত বয়ানে উন্মোচিত হয়েছে পুরুষ নিয়ন্ত্রিত সমাজে নারীর জীবনবাস্তবতা “স্বাধীনতা, তোমার জন্যে/হাড্ডিসার এক অনাথ কিশোরী শূন্য থালা হাতে/বসে আছে পথের ধারে”
মুক্তিযুদ্ধকালীন বিপর্যস্ত বাংলাদেশে পাক বেনিয়া কর্তৃক ধষির্ত নারীর আর্তচিৎকারে ভয়ে ঘৃণার অবরুদ্ধ গৃহিনীর অন্তরাত্মা। পুরুষ গৃহকর্তার অব্যক্ত অসহায় দৃষ্টি স্ত্রীর প্রতি। অথচ শেষ পর্যন্ত নারীর কাছেই পুরুষের শেষ আশ্রয় স্থল, স্বস্তির ঠিকানা। পুরুষ প্রদত্ত সামাজিক শাসন-শোষণে নিষ্পেষিত নারী যার ঠিকানা গার্হস্থ্য জীবনের চার দেয়ালে আবদ্ধ, সেই নারীতেই সবচেয়ে বেশি পরিতৃপ্ত পুরুষ-কবি মন-চোখে ক্লান্তি আসে ছেয়ে/তারপর গৃহিনীর কোমর জড়িয়ে বাম পাশ/বেছে শুই, কোমর প্রবেশ করি ঘুমের/গহবরে;
একই কবির সৃষ্টিতে ধর্ষিতা নারীর বিমূর্ত আর্তচিৎকারের পাশে মূর্ত হয়ে আছে গৃহিনী নারীর যন্ত্রণার্ত মূক জীবন। শেষ পর্যন্ত পুরুষ-কবির দৃষ্টি পড়েছে কোনো এক কুমারী নারীর অন্তর্গত স্বাধীন সত্তায় “তোমার দু’চোখ/আগুনের নগ্ন গান? তোমার দু’হাত/যৌবনের সাহসের উজ্জ্বল পতাকা।”
পুরুষতান্ত্রিক সমাজে পুরুষের বহুগামিতা তার ‘পৌরুষ’ রূপে স্বীকৃত আর নারীর গমন কেবল মাত্র তার ভাগ্যে নির্ধারিত স্বামী নামক পুরুষটার কাছে। নারী দ্বি-গমন করলেই সে হয়ে যায় দ্বিচারিনী, পতিতা, গণিকা ইত্যাদি। প্রণয়িনী উর্বর শরীরের আমন ধানের গন্ধে তৃপ্ত নয় বহুগামী, ভোগী পুরুষ-দেহ। পুরুষের এই ভণ্ডামি উন্মোচিত হয়েছে পুরুষ-কবির কবিতায় “বউ যার শরীরে আমন/ধানের সুবাস, যাকে মাঝে মধ্যে প্রবল ফাল্গুন/দোল দিয়ে যায়, জ্বলে সাঁঝবাতি, মন/হয় উচাটন বাঁশঝাড় দেখে। বাউলের গানে/ধুলায় এসেছে নেমে আরশি নগর।/মুনিষকে সালংকরা গণিকার মতো/অবিরত/ডাকে সেই দূরের শহর।
কবি শামসুর রাহমানের কবিতার ‘প্রেম ও নারী’ প্রসঙ্গ সমালোচকের দৃষ্টিতে বিশ্লেষিত হয়েছে এভাবে-
পঞ্চাশের অধিক সময়ের কাব্যচর্চায় শামসুর রাহমান ক্রমাগত এগিয়েছেন তার প্রেম পর্বে। অধিকতর সংহত হয়েছেন। সেটি শুধুই আতœতায় নয়; বাইরের অভিজ্ঞতায়, প্রবহমান সমাজবৈশিষ্টে আর রাজনীতির কর্ম- কাঠামোয়। প্রেম সেখানে অনেকান্ত, অভিসারি যতটা তার চেয়ে বেশি মর্মপীড়ণতপ্ত। বিচ্ছিন্নতাব্যঞ্জিত। আত্মকেন্দ্রিক বিমূঢ়-বিভ্রান্ত। সেখানে প্রেম প্রকৃতগতভাবেই সদানন্দ নয়, কোনো ভৈরবী রাগবাহিত হয়। অনির্বাণ ও দীপিত। শারীরিক যৌনগন্ধময়, বৈষয়িক এবং ভোগবাঞ্ছিতও বটে।
আল মাহমুদ (১৯৩৬-২০১৯)
পুরুষতান্ত্রিকতার রক্ত বীজ দেহে ধারণ করে উর্বর কবি আল মাহমুদের কাব্যক্ষেত। অতীত পুরুষ পরম্পরার সাথে তাঁরও যেন রয়েছে এক গোপন প্রেম। সেই প্রেম নিয়ে তিনি এঁকেছেন শ্বাশত, চিরন্তনী উপাধিতে ভারাক্রান্ত নারী। আল মাহমুদ রক্ত-মাংসের মানবিক দেহের ভাঁজে ভাঁেজ নারীর অস্তিত্বকে আরাধনা করেছেন। পরবর্তীতে সেই নারী বোহেমিয়ান কবির সৃষ্টিশীলতায় কখনো একান্ত পার্থিব নারী, কখনো অপার্থিব, কখনো প্রণয়িণী, ভগ্নী শেষ পর্যন্ত কবির পুরুষ সত্তায় স্বীকৃতি পেয়েছেন শুধুমাত্র নারীর মাতৃত্ব রূপ।
আল মাহমুদ তার কবিতায় প্রচণ্ডভাবে ‘নারীর স্তুুতি’ আছে এই সত্যতা স্বীকার করেছেন এবং তার নিজস্ব অভিমত ব্যক্ত করেছেন-
কথাটা একবারেই সত্য। আমার কবিতায় বাস্তবতে নারী একটা প্রধান স্থান দখন করে আছে। এর কারণ এটা আমার সংস্পর্শ দোষও হতে পারে- সাহিত্য তো আর অজু করে হয়না। আমি অজু করে সাহিত্য রচনা করি না। পুরুষ মানুষ হিসেবে যা দেখেছি তাই লিখেছি।
প্রথমত নারীর প্রেয়সী রূপই কবিকে সবচেয়ে বেশী আকৃষ্ট করেছে। নারীর প্রেমিকারূপ কবির কাছে পরম আরোধ্য, চরম উপভোগ্য। সেই প্রেমিকা অলৌকিক কোন দেবী নয়, রক্ত মাংসের নারী। যাদের তিনি আকাক্সক্ষা করেছেন, পেয়েছেন, আবার হারিয়েছেন, “কখন যে কোন্ মেয়ে বলেছিলো হেসে;/নাবিক তোমার হৃদয় আমাকে দাও,/ জলদস্যুর জাহাজে যেয়ো না ভেসে/নুন ভরা দেহে আমাকে জড়িয়ে নাও।”
পুরুষারোপিত সামাজিক প্রথাসর্বস্ব সম্পর্ককে পাশ কাটিয়ে কবি সেই নারীকে কামনা করেছেন, যে তার পুরুষকে গ্রহণ করবে নিঃশর্ত প্রণয়ে শুধুমাত্র দেহমনোগত সম্পর্ক সূত্রে। একুশ শতকীয় সমাজে নারী যেন স্বতন্ত্র সত্তা নিয়ে কিছুটা স্বীকৃতি পায়, তাও প্রেমের শর্তসাপেক্ষেÑসোনার দিনার নেই, দেন মোহর চেয়ো না হরিণী/যদি নাও, দিতে পারি কাবিনবিহীন হাত দুটি।
ভালোবাসার নারীকে পাওয়ার জন্য কাতর আল মাহমুদ ‘পুরুষ’ হিসেবে নয় শুধুমাত্র একজন ‘কবি’ রূপে নারীকে আশ্বস্ত করতে চেয়েছেন, “বৃষ্টির দোহাই বিবি, তিলবর্ণ ধানের দোহাই/—/দোহাই মাছ, মাংস দুগ্ধবতী হালাল পশুর/লাঙল জোয়াল কাস্তে বায়ুভরা পালের দোহাই/হৃদয়ের ধর্ম নিয়ে কোন কবি করে না কসুর।”
দরিদ্রতার মলিনতায় দীর্ণ পুরুষতন্ত্র, “কেন যে আসতে চাও, এ যে বড় ভয়ানক দিন/চালের লতানো ফুল মরে যাবে বৃষ্টির অভাবে/দুঃখের চৌকাঠ ভেঙ্গে যদি আসো, দাঁড়াবে কীভাবে?”
মানবিক সংসারে যুগ-যুগান্তরে নারীর উপর শাসিত ‘পুরুষসত্তা’ নারীকে নিয়ন্ত্রিত করে তার যৌনখÐের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায়। পুরুষ তার পৌরুষদৃপ্ত অহংকারে তৃপ্ত “প্রথম রাত্রিতে তার বীর্যবান সন্তানের বীজ/সযত্নে ধারণ করে আমি হবো ক্লান্ত ফলবতী।”
নারী প্রেমজ যৌন সুখে নতজানু পুরুষের কাছেÑসবি তো দিলাম তুলে যা ছিল এ দেহের ভূভাগ/তার বিনিময়ে করি মাঠ ঘর সন্তানের দবি।
নারী-পুরুষের এই চিরন্তন রূপই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে সবচেয়ে বেশি উপাদেয়। পুরুষের যৌন পৃথিবীতে সর্বহারা, সর্বসংহা নারীর যৌনজীবন। নারীর এই আনত পূজাই পুরুষের কাম্য। মধ্যযুগের কবির স্থূল নারীরূপ, শামসুর রাহমানের নিসর্গ রূপের সুক্ষতায় লীন হয়ে, আরেক নতুন লজ্জাহীন রূপ হয়ে উন্মোচিত হয় আল মাহমুদের কবিতার নারীদেহে। শতাব্দী পরম্পরায় পুরুষের প্রতিভূ আল মাহমুদও শেষপর্যন্ত ভোগী পুরুষ মন নিয়ে নারী শরীরকে ব্যবচ্ছেদ করে, “তুমি আমার একটি থোকা কালো আঙুর/সারা শরীর জড়িয়ে আছি লতাগাছি
তোমার দেহে মনে আমার বেহায়া সুর/আমি ভ্রমর, তুমি তোমার কালো মাছি।”
নারী মানুষ না হয়ে বরং কবিদের স্বপ্ন-বাস্তবের তাড়নায় পৃথিবীর লোভনীয় যত উপাদানে উপমাময় হয়ে উঠেছে-
আমার কবিতায় প্রধান বিষয় হলো নারী। আমি এক সময় ভাবতাম একজন কবি- পুরুষের কাছে নারীর চেয়ে সুন্দর কি আছে? না, কিছু নেই, পৃথিবীতে যত জাতির কবিতায় যত উপমান আছে আমি আমার সাধ্যমত পরীক্ষা করে দেখেছি সবই নারীর সাথে তুলনা করে। দয়িতার দেহের উপমাদিতে কবিরা পৃথিবী নামক এই গ্রহটাকে চষে ফেলেছেন।
যুগ যুগ ধরে নারীরা পুরুষের দৃষ্টিতে প্রকৃতির বিচিত্র সব অনুষঙ্গ তুল্য। আল মাহমুদের পুরুষ মনও সেই পরম্পরায় প্রভাবিত। রবীন্দ্রনাথের মত তাঁর কবিতায়েও নারী সবচেয়ে বেশি তুলনীয় নদীর সঙ্গে তারপর মৃত্তিকা, পরে বৃক্ষ। নারীর অস্তিত্ব মানবাত্ময় নয় বরং এই সব প্রাকৃতিক উপাদানগুলোর অভিনব সব উপায়ে বিলীন- নদীর ভিতরে যেন উষ্ণ এক নদী স্নান করে/তিতাসের স্বচ্ছজলে প্রক্ষালনে নেমেছে তিতাসই।
নারী বার বার ভোগ্যবস্ত হয়ে পুরুষের চেতনায় রূপ থেকে রূপান্তরে বিবর্তিত হয়ে পুরুষের ক্ষুধা তৃষ্ণার উপাদান হয়। নারী গোপন অভিলাষ নিয়ন্ত্রিত পুরুষ কবির চেতনায়। নারী সেখানে ক্রীড়ানক মাত্র। পুরুষ নির্দেশিত উপাদানে তৈরি হয় নারীর স্বপ্ন সাধের গোপন জগৎ “জড়ির শাড়ীটা পরো, রঙ মাখো, আচড়াও চুল/আয়নায় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখো বুকের গঠন/বুকে যদি হাত রাখো শুনতে পাবে ভেঙ্গে দুই কুল/তোমার আয়ুর নদী পার হয় সোনার তোরণ।”
নারী মাটি স্বরূপা। পুরুষের নিয়ন্ত্রিত পৃথিবীর কাদা মাটি জলে তার দেহাত্মার সৃষ্টি। তার কোনো নিজস্ব অস্তিত্ব নাই। পুরুষের পাজরের হাড় দিয়ে নারীর দেহের হাড় গোড় তৈরি, আর মাংসপিন্ড পুরুষের কামজ চেতনার বীর্যপাত, প্রাণ পুরুষের শাসিত শোষিত শ^াসের প্রবাহ থেকে উৎপন্ন। এই নারী তাই পুরুষ কবির কবিতায় বিশ্লেষিত হচ্ছে যৌন ভাবনার জারিত অনুরাগে- “এ মৃত্তিকা প্রিয়তমা কিষানী আমার/বিলের জমির মতো জলসিক্ত সুখদ লজ্জায়/যে নারী উদাম করে তার সর্ব উদর আধার।”
নারী ‘সর্বংসহা’ নারী সম্প্রদানের প্রতিমূর্তি। পুরুষ প্রণীত সংসার সমাজের বিচিত্র শোষণের বিপ্রকর্ষ রূপ। এবং নারীর যৌন আবেদন এবং এই অবয়বটিই পুরুষের সবচেয়ে পছন্দনীয়। একদিকে নারী যেমন রম্ভা, মেনকা উর্বশী অন্যদিকে, স্বদেশ, মৃত্তিকা, নদী, পৃথিবীর চিরন্তনী রূপের আকর। নারীর গতিশীলতাকে রূদ্ধ করতে অভিনব সব উপাধি “হে গর্ভধারিনী মাটি, ফেটে যাওয়া মায়ের উদর।”
নিত্য গৃহকর্মে নিপুনা সনাতন বাঙালি নারী আজন্ম পুরুষের প্রিয় নারী। কারণ পুরুষতান্ত্রিকতার প্রথম পাঠ ছলে-বলে-কৌশলে, শাসনে-শোষণে নারীকে ঘরে বন্দি করে রাখা। তার পর স্তুতি বাক্যে তাকে মোহিত করা এবং সর্বশেষে এই সেবিকা জীবন তার জন্য ধ্রুব এই বিশ্বাস নারীর মন-মস্তিস্ককে প্রোথিত করে দেয়া। নারীর এই গার্হস্থ্য রূপ অতীত থেকে একুশ শতক পর্যন্ত একই প্রবণতায় সীমাবদ্ধ। নারীর গৃহপরিচিকার রূপে অভিভুত, তৃপ্ত পুরুষ কবি, “তোমাকে যতই দেখি গ্যাসের শিখার পাশে/নীল শাড়ির আঁচল ফেলে রাঁধো বসে প্রত্যেহ প্রোটিন/ডালে দাও রসকষ বেগুন ভর্তায় বাটা তিল/আহারে আরামে কাটে অমলিন আরও একদিন।”
নারী তার সৌন্দর্যের প্রলোভনে পুরুষের কাছে সবচেয়ে নন্দিত আবার পুরুষের অপ্রাপ্তি, অতৃপ্তির কারণে সবচেয়ে বেশি বিকৃত, নিন্দিত। এই অতৃপ্তি বোধে সবচেয়ে বেশি তাড়িত নজরুল ইসলাম, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, মোহিত লাল মজুমদার পরবর্তীতে অনান্য কবিগণ। আসলে এটি পুরুষতান্ত্রিকতার একটি সনাতন চরিত্র। সৃষ্টি ও ধ্বংস দুই-ই-তাদের হাতে, “বলেছি তো নারীর স্মৃতি শেষ। নারী বড় অনাহারি, সাত তাড়াতাড়ি/চোখের আগুনে ভস্ম করে ঘর-বাড়ি। লাকড়ির মত পোড়ায়/পুরুষ সত্তা, পৃথিবীকে করে দৃষ্টিহীন।”
কবির ‘পৌরুষচেতনা’ নারীর নমনীর কমনীয় রূপেই অভ্যস্ত। নারীর মাথা উচু করে খোলা চোখে পৃথিবী দেখার কোন ছাড় দেয় না এই সমাজ। পুরুষ-কবির শীতল শাসন, আনন্দে উদ্যত নয়, হে যুবতী, নত করো মাথা
তোমার কল্যাণ হোক, নত হও আনন্দস্বরূপা।
একুশ শতকের নগর জীবনে অভ্যস্ত কয়েকজন নারীর কথা তিনি আমাদের জানিয়েছেন যারা কবির পরিচিত, বন্ধুসম। এদের কে তিনি সম্পর্কের কোনো ফ্রেমে বন্দি না করে একজন স্বতন্ত্র ব্যক্তি হিসেবেই দেখেছেন। জীবনানন্দ দাশ, বুদ্বদেব বসুর কবিতার নারীদের মতো এদেরকেও সমাজ তাদের স্বনামে চেনে। জাহানারা, লাইলী, নাহার কবির সেই বন্ধুরূপা নারী।
আধুনিক সমাজের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে ঘর থেকে বাইরের পৃথিবীতে পুরুষের সাথে সমান তালে জীবনযুদ্ধরত ক্রমাগ্রসরমান নারীদের কথা জানা যায়। এখানে কবির পুরুষতান্ত্রিকতাকে অতিক্রম করে মানবসত্তাকে স্পর্শ করার প্রয়াস দেখি “সংসার আর চাকুরিটা তার/ঘামার্ত জীবনের দুটি দাঁড়/এই দাঁড়ের ঘায়ে হতভাগিনী মেয়েটি/তার জীবনতরী বেয়ে যায়।”
ধর্মের পুরুষতান্ত্রিক বাণ শেষ পর্যন্ত কবি আল মাহমুদকেও বশীভূত করে ফেলে। তিনি একুশ শতক থেকে ফিরে যান পেছনে। নারীকে নিয়ে কাব্যচর্চায় ইস্তিফা দিতে চান তবে নারীকে মুক্তি দিতে নয় বরং নেকাবের আচ্ছাদনে আবদ্ধ করতে। কী চমৎকার পেলব প্রলোভনে তিনি নারীকে আবার ধর্মের কারাগারে বন্দি করতে চান “হে সুন্দরী বাংলাদেশের ধানী জমিগুলোর কিষানদের থেকেও/কবিতা তোমাকে বেশি চাষাবাদ করছে। এবার/তোমাকে শাড়ি পরিয়ে দিতে চাই আমরা/তুমি কি অন্তত একটি শতাব্দিও বিশ্রাম নিতে পারো না? পারো না কি বোরখার ফুটো দিয়ে/বাণিজ্য বাতাসের আনাগোনা দেখতে?”
এই সমাজ মোটাদাগে নারীর দুটি রূপ সৃজনে ও পূজনে অভ্যস্ত। এক. নারীর উর্বশী রূপ দুই. জননী রূপ। নারীর অঙ্গ-অনঙ্গকে বিচিত্র রূপে কর্ষণ করে শামসুর রাহমানের মতন আল মাহমুদও শেষে নারীর মাতৃরূপকে আরাধনা করেন। পুরুষ দেহের ভোগ যেমন রম্ভারূপী নারী মেটায় তেমনি লৌকিক অনিবার্য ক্ষুধা তৃষ্ণা মেটায় ‘মা’।
মা কবির শাশ্বত অন্নপূর্ণা, শাকম্ভরিÑঅন্নপূর্ণা মা আমার, শাকন্তরি মা আমার/শত উদ্ভিদেও, ঔষধির এবং কবিরাজি প্রত্রপল্লবের/রাঁধুনী তুই, এই শতাব্দীতে/আমার ক্ষিধে মেটাবার খাদ্য কে রাধবে/তুই ছাড়া জননী আমার।
এখানেও নারীর জননী সত্তার কাছে পুরুষ আনত তার সেবার জন্য। সত্যিকার অর্থে নারী নিঃশর্ত কোন ভাবনা থেকে পুরুষের কাছে সমাদৃত হয়নি। শেষ বয়সে নারীর কাছে পরাভূত কবি আল মাহমুদের পুরুষসত্তা। এই পুরুষ এখন নারীর কাছে কামনা করে সেবা। তার প্রত্যাশিত এই পরিচর্যা একান্ত মানবিক সকল ভোগ-উপভোগের উর্ধ্বে, “এখন আমার নারীর কাছে একমাত্র/কাম্য দয়া আর শুশ্রূষা।”
শেষ পর্যন্ত পুরুষ নতজানু নারীর মানবী সত্তার কাছে।
বাংলাদেশের অন্যতম দুই কবির কবিতায় নারীচেতনার বিবর্তন সন্ধানে সর্বাগ্রে দাঁড়াতে হয় পুরুষতন্ত্রের মুখোমুখি। কবিরা সৃষ্টিশীলতায় অনন্য হলেও, নারীর মূল্যায়নের প্রশ্নে নিরপেক্ষ, নির্মোহ থাকতে পারেন নি, তাঁদের রক্তে বাহিত পুরুষতন্ত্র তাঁদের সৃষ্টির চারণভূমিতেও পক্ষপাতিত্বের হালচাষ করেছে। ফলে প্রাচীনকাল থেকে বাংলাদেশ পর্যন্ত নারীর বিবর্তিত রূপ অনুসন্ধান করতে গিয়ে দাঁড়াতে হয় কঠিন নির্মম সত্যের মুখোমুখি। স্বাধীনতা, আধুনিকতা, শিক্ষা সর্বোপরি মনন ও মেধাও পারেনি এই দুই পুরুষ-কবির পুরুষারোপিত ভ্রান্ত বাস্তবতা থেকে নারীকে মুক্তি দিতে।
নারী পুরুষপ্রদত্ত দেহগত বিচিত্র উপাধির কেন্দ্রবিন্দু হয়েই তাঁদের কবিতায় এসেছে। নারীর রূপ, যৌবন, প্রেমানুভ‚তি, কামানুভ‚তি, ঈর্ষা, কল্যাণী, পুরনারী, মহতী বিচিত্র বৈশিষ্ট্যের আকরে কেন্দ্রীভ‚ত হয়ে প্রকাশিত হয়েছে। প্রকৃতঅর্থে তার মৌলিক স্বাতন্ত্র্য, গুণাবলীর কোনো উল্লেখ নাই। নারীর ক্ষেত্রে পুরুষ-মানুষ ভোগবাদী আর পুরুষ কবিরা সৌন্দর্যবাদী। সৌন্দর্য ও ভোগ এই দুইয়ের মধ্যে লুপ্ত হয়ে গেছে নারীর প্রকৃত রূপ। শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ নারীকে ব্যবচ্ছেদ করেছেন প্রেম ও যৌনতার শরীর থেকে। আবার নারীর মাতৃত্বচেতনার প্রশ্নে এই দুই পুরুষ-কবির চিন্তা ও অনুভুতি একসূত্রে গাঁথা। এরা নারীর মাতৃরূপের কাছে নতজানু হয়েছেন। তবে সেখানেও মুক্তি পায়নি নারীর ‘নারীসত্তা’। পুরুষের জন্মদাত্রী রূপে কেবল পেয়েছে ভিন্ন মর্যাদা। সুতরাং বলা যায়, সহস্র বছরের সভ্যতার ইতিহাস অতিক্রম করে এলেও এই পুরুষ সমাজ এমনকি তাদের সৃষ্টিজগতেও নারীর বিবর্তিত বিচিত্র রূপচিত্র অঙ্কন করলেও তার চূড়ান্ত মুক্তিরূপ নারীর ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যকে মুক্তি দেননি। নারী তার বিবর্তিত রূপ নিয়ে পুনরায় ফিরে গেছে অতীতের স্বস্থানে।