মঙ্গলবার, ১৩ জুলাই ২০২১, ১২:০৮ পূর্বাহ্ন
তিনটি ফল
একজন মৃৎশিল্পীর স্টুডিয়ো রুমে উদ্দেশ্য-প্রণোদিতভাবেই সন্ধ্যা নামছে। মোম ধিরে গলে-গলে টেবিলে ছড়িয়ে পড়ার মতো এই সন্ধ্যার আলো; অথচ মোম নয়, তারচেয়ে বহুগুণ প্রাচীন ও শাশ্বত । রুমটির দেয়ালগুলোর গায়ে বিদ্যুৎ সংযোগে কোনও আলো তখনও জ্বলে ওঠেনি। বিছানার পাশেই পশ্চিমে মাঝারি আকৃতির কাঠের ফ্রেম বসানো একটি তরল স্বভাবের জানালা। জানালাটা তাই কতোটা মাঝারি তার উত্তর পাওয়া দুষ্কর।
জানালাটির পাশেই একটি ছোট খয়েরি রঙের টেবিল, কতোটা খয়েরি সেটা নিজেদেরই আন্দাজ করে নিতে হয়। তার ওপরে রাখা আছে একটি সিরামিকের তৈরি পাত্র; ঠিক টেবিলটার মাঝখানে নয়, খানিকটা পশ্চিমকোণ ঘেঁষা। সেই সিরামিকের পাত্রটিতে কিছুক্ষণ আগেই এনে রাখা দু’টি অত্যন্ত উজ্জ্বল রঙের সত্যিকারের কমলালেবু এবং শিল্পীর নিজেরই হাতে গড়া একটি মাটির আপেল, প্রকৃতির গভীর প্রশান্তি হতে বিচ্যুত, ক্লান্ত, ঘুমন্ত রাজকুমারীর মতো স্থির হয়ে আছে। সত্যিকার কমলালেবু দুটো ও মাটির আপেলটিতে পশ্চিমের অস্ত যাওয়া ঘন গোলাপি লাল সূর্যের আলো জড়িয়ে যাচ্ছে। ধীরে, ঠান্ডা মাথায় একটু একটু করে সেই আলো যেন সুচতুর ভঙ্গিতে জড়াচ্ছে…
এখন যদি আমরা এই বর্ণিত সময় প্রবাহের নির্দিষ্ট চিত্রটিকে গভীরভাবে মস্তিষ্কে এঁকে উঠতে পারি তাহলে দেখতে পাব, এই দৃশ্যে সত্যিকার কমলালেবু দু’টির অপূর্ব সৌন্দর্য মাটির আপেলটিকে যেন কিছুটা বিচলিত এবং প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলছে। কী সেই প্রশ্ন যা আপেলটিকে বিচলিত করছে–সে সম্পর্কে আমরা কিংবা সেই মৃৎশিল্পী কেউই আপাতত স্পষ্ট হতে পারব না।
আরও কিছুটা সময় পার হয়ে গেল। সেই অস্তমিত সূর্যের আলো আরও কোমল থেকে কোমলতরভাবে জড়িয়ে নিচ্ছে পাত্রে রাখা তিনটি ফলকে। এইভাবে বস্তুত তিনটি ফল ও তাদের চারপাশ আরও গোলাপি লালচে হয়ে নিশ্চিতভাবেই অন্ধকারে মিলিয়ে যাওয়ার উপক্রম করছে।
এতক্ষণে শিল্পীও পাশের অন্য একটি রুম থেকে এই রুমে ঢুকে গেছে। সে সবিস্ময়ে এই উদ্দেশ্য- প্রণোদিত দৃশ্যের মুখোমুখি নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। সামান্য ত্রুটিপূর্ণ জলের কল থেকে এক এক করে জলের ফোঁটা পতনের মতো সময়ের পতন হতে থাকলো। একটু পরে তার মনের ভেতর হঠাৎ আশ্চর্য একটা পেন্ডুলামের দোলাচল শুরু হয়ে গেল। মাটির আপেলটিকে তার দ্রুতই সেখান থেকে সরিয়ে নিয়ে কোনো অতি-শক্তিশালী ও নিরাপদ ট্রাংকে তালাবদ্ধ করে ফেলতে ইচ্ছে করল। সেইরকম কোনও ট্রাংক খুঁজতেই আবার সে পাশের রুমগুলোতে তল্লাশি শুরু করে দিল; কিন্তু না, দেরি হয়ে গেছে। ততক্ষণে বিদ্যুৎবাতির সুইচবোর্ড চাপবার সময় কাঠি বাজছে। চারিদিকে চিরকালের আদিম ও অজানার অন্ধকার আলোর অনুপস্থিতি ঘোষণা করে দিয়েছে। শিল্পী তার রুমগুলোর অন্ধকারের দেয়াল হাতড়ে পুনরায় স্টুডিয়ো রুমে প্রবেশ করল। সুইচবোর্ডে আলো জ্বালবার সুইচটি টিপতেই একটু আগে দেখতে পাওয়া দৃশ্যটির ঘোর এবার যেন কেটে গেল একেবারেই এবং শিল্পীর শরীর ছেড়ে একরাশ স্নান-ঠান্ডা ঘাম হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে লাগল। ফ্যানের সুইচটিও চাপা হল। তার বুকে এখন একটা স্বস্তি বয়ে চলেছে, কিন্তু সেই স্বস্তি আমাদের জন্য নয় ৷
তাহলে? তারপর কী হবে ওখানে?
আমি সেসবের ভবিষ্যৎ জানিনা; বরং এখানে আমরা একটু পজ্ করে পুনরায় ভালো করে স্টুডিয়ো রুমটা দেখে নিই। দেখে নিই শেষ মুহূর্তের গোলাপি লাল আলো-ঝরা দৃশ্যের ভেতর কিছু একটা খুঁজে পাই কিনা। হ্যাঁ, এইতো স্টুডিয়ো রুমে কিছু একটা অস্পষ্ট দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। চশমাটা চোখে আরেকটু ঠিক করে বসাই। হ্যাঁ, এইবার দেখতে পেলাম। সবটুকু বুঝতে পারা গেল কিনা জানি না, তবে অদৃশ্য আর কোনও কিছু অন্তত রইলো না। দেখলাম, টেবিলটির পূর্ব দিকে রাত্রির শ্মশানের মতো নীরবতা। উল্টো দিকে সূর্যের আদিমতম সেই আলো তখনো ঝরে-ঝরে গলে যাচ্ছে সিরামিকের পাত্রটির গায়ে।
পাত্রটির ছায়ায়, নিস্তব্ধতায়, আদিম গুহাবাসীদের অজানা জীবন-ইতিহাসের রহস্য, ঘোরলাগা দিনগুলোর সন্ধ্যা-দৃশ্যের মতো এক আধো অন্ধকারের ভেতর লুকানো একটি সুক্ষ্ম নকশা করা ধারালো ফল-কাটার ছুরি, পূর্বদিক থেকে পরবর্তী দিনের জন্য অপেক্ষা করে আছে।