রবিবার, ০৪ জুলাই ২০২১, ১০:০৪ অপরাহ্ন
এলিফ শাফাকের সাথে কথোপকথন
সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন – ভিকাস শাহ
অনুবাদ করেছেন – আলী রেজা পিয়াল
এলিফ শাফাক শুধু একজন পুরষ্কারপ্রাপ্ত ব্রিটিশ-তুর্কি ঔপন্যাসিকই নন, তিনি তুরস্কের সবচেয়ে বহুল পঠিত লেখিকা। তার লেখা ১৭টি বইয়ের ১১টিই উপন্যাস এবং তার লেখা অনূদিত হয়েছে ৫০টিরও বেশি ভাষায়। রাষ্টবিজ্ঞানে পিএইচডি করা এই লেখিকা একজন সমাজ সংস্কারকও বটে, তাই পৃথিবীর বিভিন্ন সাম্প্রতিক সমস্যায় তার মতামত জানার জন্য বিশ্বের অনেকেই মুখিয়ে থাকে।
তাই শিল্প, লেখালেখি এবং পৃথিবীর পরিবর্তনে সাহিত্যের ভূমিকা নিয়ে তার মতামত জানতে আজ এলিফ শাফাকের সাথে আমার এই সাক্ষাৎকার।
ভিকাস: আপনার জীবনে সাহিত্যের প্রবেশ কীভাবে ঘটে?
এলিফ শাফাক: আমার লেখালেখির অভ্যাসটা ছোটবেলা থেকেই। আটবছর বয়সেই আমি ছোটগল্প লেখা শুরু করে দিয়েছিলাম। তবে ঔপন্যাসিক হওয়ার স্বপ্নে বিভোর ছিলাম এমনটা বলা যাবে না। এমন কিছু যে হওয়া যায় এটাই জানতাম না। আশেপাশে অনুসরণ করার মত তেমন কেউ ছিল না। অনেকটা অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে নিজের মনকে অনুসরণ করে করে এতদূর আসা। সেদিক থেকে দেখলে সাহিত্য আগে যেমন আমার আত্মার খোরাক ছিল, এখনো তাই।
তুরস্কের রাজধানী আংকারাতে এক রক্ষনশীল পরিবারে কোনরকম উত্তেজনাবিহীন এক ছেলেবেলা কেটেছে আমার। আমার ভাইবোন ছিল না, তেমন আত্মীয়স্বজন ছিল না। বাইরে খেলতে যাওয়ার একটা সুযোগ ছিল কিন্তু এলাকাতে সেক্সুয়াল এবিউজের একটা ঘটনার পরে সেটাও বন্ধ হয়ে যায়। সেই বিরক্তিকর বিকেলগুলোর কথা এখনো আমার বেশ ভালমতই মনে আছে। আমার এমন কিছুর দরকার ছিল যা আমাকে অন্য কোথাও কোনো এক কল্পনার রাজ্যে নিয়ে যাবে। বই আর গল্প ছিল আমার সেই কল্পনার রাজ্যের দরজা।
এজন্য আমি আসলে একাকিত্ব দূর করতে লেখালেখি শুরু করেছি বললে খুব একটা ভুল হবে না। আমার তো ভাইবোন ছিল না। আমার মা বাইরে কাজ করতেন। ওইসময়ের তুরস্কের জন্য যেটা ভালই অস্বাভাবিক। প্রায় দশবছর বয়স পর্যন্ত আমি বড় হয়েছি আমার নানীর কাছে। এবং তার মত বর্ণাঢ্য, চমকপ্রদ এবং সহানূভূতিশীল মানুষ আমি কমই দেখেছি। ঘরভর্তি অদ্ভুত কুসংস্কারপূর্ন জিনিষ, গাছের শেকড়, বাকল এসবে ভর্তি ছিল কারণ নানীমা এসব দিয়ে মানুষের চিকিৎসা করতেন। মাঝে মাঝে হাতও দেখতেন। তার সবকিছুই আমি খুব মুগ্ধ হয়ে উপভোগ করতাম। শব্দের মধ্যে যে একধরণের যাদু থাকে তা সম্ভবত আমি তার কাছ থেকেই শিখেছি।
নিজের সাহিত্যিক জীবনের একেবারে শুরু থেকে দেখলে দুটো কথা বলতে পারি। আমি প্রচুর পড়েছি। পৃথিবীর পূর্ব পশ্চিম দুইদিককার সাহিত্যেই বেশ ভালমত পড়া হয়েছে আমার। আর আমার সবসময় নিজের মাতৃভূমিতেই নিজেকে অপরিচিত মনে হয়েছে। মনে হয়েছে যেন আমি এখানকার কেউ নই।
কারণটা এমন হতে পারে যে আমার জন্ম আসলে এখানে না। আমার জন্ম ফ্রান্সের স্ট্রাসবুর্গে। বাবা মায়ের বিচ্ছেদের পর আমার বাবা ওখানে থেকে যান এবং দিত্বীয় বিয়ে করেন। মা আমাকে নিয়ে তুরস্কে চলে আসেন। আমি তাই বড় হয়েছি দুই মহিলার মাঝে, আমার জীবনে পিতৃস্থানীয় কেউ ছিলেন না।
আমার মায়ের কাছে অবশ্য এত সন্দেহের অবকাশ ছিল না। তুরস্ক তার মাতৃভূমি। তাই আংকারাতে আমার নানীর ঘরে আমাদের নতুন জীবন শুরু হয়। সেই রক্ষনশীল, পিতৃতান্ত্রিক পরিবেশে আমি নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারি নি। তাই আমি অনেকটা বাইরে থেকেই চেষ্টা করছিলাম কোনভাবে যাতে এই সমাজটাকে বোঝা যায়।
এরপরে আমার বয়স যখন দশ তখন আমার মা কূটনৈতিক হিসেবে তার জীবন শুরু করেন। কাজের তাগিদে তার প্রচুর ভ্রমণ করতে হত। সেকারণে আমাকেও সেই ভ্রমণের সংগী হতে হয়েছে। আমি স্পেইন, জর্ডান, জার্মানি এসবের ইন্টারন্যাশনাল স্কুলগুলোতে পড়ার সুযোগ পাই এবং ওদের ভাষা সংস্কৃতির সাথে পরিচিত হই।
আমার বয়স বিশ হওয়ার পরপর আমি ইস্তানবুল চলে যাই। কারণ আমার কেন জানি মনে হচ্ছিল এই শহরটা আমাকে ডাকছে আর আমার এখানেই লেখালেখি করা উচিত আর বই প্রকাশ করা উচিত। কিন্তু ইস্তানবুল দেখা গেল প্রেমিক হিসেবে তেমন সুবিধার না। তাই অনেকবছর সেখানে থেকে লেখালেখি করলেও আমি পরে বস্টন চলে যাই আর ওখান থেকে এরিযোনা। কিন্তু ইস্তানবুলকে আমি ঠিক ভুলতে পারছিলাম না তাই আবার ইস্তানবুলে ফেরত যাই। পরে যখন বুঝতে পারি যে না এই শহর আমাকে ভালবাসবে না তখন শেষমেষ লন্ডন চলে যাই থিতু হতে। এই ভবঘুরের জীবন মানুষকে ব্যখ্যা করা একটু কঠিন কিন্তু আসলে এটাই আমি। এমন উদ্বাস্তু, ভবঘুরের জীবনই কেটেছে আমার। শারীরিক, আত্মিক, বুদ্বিবৃত্তিক সব দিক থেকেই আমি একজন ভবঘুরে. জেমস বল্ডউইনের ভাষায় বললে, আমি একজন পথিক। তাই এটা বললে বেশি বলা হবে না যে এই উদ্বাস্তু জীবনে সাহিত্যই আমাকে আমার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করেছে। আমি যে খড়কুটোর মত উড়ে যাই নি তার পেছনে অবদান এই বইগুলোরই। আমার কাছে পৃথিবীর সাথে যোগাযোগের সর্বশেষ মাধ্যম হলো সাহিত্য। তাই যদি বলি- বই আমাদের বন্ধু হয়ে, শিক্ষক হয়ে, যাত্রাসঙ্গী হয়ে এই পৃথিবী থেকে আমাদের রক্ষা করে তাহলে বেশি বলা হবে না। কারণ আমার সাথে তাই হয়েছে।
ভিকাস: সাহিত্য আমাদের মনকে কীভাবে আরো প্রশস্ত করে?
এলিফ শাফাক: একটা উদাহরণ দিতে ইচ্ছা করছে। তখন আমি মাত্র স্পেন থেকে ফিরে তুরস্কের এক হাই স্কুলে ভর্তি হয়েছি। তখন আমি যুগোস্লোভিয়ার লেখক আইভো আন্দ্রিচের লেখা দ্য ব্রিজ ওভার দ্য দ্রিনা পড়ি।
এর আগ পর্যন্ত তুরস্কের স্কুলে ইতিহাস বইয়ে আমি তুরস্কের জাতীয়তাবাদী চেতনার ব্যাপারে যাই পড়েছি তাই গিলেছি। যেমন আমি পড়েছিলাম অটোমান সাম্রাজ্য ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে সেরা সভ্যতাগুলোর একটি। তাই যেসব দেশে আমরা আক্রমণ করেছি তাদের সবার আমাদের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা উচিত কারণ আমরা তাদেরকে উন্নত জীবনযাপনের স্বাদ দিয়েছি। কিন্তু আন্দ্রিচের উপন্যাসটি পড়ে এই তোতাপাখির ইতিহাসে আর আমার চেতনাতে কিছুটা ফাটল ধরে। উপন্যাসের এক জায়গায় বলকানের দুই কৃষক জেনিসারিদের নিয়ে কথা বলছে। অটোমান আর্মিকে তখন জেনিসারি ডাকা হত। এক কৃষক বলছে, অটোমান আর্মির মহানুভতার কারণে এখন বলকান গরীব ছেলেরা শিক্ষিত হওয়ার সুযোগ পাবে। সমাজে নিজেদের সম্মান প্রতিপত্তি তো বাড়বেই আবার কেউ কেউ হয়ত উজির হওয়ার সুযোগও পেয়ে যাবে।
আরেক কৃষক তখন বলছি, এই ছেলেগুলোকে নিজেদের বাবা মায়ের কাছ থেকে জোর করে ছিনিয়ে নিয়ে গিয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করানো হচ্ছে। এদের সাথে তাদের পরিবারের আর কখনো দেখা হবে না। এটাই অটোমান আর্মির মহানুভবতা?
এতটুকু পড়ে আমার মাথায় হঠাৎ করে একটা জানালা খুলে যায়। আমি বুঝতে পারি লেখক কী বোঝাতে চাইছেন। ইতিহাসে পরম সত্য বলে কিছু নেই। প্রতিটি পক্ষেরই নিজস্ব বক্তব্য থাকে এবং সেগুলো গবেষণার মাধ্যমে সামনে নিয়ে আসতে হয়।
এই “ইতিহাস” সবসময় কে লিখছে তার ভিত্তিতে পরিবর্তিত হয়। তুরস্কের স্কুলে পড়ার সময় যে জেনিসারি সিস্টেম নিয়ে আমি গর্বিত ছিলাম সেই জেনিসারি সিস্টেম শতাব্দীর পর শতাব্দী অনেক অত্যাচার করেছে মানুষের ওপরে। কিন্তু এর কিছু ভাল দিকও ছিল। তাই সত্যটা ওরকম সাদাকালো নয়। তাই রাজনীতির চোখ দিয়ে দেখলে সেই জটিল সত্য পুরোপুরি ধরা পড়ে না। এসব বুঝতে সাহায্য করে গল্প, সাহিত্য।
এজন্যই সাহিত্য এত গুরুত্বপূর্ণ। ভাল সাহিত্য ক্রমাগত আমাদের আদর্শ এবং বিশ্বাসের দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়। আমরা শরীরের যত্নের জন্য যেমন ব্যায়াম করি, সাহিত্য তেমনি বুদ্বিবৃত্তিক ব্যায়াম। সাহিত্য আমাদের জ্ঞানের পরিধি বাড়ায়। আত্মিক এবং বুদ্বিবৃত্তিকভাবে আমাদেরকে বড় করে তোলে। যেসব জায়গা থেকে তর্কের খাতিরে মানবিকতা বাদ দেওয়া হয়েছে সাহিত্য সেখানে মানবিকতার প্রবেশ ঘটায়। “আমরা বনাম তারা” যে ন্যারেটিভ সেটা বুঝতে সাহিত্য আমাদের সাহায্য করে। এই তারা যে আসলে আমারই ভাইবোন এই সত্য উপলব্ধি করতে সাহায্য করে।
ভিকাস: সাহিত্য দিয়ে কি লিংগ, যৌনতা, বর্ণ এসব নিয়ে সমাজের যে রক্ষনশীল মনোভাব আছে তার বিরোধীতা করা সম্ভব?
এলিফ শাফাক: লেখক বা লেখিকা যখন লেখেন তখন একা লেখেন। পাঠকও পড়ার সময় একাই পড়েন। নিজের ভেতরে কয়েক ঘন্টার জন্য ঢুকে গিয়ে বই পড়ার ওই সময়টাতে আমরা আর সামাজিক প্রাণী থাকি না। আমাদের আলাদা অস্তিত্ব তখন খুব ভালমতই টের পাওয়া যায়। আমরা তখন শুধু একজন মানুষের যে আরেকজন মানুষের লেখা পড়ছে। এই বন্ধনটা খুব চমৎকার।
তুরস্কের মত সমাজগুলো অনেক গোত্রে বিভক্ত। গোত্র মনোভাব একটা মানুষের স্বতন্ত্র সত্তাকে আহত করে। একারণেই অথরিটেরিয়ান আদর্শগুলো জনতার একত্রিত শক্তির ওপর নির্ভর করে টিকে থাকে।
গল্প উপন্যাস ওই জনতার জোয়ার থেকে আমাদের বের করে এনে আমাদের স্বতন্ত্র সত্তাকে আবার জাগিয়ে তুলতে চায়। আর এভাবেই আমরা আশেপাশের মানুষের সাথে মানবিক পর্যায়ে গিয়ে যোগাযোগ শুরু করতে পারি।
ভিকাস: একটা শক্তিশালী জাতি গঠনে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের ভূমিকা কতটুকু?
এলিফ শাফাক: স্বার্থান্বেষী নেতারা যতই আমাদেরকে বলুক যে মানুষ একরকম হলেই সুরক্ষা এবং উন্নতি বাড়বে আমরা তো জানি যে এসব ভ্রম এবং মিথ্যা। আমরা পৃথিবীজুড়ে এত বেশি যোগাযোগ স্থাপন করে ফেলেছি যে এখন আর মানুষে মানুষের মধ্যে ভেদাভেদের দেয়াল তুলে কোনো লাভ হবে না। তাই আমাদের সকলের উচিত আন্তর্জাতিকিকরণে মনোযোগ দেওয়া এবং একটা আন্তর্জাতিক সমাজের অংশ হিসেবে জঙ্গিবাদ, খাদ্যসংকট, রিফিউজি সমস্যা এসব সমাধানে এগিয়ে আসা। এই বড় বড় সমস্যাগুলো শুধু আমরা এক হলেই সমাধান করা সম্ভব। যদিও এখন তো বইছে সেই গোত্রীকরণ, বিচ্ছিন্নতাবাদী সংকীর্ণ মনোভাবের দিকে।
তুরস্ক তার বৈচিত্র্য হারিয়ে শুধু যে রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিকভাবে দূর্বল হয়েছে তা নয় তুরস্কের বিবেককেও এটা ভালভাবেই আঘাত করেছে। একটা সমাজ যখন নিজের বৈচিত্র্যকে উপভোগ করতে অস্বীকার করে তখন যে ক্ষতিটা হয় সেই ক্ষতি অপূরনীয়।
আমরা এমন এক সময়ে বসবাস করছি, আমাদের ভেতরে একটা দ্বৈতবাদের একটা চেতনা গেঁথে দেওয়া হয়েছে। আমরা সবকিছুকে দেখি সাদাকালো হিসেবে। হয় এটা নয়ত ওটা। আমরা তৃতীয়, পঞ্চম বা দশম কিছু খুঁজতে যাই না। ওরা আমাদেরকে বলে বর্ডারের ওপাশে অনেক স্বাধীনতা কিন্তু ওখানে চলছে অরাজকতা। আর তুমি যদি এখানে আসো তাহলে দেখবে এখানে চারিদিকে উঁচু উঁচু দেয়াল। স্বাধীনতা নেই কিন্তু তুমি সুরক্ষিত থাকবে। ওদের মতে এই দুটোর একটা আমাকে বেছে নিতেই হবে। কিন্তু আমি চাইনা এই দুটোর মধ্যে একটাও বেছে নিতে। এগুলো তো উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া সিদ্বান্ত। আমি চাই সবাই বৈচিত্র্যের পক্ষে থাকবে, সংস্কৃতির পক্ষে থাকবে, ইমিগ্রেশনের পক্ষে থাকবে। ইতিহাসে যে সময়েই মানুষ এমন চাপিয়ে দেওয়া সিদ্বান্ত নিয়েছে ততবারই সভ্যতা একটা অন্ধকার যুগে প্রবেশ করেছে। আদোর্নো এটা নিয়ে অনেক লেখালেখিও করেছেন। স্বৈরাচার নিজ স্বার্থেই সবসময় চায় বৈচিত্র্য মুছে ফেলতে।
আমরা মানুষ হিসেবে শিখি এমন মানুষ থেকে যে আমাদের থেকে অনেক আলাদা। একারণেই শহরগুলো সবসময় জ্ঞান বিজ্ঞানের কেন্দ্র হয়ে ওঠে। রিচার্ড সেনেট তো বলেইছিলেন শহরে প্রবেশ করলে তোমার সাথে এমন মানুষের পরিচয় হবে যে তোমার থেকে আলাদা। শহর হচ্ছে বিবিধ মানুষদের মধ্যে দেখা হওয়ার জায়গা। সমাজ বৈচিত্র্য থেকে লাভবান হতে পারে এবং এরমানে এই না যে আমাদের ভেতরকার আদর্শগুলো হারিয়ে যাবে। আমরা সেগুলোকেও ধরে রাখতে পারি নিজেদের মত করেই।
তাই ডানপন্থীরা যখন বলে “প্রগতিশীলরা সমস্যার গুরুত্ব বোঝে না। তারা বৈচিত্র এনে সমাজের গাথুনি তারা নষ্ট করতে চায়।” সেসব প্রোপাগান্ডা বিশ্বাস করার দরকার নেই।
ভিকাস: যারা সমাজের বৈচিত্র্য দূর করে সমাজকে আলাদা করতে চায় তাদের থেকে আমরা কি শিখতে পারি?
এলিফ শাফাক: আসলে অনেককিছু। কাহলিল জিবরানের একটা কথাকে আমরা সবসময় মাথায় রাখতে পারি। তিনি বলতেন বাচালের কাছ থেকে চুপ থাকার গুরত্ব শেখা যায়, অত্যাচারীর কাছ থেকে শেখা যায় ভাল ব্যবহারের গুরুত্ব। তেমনি যারা আমাদেরকে আলাদা করতে চায় তাদের কাছ থেকে আমরা শিখতে পারি বৈচিত্র্যের শক্তি কত বেশি।
বর্তমানে সবচেয়ে বেশি যুদ্ধ হচ্ছে সংস্কৃতির নামে। আমাদের যুদ্ধগুলো ঠিক এখন আর অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক না। যুদ্ধগুলো সাংস্কৃতিক। এটা দেখলেই আমার মন ভেংগে যায়। কারণ যে ব্যাপারটা মানুষে মানুষে সেতুবন্ধন তৈরী করার কথা সেটা ব্যবহার করেই কিনা মানুষকে মানুষ থেকে আলাদা করে ফেলা হচ্ছে। এটা না বুঝলে বর্তমান সময়ের বিরোধগুলোকে ভালমত বোঝা সম্ভব নয়।
জননেতারা সবসময় সমাজকে দুভাগে ভাগ করে ফেলতে চান। জনতা বনাম এলিট। এলিটদের তারা লিবারাল বলে চালাতে চান। কারণ জননেতাদের কাছে এলিট মানে আসলে সমাজের উচুশ্রেণীর লোকেরা না। এলিট বলতে তারা আদর্শগত ভাবে যারা একটু অন্যরকম তাদেরকে বোঝান। যেমন নাইজেল ফ্যারাজি একারণে একজন রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী হওয়ার পরেও নিজেকে জনমানুষের একজন দাবী করতে পারেন কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া ছাত্র যে নিজের টিউশন ফিই ঠিকমত দিতে পারছে না সে হয়ে যায় লিবারাল এলিট। মেরিন লে প্যান এর দিকে তাকান। ওরা কি এলিট না? গ্যার্ট ওয়াইল্ডার্স,স্টিভ ব্যানন এরা কি এলিট না?
এলিটরা যেকোনো রাজনৈতিক মতাদর্শের হতে পারে। প্যারেটো এটা নিয়ে এক শতাব্দী আগে লিখে গেছেন। এজন্য জননেতাদের যুদ্ধের ডাকে সাড়া দেওয়ার আগে আমাদের বুঝতে হবে যতদিন তারা তাদের আভিজাত্য ধরে রাখতে পারছে ততদিন পর্যন্ত আসলে তাদের আভিজাত্য নিয়ে কোনো সমস্যা নেই।
ভিকাস: জীবনকে বুঝতে দর্শনের ভূমিকা কি?
এলিফ শাফাক: আমরা কোনকিছু কেন শিখি বা কীভাবে শিখি সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি সুফি সাধুরা মনে করতেন শেখার পাশাপাশি ভুলে যাওয়াটাও একটা শিল্প। কারণ না ভুললে নতুন কিছু শেখা যায় না। কথাটা একটু বিভ্রান্তিকর লাগলেও কোন ব্যাপারে একদম নিশ্চিত হওয়ার চেয়ে সে ব্যপারে একটু দ্বিধা বজায় রেখে শেখার জায়গা রাখলে ভাল।
বিভ্রান্তি মাঝে মাঝে ভাল। আমরা এখন আর কাউকে “আমি জানি না” বলি না। আমরা গুগল করে দেখে বিশেষজ্ঞ হয়ে যাই। এটাই আমাদের সময়ের সবচেয়ে বড় অজ্ঞতা।
তথ্য, জ্ঞান আর প্রজ্ঞা এই তিন জিনিষের মধ্যে অনেক বড় পার্থক্য আছে। আমরা বর্তমানে তথ্য এবং গুজবের এক সাগরে বসবাস করি। আমরা মনে করি বেশি তথ্য থাকলে আমরা কোনো জিনিষ বেশি বুঝব আসলে তা নয়। যত বেশি তথ্য তত কম জ্ঞান। আর প্রজ্ঞা তো অন্য ব্যপার। প্রজ্ঞার জন্য প্রচুর মানসিক শক্তি আর জ্ঞানের দরকার হয়। আদর্শগত ভাংগন আমাদের মধ্যে যেভাবে মহামারীর মত ছড়িয়ে পরছে সেটা দেখলে আমি ভয় পাই। আমরা যদি আমাদের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতে না পারি আমরা কখনো সমাধানের দিকে এগোতে পারব না। দর্শন তাই এই ব্যাপারে আমাদের কথোপকথনের অংশ হতে পারে। তবে আমি তাত্ত্বিক দর্শনের কথা বলছি না। এমন দর্শনের কথা বলছি যা আমাদেরকে প্রশ্ন করতে উৎসাহিত করে তুলবে।
ভিকাস: বাকস্বাধীনতার গুরুত্ব কতটুকু আর এটিকে আমাদের কীভাবে ব্যবহার করা উচিত?
এলিফ শাফাক: একবার এক আমেরিকান পন্ডিত আমাকে বলেছিলেন আমি কেন নারীবাদী সেটা বোঝা সহজ কারণ আমি তুরস্কে বড় হয়েছি। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, তাহলে তো তোমার আরো বেশি নারীবাদি হওয়ার কথা কারণ তুমি আমেরিকাতে বড় হয়েছ। ওই মহিলা এটাকে হেসে উড়িয়ে দিয়েছিল। সে ভেবেছিল আমি তার সাথে মজা করছি।
এই ভূতাত্ত্বিক ব্যপারটা আমি কখনোই বুঝি নি। যেন পৃথিবীর কয়েকটা জায়গায় খুব খারাপ হচ্ছে। ওদের মানবাধিকার নিয়ে কথা হোক। কিন্তু পাশ্চাত্য দেশগুলোতে যেন মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়ই না। তাই তাদের এসব নিয়ে মাথাব্যথাই নেই।
২০১৬ এর পর অবশ্য এধারণা অনেকটাই পালটে গেছে। সবাই বুঝতে পারছে এখন উন্নত বা অবনত নয়, পৃথিবীজুড়েই একই সমস্যা। জ্যাগমুন্ট বাউম্যান যেমন বলে গেছেন “আমরা এখন এমন এক সময়ে প্রবেশ করছি যখন মহিলা এবং এলজিবিটিকিউ কমিউনিটি নিয়ে আমাদের সবার কথা বলা উচিত এবং আমাদের গণতন্ত্রে তাদেরকে স্থান দেওয়া উচিত।”
আমি বেশ কয়েকটা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়েছি এবং ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি আটলান্টিকের দুই পাড়েই বাকস্বাধীনতা নিশ্চিত করা খুব কষ্টসাধ্য। অনূভূতিতে আঘাত দেওয়া যাবে না এই ধুঁয়া তুলে তুলে মানুষ যেভাবে বাকস্বাধীনতাকে হরণ করছে এভাবে আমরা কখনোই সামনে এগোতে পারব না।
আমাদের সবসময় বিরোধীপক্ষের লোকদের সাথে কথা বলা উচিত। জ্ঞান বিজ্ঞানের জগতে এই যোগাযোগ তো আরো বেশি হওয়া উচিত। নিজের অনূভূতিকে আমাদের আরো শক্ত করতে হবে যাতে করে এত সহজে তা আঘাতপ্রাপ্ত না হয়। আমার কোন ছাত্রছাত্রী যখন বলে তার অনূভূতি আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে আমি তখন তাকে অনূভূতিতে আঘাত পাওয়ার অনুশীলন করতে বলি। কারণ সবাই তোমার কথাকে বুদ্ধি, মেধা, সত্য দিয়ে চ্যালেঞ্জ করবে। তুমি শুধু অনূভূতিতে আঘাত পেলে তো হবে না। রুমি বলতেন “প্রতিবার ঘষতেই বিরক্ত লাগলে আয়নাটা পরিষ্কার হবে কিভাবে?” আমাদেরও সেভাবে বিরক্তি কাটিয়ে বুদ্বিবৃত্তিক লড়াইয়ের প্রস্তুতি নেওয়া উচিত।
তবে এটাও সত্যি আমরা নতুন নতুন অনেক সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছি। আমরা দেখছি শব্দ দিয়ে, বাক্য দিয়ে কীভাবে মানুষকে ভুল বোঝানো হচ্ছে। কিভাবে শব্দ মানুষ মেরে ফেলছে। রোয়ান্ডার রেডিও, মায়ানমারে ফেইসবুক, নিউজিল্যান্ডে ডানপন্থি জঙ্গীদের ওয়েবসাইট অথবা ইসলামিস্ট জঙ্গীদের ওয়েবসাইট এসব কিছু আমাদের মধ্যে ভয় আর ঘৃণা ছড়াচ্ছে। তাই আমার কাছে শব্দ দিয়ে যদি সহিংসতা ছড়ানো হয় তাহলে এমন বাকস্বাধীনতা বন্ধ হোক।
আসলে যেসব কথা সহিংসতা সৃষ্টি করে তাদেরকে আমাদের অন্যভাবে দেখতে হবে। এব্যাপারে আমাদের এক হতে হবে। দূর থেকে দেখে থাকলে এই সমস্যার সমাধান হবে না।
ভিকাস: আমাদের সমাজের সবচেয়ে বড় সমস্যাগুলো কী বর্তমানে? আর কোন জিনিষগুলো এত সমস্যার পরেও আপনার মধ্যে আশার উদ্রেক করে?
এলিফ শাফাক: আপনার হয়ত মনে আছে ১৯৯০-২০০০ এর দশকে মানুষের মধ্যে একটা অদ্ভুত আশাবাদী চেতনা ছিল। আশাবাদীদের বেশিরভাগই ছিলেন প্রযুক্তিবিদ। এখন এতদিন পরে এসে আমরা হতাশাবাদের যুগে প্রবেশ করেছি। এই যুগটা হচ্ছে ভয়ের, রাগের, দুশ্চিন্তার,আক্ষেপের। তাই আমার মনে হয় আমাদের গ্রামসির সিন্থেসিসটা অনুসরণ করা উচিত। তিনি মস্তিষ্কের হতাশাবাদ আর মনের আশাবাদীতা নিয়ে কথা বলতেন। নির্দিষ্ট পরিমান হতাশা আমাদের দরকার আছে যাতে আমরা সমস্যার গুরুত্ব বুঝতে পারি। গণতন্ত্রও যে মরে যেতে পারে সেটা তো আমরা নিজ চোখেই দেখলাম। পরিবেশ থেকে শুরু করে মানবাধিকার অনেককিছুই আজ হুমকির মুখে। আমাদের তাই আরো সচেতন নাগরিক হতে হবে এবং মনের মধ্যে আশা রাখতে হবে। এই আশা আমাদেরকে কোনো রাজনীতিবিদ দিবে না। আমাদেরই নিজেদের ওপরে বিশ্বাস রাখতে হবে। আমরা এমন একসময়ে প্রবেশ করেছি যেখানে আমাদের সকলেরই মানবাধিকারের জন্য লড়াই করতে হবে।
আমার মনে হয় মানুষের ধার্মিক বিশ্বাস শুধু ধর্মীয় নেতাদের হাতে ছেড়ে দিলে সমস্যা। দেশপ্রেমের মানদণ্ড জাতীয়তাবাদী লোকদের হাতে ছেড়ে দিলে সমস্যা। রাজনীতি স্বার্থান্বেষী রাজনৈতিক নেতাদের হাতে ছেড়ে দিলে সমস্যা। পরিবেশ সংরক্ষন শুধুমাত্র অভিজাতদের হাতে ছেড়ে দিলে সমস্যা। এমনকি প্রযুক্তিও শুধুমাত্র অর্থলোভী কিছু কর্পোরেশনের হাতে ছেড়ে দিলে সমস্যা। এই পৃথিবী বাদে যেহেতু আমাদের আর যাওয়ার জায়গা নেই তাই এই পৃথিবীর নাগরিক হিসেবেই পৃথিবীর সমস্যাগুলোর ব্যাপারে আরো সক্রিয়ভাবে মাথা ঘামাতে হবে।