রবিবার, ২৮ মার্চ ২০২১, ০৮:২৯ অপরাহ্ন
একজন মানুষ যেভাবে পচে যায়
কানের মধ্যে একটা মাছি ঢুকে পড়েছিল প্রায়। রেজাউল দাাঁত ব্রাশ করছিল। তার মনে হয়, মাছিটা জেনে গিয়েছে ঊনত্রিশ বছর বয়সের এই ফালতু মানুষটার কানে লাশের খুব একটা পার্থক্য নেই। লাশদের কোন ক্ষমতা থাকে না। তার মতো ব্যাংকের ক্যাশ অফিসার ধরণের চাকরি করা লোকজনকে কেউ পাত্তা দেয় না।
কমোডে বসে দিনের প্রথম সিগারেট ধরাতে গিয়ে হাত নিশপিশ করে। লাইটার দিয়ে মাছিটাকে আগুনে পুড়িয়ে মারতে পারলে বেশ প্রতিশোধ নেয়া যেতো। কিন্তু মাছি নয়, তার এখন মানুষ খুন করতে ইচ্ছা করে। মানুষ মাছির মতো সাইজে ছোট হলে, লাশ লুকানো সহজ হতো। লাশ লুকানোর ঝামেলার জন্য সে খুন করছে না। আপাতত লোকজনকে ”শুয়োরের বাচ্চা” বলে গালি দিয়ে তৃপ্ত থাকতে হচ্ছে।
এই শহর তাকে পাগল বানিয়ে দিচ্ছে! প্রতিদিন মতিঝিলের অফিসে যাওয়ার জন্য জন্তুর মতো এক গাদা মানুষকে কনুই দিয়ে ধাক্কা মেরে সে বাসে জায়গা প্রতিষ্ঠা করে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা জ্যামে বসে থাকলে, মোশন সিকনেসের জন্য মাথা ব্যথা করে। অনেক কষ্টে বমি আটকে রাখে। রেজাউলের মনে হয়, একদিন সে আর বমি আটকে রাখবে না। বদ ধরণের কোন প্যাসেঞ্জার পাশে বসলে বমিতে বাস ভাসিয়ে দিবে। আজকাল আর কোনকিছুতে অপরাধবোধ হয় না। অফিসে গেলে চোরা চোখে বুবলির বুকের দিকে তাকাতে ভালো লাগে। এমডির রুমে গেলে হাত কচলাতে কচলাতে মনে মনে তাকে “খানকির পোলা” বললে দিনটা সুন্দর হয়ে যায়।
এই শহরটা ছেড়ে একদিন সে পালিয়ে যাবে। ঠিক পালাবে! এই বালের শহর তাকে পচিয়ে দিচ্ছে! এখানে থাকতে থাকতে সে ভুলে গিয়েছে, একদিন শামসুর রাহমানের কবিতার বই পড়তে ভালো লাগতো। টিএসসিতে যে বাচ্চাগুলো চকলেট বিক্রি করে, সেই পিচ্চিদের জন্য রেজাউল আর মনিকা মিলে একটা সন্ধ্যার স্কুল খুলতে চেয়েছিল। তখন মনিকার জন্য তার একটু গদগদ ব্যাপার ছিল। শালী শেষ সেমিস্টারে গিয়ে এক ম্যাজিস্ট্রেটকে বিয়ে করে ফেললো!
যখন এই শহরে রেজাউল প্রথম এসেছিল, সব মেয়েকে তার ‘কালপুরুষ’ বইয়ের মাধবীলতা মনে হত। চুল ছোট ছেলে-ছেলে ধরণের মেয়েগুলোকে দেখে সে গালি দিতো না। বরং তাদেরকে ‘গর্ভধারিণী’ উপন্যাসের জয়িতা মনে হত। কিন্তু ভুলেও বন্ধুদের আড্ডাতে এইসব বেকুবি কথাবার্তা সে উচ্চারণ করতো না। হাকিম চত্বরের সিঙ্গারা খেতে খেতে তারা “ক্লাসের কোন মেয়ের পাছা দেখলেই বোঝা যায়, সে আর ভার্জিন নাই” এইসব রসের কথা বলতো। যস্মিন শহরে যদাচার! এই শহরের মানুষদের সাথে তাল মেলাতে মেলাতে কবে থেকে যে সে পচে যাওয়া শুরু করলো, মনে পড়ে না।
অফিসে বুবলির সাথে লাঞ্চ করতে গিয়ে, দোকানের পরোটার স্বাদ বেড়ে যায়। মতিঝিলের ঝুপড়ি ধরণের দোকান থেকে সকালে পরোটা আর ডিম ভাজি কিনেছিল। লাঞ্চে ঠাণ্ডা পরোটা খেতে আজ তার ভালো লাগে। বুবলির সাথে প্রেম করতে ইচ্ছা হয়। মনে হয়, বাসায় গিয়ে বিসিএসের পড়া পড়তে হবে। বুবলির মতো সুন্দরী মেয়েরা বিসিএস ক্যাডার ছাড়া বিয়ে করবে না। সিলেটের সুবিদবাজারে রেজাউলের বাবার একটা টিনের বাড়ি আছে। বুবলি নিশ্চয়ই টিনের বাড়িওয়ালা শ্বশুরবাড়িতে বিয়ে করে মানইজ্জত খোয়াবে না! একটা সুন্দরী বউয়ের খুব শখ তার! বন্ধুদেরকে দেখাতে ইচ্ছা হয়। সারাজীবন ওরা তাকে “অই কাউলা” ছাড়া কথাই বলতো না। বুবলির মতো সুন্দরী ধরণের কোন মেয়েকে রেজাউলের পাশে দেখলে ওরা জ্বলবে! খুব জ্বলবে!
অফিস শেষে বুবলি আর সে এক বাসে করে মিরপুর দশে যাবে আজকে। বুবলি তার পাশে বসেছে। আজ রেজাউল মোশন সিকনেসের কথা ভুলে যায়। বুবলি কী খেতে পছন্দ করে, ও গল্পের বই পড়ে নাকি- এসব কিছুই তার প্রশ্ন করতে ইচ্ছা হয় না। শুধু মেয়েটাকে দেখতে ইচ্ছা হয়। হাসলে গালে টোল পড়ে মেয়েটার। বুকের সাইজ কতো হবে? ছত্রিশ? অথচ আঠারো বছর বয়সে তার সব মেয়েকে মাধবীলতা মনে হত!
সেদিন বাসায় ফিরে তার শহর ছেড়ে আর পালাতে ইচ্ছা করে না। বুবলি যে শহরে আছে, সেখানকার নোংরা বাতাসেও হাস্নাহেনার ঘ্রাণ পাওয়া যায়। গোসল করার জন্য নোংরা পানি ছেড়ে দেয়। বাথরুমের বড় বালতিটা ভরতে ভরতে রেজাউল ফেসবুকে মানুষের স্ট্যাটাস দেখে। সবাই কি এক স্ট্যাটাস দিচ্ছে, “আট মিনিট! আট মিনিট!” সাথে চোখ টেপার ইমোজি! ফেসবুকে রেজাউলের এক সেলিব্রেটি লেখক বন্ধু আছে। ‘আলতাফ লিখন’ নামে লিখে। দুনিয়ার লুইচ্চা! হারামজাদার আসল নাম ‘আলতাফ গনি’। যাই হোক, সেলিব্রেটি লেখক বন্ধুর, “আট মিনিট! উহ! আহ!” স্ট্যাটাস দেখে রেজাউল বন্ধুকে ইনবক্স করে। ইনবক্সে আলতাফ গনি তাকে একটা ভিডিও দেয়। গোসলের আগে বুবলির কথা মনে করতে করতে আট মিনিটের ভিডিও দেখতে ইচ্ছা হয়। লিংক ওপেন করলে মেয়েটার চেহারা দেখে গালি দেয় রেজাউল।
“খানকি মাগী”!
আট মিনিটের ভিডিওতে নিষ্পাপ চেহারার বুবলি। সাথের ছেলেটার চেহারা দেখা যাচ্ছে না। তাহলে এই মেয়ে ঘোমটার তলে খেমটা নাচে! রাগে তার গা কাঁপে। আজকালকার চাকরি করা মেয়েগুলো সব নষ্টা। আট মিনিট শেষ হলে, ভিডিওর ছেলেটির জায়গায় নিজেকে কল্পনা করতে তার ভালো লাগে। ঠিক তিন মিনিট পরে রেজাউল গোসল করতে যায়। পানিতে ভেজা ভুঁড়ি দেখতে দেখতে সে ঠিক করে, মফস্বলের একটা মেয়েকে বিয়ে করবে। বিসিএস ক্যাডার হলে পাত্রীর অভাব হবে না। বুবলির মতো চাকরি করা মেয়েদের সে বিয়ে করবে না।
গোসল করে এসে, ঘুমানোর আগে ফোন থেকে নিজের ফেইক প্রোফাইলে ঢুকে রেজাউল। জয়া আহসানের ক্লিভেজ দেখে আবারও উত্তেজিত হয়। তারপর জয়ার ছবির নিচে কমেন্ট করে, “খানকি মাগী। তোর জাহান্নামের ভয় নাই!” এই শহরের মেয়েগুলো সব নষ্টা। পহেলা বৈশাখে বড় গলার ব্লাউজ পরে চারুকলাতে ঘুরতে বের হবে বয়ফ্রেন্ডের সাথে। তারপর কেউ গায়ে হাত দিলে কাঁদতে বসবে। অথচ কোন এক অতীতে রেজাউল বাম দল করতে করতে নাস্তিকতার দিকে ঝুঁকে গিয়েছিল প্রায়! এই শহর ছেড়ে তার পালাতে হবে। রেজাউল একদিন পালিয়ে যাবে। ঠিক পালাবে! নষ্ট শহর! নষ্ট মানুষ!
অনেকদিন আগে সে আর সি মজুমদার অডিটোরিয়ামে একটা মুভি দেখেছিল। ‘দ্য প্যাশন অভ ক্রাইস্ট’। সেখানে ব্যভিচারী নারীকে যখন জনতা শাস্তি দিতে চায়, যিশু বলেছিল, “He that is without sin among you, let him first cast a stone at her!”
কিন্তু এখন নারীর দিকে পাথর ছুঁড়তে রেজাউলের দ্বিধা হয় না!