মঙ্গলবার, ৩০ মার্চ ২০২১, ০৮:৪২ অপরাহ্ন
ইচ্ছেকুয়া
এই গল্পটা আমার মায়ের। এটা আমার দাদা সুমনের গল্প। কিংবা আমার গল্প। সুমন আমার চেয়ে বয়সে দশ বছরের বড়। আমাদের কোনো বোন ছিলো না বলেই হয়ত সুমন আমাকেই বোন মনে করতো। এবং ছোটবেলা থেকেই আমাকে মেয়েদের মতো সাজিয়ে রাখতো, মায়ের বাকশো থেকে চুরি করে কপালে টিপ পরিয়ে দিতো, কখনো মা’র বাকশো না পেলে হাঁড়ি-পাতিলের তলা থেকে কালি নিয়ে চোখে কাজল টেনে দিতো…। সে নিজেও সাজতো খুব করে। আর নাটকের দলের মেয়েদের মতো কথা বলতো। আমার খুব বিরক্ত লাগতো। মা বকতো, তারপরও সে তার মতোই থাকতো। আস্তে আস্তে সে কেমন যেন পাল্টে যেতে থাকলো। তার নাইনের বছর একদিন ইশকুলে যাওয়া বন্ধ করে দিলো। ঘর থেকে বের হতো না। প্রাইভেটে পরীক্ষা দিলো। সে আমার দাদা হলেও তাকে আমি সুমন বলেই ডাকতাম।
মা মরে যায় যখন আমি কলেজে পড়ি। মা মরে যাওয়ার পর শ্মশানে আমি একাই গিয়েছি বাবার সঙ্গে। সুমন যায়নি। শশ্মান থেকে ফিরে সুমনকে খুঁজতে গিয়ে দেখি সে তার ঘরে নাই। আঁতিপাতি করে তাকে খুঁজলাম আলমারির পেছনে ফাঁকা জায়গায়, খাটের তলায়। কাপড়ের বেতের ঝুড়িটাতে খুঁজতে গিয়ে তার তলায় একটা ডায়েরি পেয়ে গেলাম। সুমনের ডায়েরি। আমার আবার অন্যের ডায়েরি চুরে করে পড়ার অভ্যাস ছিলো। সুমনের ডায়েরিতে নানা ঘটনা ছিলো, তার ইশকুলের ঘটনা, তার স্বপ্নে কথা কতো কী। পড়তে পড়তে চমকে যাচ্ছিলাম। তারপর যে পৃষ্ঠাগুলি পড়ে এই গল্পটা তৈরি হলো তা এই রকম—
‘একদিন রাত্রিবেলা আমার ঘুম ভেঙে গেল। পাশের ঘরে বাবা-মা প্রচণ্ড ঝগড়া করছিল। আমি দুহাতে চোখ ঘষে উঠে গিয়ে তাদের ঘরের দরজায় দাঁড়ালাম। ঝগড়ার কারণ ধরতে পারলাম না। দেয়াল ঘড়িতে তখন রাত্রি তিনটা বেজে তেরো মিনিট। মা ছুটে এসে আমার হাত ধরলো। বললো, ‘চল সুমন।’
বাবা বললো, ‘কোথায় যাও?’
মা বললো, ‘জানি না।’ বলেই আমার হাত ধরে হিড় হিড় করে টেনে বাড়ির বাইরে চলে এলো।
তখন আমার বয়স দশ। আর মায়ের বয়স পঁচিশ হবে হয়ত। বাড়ির ঘাটার কাছে এসে মা দাঁড়িয়ে গেল। চোখ দিয়ে পানি পড়ছিল তার। ডুবি ডুবি চাঁদের আলোতে গাল চিক চিক করছিল।
আমি বললাম, ‘কই, চলো।’
মা বললো, ‘এত রাতে কই যাবো বুঝে আসতেছে নারে, সুমন।’
আমি বললাম, ‘চলো, নানার বাড়িত যাই।’
আমরা রাত পেরিয়ে, মাঠ পেরিয়ে, ভোর পেরিয়ে, ক্ষেত পেরিয়ে, সকাল পেরিয়ে, নদী পেরিয়ে, হাট পেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে নানা বাড়িতে যখন পৌছলাম তখন সূর্য মাথার উপর। হাঁটতে হাঁটতে মাঠে এসে মা শোনালো মাঠের গল্প। গল্পের ভিতর বাবা। হাঁটতে হাঁটতে সর্ষে ক্ষেতের মাঝখানে এসে মা বললো হলুদ জ্বরের গল্প। ওখানেও বাবা। মা’র একবার জন্ডিস হলো। আর বাবা রাত জেগে তার পাশে বসে থাকতো। টানা আটদিন নাওয়া-খাওয়া ঘুম ভুলে মা’র কেমন সেবা যত্ন করেছিল সেই গল্প।
হাঁটতে হাঁটতে নদী। মা নদীতে নেমে চান করলো। আমি নদীকূলে বসে তার চান করা দেখলাম। দেখলাম নদীজলে ডুব দিতে দিতে মা আরো আরো সুন্দর হচ্ছিলো।
হাঁটতে হাঁটতে হাট। হাট বার নয়। তাই দোকানপাট বন্ধ। একটা ঝাপি ফেলা দোকান দেখিয়ে মা বললো, ‘এইটা চুড়ির দোকান। তোর বাবা যখন আমাকে দেখতে যেত তখন এই দোকান থেকে আমার জন্যে চুড়ি কিনে নিয়ে যেত।’
‘দেখতে কোথায় যেত, মা?’
‘আমার তো বিয়ে হয়েছিলো এগারো বছর বয়সে। বিয়ের পরই তো আর শ্বশুরবাড়ি যাইনি, যখন আমার পনেরো বছর তখন শ্বশুর বাড়ি গেছি। এর মাঝে চার বছর, প্রতিমাসে তোর বাবা আমাকে দেখতে যেত, তখন এটা সেটা নিয়ে যেত…
হাট পেরিয়ে আমি আর মা যখন নানা বাড়ি পৌঁছলাম দেখলাম মাসতুতো ভাইবোনরা উঠানে মারবেল খেলছে। নানি এসে মাকে জড়িয়ে ধরেছে। ভাত যেন বাড়া ছিল। হাতমুখ ধোয়ার পানি দিলো নানি আমাদের। বললো, ‘আয় খাইয়া ল আগে, এত পথ হাইটা আইছস…’
খেয়েটেয়ে আমি মারবেল খেলায় লেগে গেলাম। মা ঢুকে গেলে কাচারি ঘরে। বিকেল হয়ে গেলে কেমন লালচে সোনালি নরোম রোদ এসে উঠানের একপাশে পড়ে রইল সন্ধ্যার প্রতীক্ষায়। আমি ক্লান্তি ঠেলে, কাচারি ঘরের দরজা ঠেলে মাকে খুঁজতে গিয়ে দেখি। মাকে দেখি বাবার সামনে বসে আছে। পরনে একটা নতুন শাড়ি। শাদার উপর আলতা রং ছোট ছোট ফুল। দুধে আলতা রং কাকে বলে সেদিন দেখেছিলাম। মা’র একটা পায়ে আলতা, অন্য পা বাবার কোলের উপর। বাবা সেই পায়ে খুব মনোযোগ দিয়ে আলতা পরিয়ে দিচ্ছে, আমাকেও খেয়াল করলো না। আমি চুপচাপ গিয়ে মা’র গা ঘেঁষে বসলাম। মা’র পায়ে আলতা শেষ হলে। আমি বললাম, ‘আমিও আলতা পরবো।’ মা বললো, ‘তুই তো ছেলে। আলতা পরে তো মেয়েরা।’
আমি বললাম, ‘তারপরও পরবো।’ বলে আমি আলতার বোতল নিয়ে হাতে পায়ে মুখে মেখে একটা টকটকে লাল আলতাপরী হয়ে গেলাম।…’
সুমনের ডায়েরিতে মায়ের এই গল্প পড়ে আমার এতক্ষণে এমন কান্না পেলো! কেমন করে বলি? মাকে নিয়ে আমারও দশ বছর বয়েসের একটা স্মৃতি মনে পড়ে গেলো। আমি চোখমুখ চেপে ঘর থেকে বের হয়ে প্রায় ছুটে গিয়ে আমাদের পুকুরটাতে নেমে গেলাম। ডুব দিয়ে বাঁধানো ঘাটের সিঁড়ির কোনার একটা পাথর দুহাতে বুকে চেপে ধরে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লাম জলের তলায়, পাথরের আশ্লেষ আমাকে ভাসতে দিলো না। আমি জলের তলায় ডুব দিয়ে চিৎকার করে কাঁদলাম, একমিনিট পরে, ভেসে উঠে আবার ডুব দিলাম…
পুকুর থেকে উঠে আমি সুমনকে আবার খুঁজতে লাগলাম। কিন্তু কোথাও পেলাম না। হঠাৎ করে আমি বুঝে গেলাম সুমন কোথায়। তার আগে মা’র স্মৃতিটা সুমনের ডায়েরির মতো করেই বলি—
একদিন রাত্রিবেলা আমার ঘুম ভেঙে গেল। পাশের ঘরে বাবা-মা প্রচণ্ড ঝগড়া করছিল সেই শব্দে। সুমন এইসব শব্দে তখন আর উঠে আসে না আরো বেশ কয়েক বছর হয়ে গেছে। আমি দুহাতে চোখ ঘষে উঠে গিয়ে তাদের ঘরের দরজায় দাঁড়ালাম। ঝগড়ার কারণ ধরতে পারলাম না। দেয়াল ঘড়িতে তখন রাত্রি দেড়টা। মা ছুটে এসে আমার হাত ধরলো।
বললো, ‘চল নয়ন।’
বাবা বললো, ‘কোথায় যাও?’
মা বললো, ‘জানি না।’ বলেই আমার হাত ধরে হিড় হিড় করে টেনে বাড়ির বাইরে চলে এলো।
তখন আমার বয়স দশ। আর মায়ের বয়স পঁয়ত্রিশ হবে হয়ত। বাড়ির ঘাটার কাছে এসে মা দাঁড়িয়ে গেল। বাঁশের গেটকে আমরা ঘাটা বলতাম। চোখ দিয়ে পানি পড়ছিল মা’র। ডুবি ডুবি চাঁদের আলোতে গাল চিক চিক করছিল।
আমি বললাম, ‘কই, চলো।’
মা বললো, ‘এত রাতে কই যাবো বুঝে আসতেছে নারে, নয়ন।’
আমি আর সুমনের মতো বলতে পারলাম না যে, ‘চলো, নানার বাড়িত যাই।’ কারণ ততোদিনে নানা-নানি গত হয়েছেন। মামারা বসতবাড়ি বিক্রি করে যে যার মতো ঘর করেছে। সুতরাং মা’র কোথাও আর যাওয়ার জায়গা নেই। মা আমার হাত ধরে কতোক্ষণ ঘাটার কাছে বসেছিলো জানি না। কারণ আমি মায়ের গায়ে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
সকালে ঘরের ভিতর আমার বিছানাতেই আমার ঘুম ভাঙে, বাবার ডাকে। মা কোথাও নেই। সম্ভাব্য সব জায়গায় খোঁজা হয়েছে। দুপুর পর্যন্ত আমিও খুঁজলাম, কোথাও রাইক্ষেতে, কোথাও ব্রিজের তলায় নদীর ধারে, কোথাও প্রাচীন গাছের গর্তে, কোথাও পানের বরজে, আরো সব আমার চেনা জায়গায়। তারপর হঠাৎ মনে হলো মা কোথায় আছে আমি জানি। আমি ছুটে বের হয়ে আমাদের বাড়ির পেছনে শুকনো পাতকুয়াটার কাছে চলে গেলাম। তখন সূর্য মাথার উপর। আমি কুয়ার পাড়ে চোখ রেখে দেখি মা ব্যাঙের মতো বসে আছে নিচে, হাঁটুতে মুখ গুঁজে। আমি ‘মা-আ-আ…’ বলে ডাক দিলাম, আর সঙ্গে সঙ্গে কুয়ার তলা থেকে সেই ডাক ফিরে এলো। মনে হলো মা-ও আমাকে মা বলেই ডাকলো। আমার ডাক শুনে কুয়ার তলা থেকে আমার দিকে চোখ তুলে মা সূর্যমুখী হয়ে গেলো।
সেদিন মা’র মৃত্যুর দিন সেই রকম এক দুপুরের রোদের ভিতর সুমনকেও আমি খুঁজে পেয়েছিলাম সেই কুয়ার মধ্যে। তার গায়ে জড়ানো ছিলো মা’র সেই শাদার উপর আলতা রং ছোট ছোট ফুল আঁকা শাড়িটা। একইভাবে সে ব্যাঙের মতো বসেছিলো হাঁটুতে মুখ গুঁজে। মা’র সঙ্গে তার পার্থক্য ছিলো কেবল, আমার ডাকে সে সূর্যমুখী হতে পারেনি।