শনিবার, ০৩ জুলাই ২০২১, ১০:১২ পূর্বাহ্ন
অ্যাট গানপয়েন্ট
প্র্যাক্সিস ৩০শে মার্চ ২০২১ সংখ্যায় প্রকাশিত “দ্যা নর্থ এন্ড : আখ্যানতাত্ত্বিক পর্যালোচনা ও অন্যান্য”এর প্রতিক্রিয়া
*
আন্তন চেখভের একটা ‘বন্দুক’ ছিল, উদ্ধরণ চিহ্নের ভিতর। তবে হেমিংওয়ের একটা সত্যি-সত্যি বন্দুক ছিল – ডাবল-ব্যারেল শটগান – যা দিয়ে নিজেই নিজেকে গুলি করে মারেন উনি। নাবোকভের বন্দুক ছিল না – বন্দুক ছিল তাঁর বউ ভেরার; কেজিবির হাত থেকে বরকে বাঁচাতে পার্সের ভিতর পিস্তল নিয়ে ঘুরতেন উনি।
১৮৯৭ সনে প্রণীত ‘চেখভের বন্দুকনীতি’ সেই সময়ের সাহিত্যরসিকদের জন্য গোল্ড স্ট্যান্ডার্ডের মতো ছিল। “Chekhov’s Gun” এতদিনে একটা বাগধারাই হয়ে গেছে, কিন্তু প্রায় দেড়শ’ বছর আগে চেখভের একাধিক প্রবন্ধ ও ব্যক্তিগত চিঠিতে ঘুরে-ঘুরে এসেছে এই নীতি। নীতিটি এইরকম: “নাটকের প্রথম অঙ্কে যদি তুমি একটা ড্রয়িংরুম দেখাও, আর সেই ড্রয়িংরুমের দেয়ালে ঝুলন্ত একটা বন্দুক দেখাও, অবশ্য-অবশ্যই দ্বিতীয় অঙ্কে তোমার দেখাতে হবে যে বন্দুকটা দিয়ে কেউ গুলি ছুড়ছে। নইলে ওই বন্দুক দেখানোর কোনো প্রয়োজন নাই।“
এই নীতির সাথে আমার প্রথম পরিচয় ঘটে – কোনো ক্লাসিক সাহিত্য পড়তে গিয়ে নয় – গ্র্যাজুয়েশনের পর একটা বহুজাতিক কম্পানির বিপণন ব্যবস্থাপক হিসাবে কাজ করতে গিয়ে। বিক্রয় ও বিপণনে এই নীতির একটা অনুসিদ্ধান্ত চলে: “ডোন্ট ওভারপ্রমিস অ্যান্ড আন্ডারডেলিভার” অর্থাৎ, ভোক্তাকে এমন কথা দিও না, যা রাখতে পারবে না, অর্থাৎ প্রতিশ্রুতি-মোতাবেক মাল ডেলিভারি কর দেখি বাবা। এই কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে চেখভের বন্দুকনীতি কালের পরিক্রমায় স্কুলের ইংরেজি পাঠ্যপুস্তকে, “ক্রিয়েটিভ রাইটিং ফর ডামিজ” পুস্তিকায় এবং ব্র্যান্ড ম্যানেজমেন্ট, মার্কেটিং ও অ্যাডভার্টাইজিংয়ের শব্দকোষে সংযুক্ত হয়েছে – আর তারপর ফরমায়েশি কনটেন্টের দুনিয়ায় একটা ফর্মুলা এবং সৃজনশীল সাহিত্যের দুনিয়ায় একটা চলমান কৌতুকে পরিণত হয়েছে। হেমিংওয়ে তাঁর দ্য আর্ট অভ দ্য শর্ট স্টোরি প্রবন্ধে বন্দুকনীতিকে শুধু বিদ্রূপ করেই ক্ষান্ত হন নাই, সেইসাথে তাঁর নিজের লেখা ছোটগল্প এবং সেই গল্পের ভিতরকার অনন্বিত, তুচ্ছ, পারম্পর্যহীন ঘটনা এবং একবার দেখা দিয়ে গায়েব হয়ে যাওয়া চরিত্রকে দৃষ্টান্ত হিসাবে ব্যবহার করে দেখিয়েছেন যে সাহিত্যনাটকের যে অঙ্কে চেখভ ছিলেন, সেই অঙ্কের বন্দুকে হেমিংওয়ের আগ্রহ নাই।
প্র্যাক্সিসে প্রকাশিত জহিরুল মল্লিকের লেখা ‘দ্যা নর্থ এন্ড: আখ্যানতাত্ত্বিক পর্যালোচনা ও অন্যান্য’ আমার প্রথম উপন্যাস দ্যা নর্থ এন্ড বিষয়ে প্রথম-প্রকাশিত পূর্ণাঙ্গ রিভিউ (সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, গুডরীড্স, ডেইলি স্টারে ছাপা হওয়া “What I Read in 2020” কলামে আরো এক ডজন লেখকের সাথে শবনম নাদিয়ার লেখা এক প্যারাগ্রাফ ও কয়েকজন লেখকের ব্যক্তিগত ব্লগে প্রকাশিত পাঠপ্রতিক্রিয়ার বাইরে)। জহিরুলের করা সমালোচনাটি স্বভাবতই ফেসবুকে প্রকাশিত কয়েক বাক্যের স্ট্যাটাসের চেয়ে দীর্ঘতর ও কমপ্রিহেনসিভ। উপন্যাসটির পিছনে জহিরুল সময় দিয়েছেন এবং এটিকে সমালোচনার যোগ্য মনে করেছেন, এতে আমি আনন্দিত হয়েছি। একইসাথে, ১) মডার্নিস্ট সাহিত্যরুচিতে যে ‘গ্র্যান্ড ন্যারেটিভই’ মুখ্য, এবং ২) এই গ্র্যান্ড ন্যারেটিভের কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর জন্য যে লেখককে শুধু লিখে গেলেই হয় না, নিজের সাহিত্যচিন্তাকেও জানান দিতে হয় – অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে এই দুইয়ের মাঝে প্রথমটা, এবং অত্যন্ত দ্বিধার সাথে দ্বিতীয়টার ব্যাপারে আমি নিঃসন্দেহ হয়েছি।
পরম্পরার বিচারে আমি চেখভের উত্তরসূরী নই – চেখভ যে গল্পবলিয়েদের মধ্যে মাস্টারদের মাস্টার ছিলেন – এই সত্য চোখ বুঁজে মেনে নেওয়ার পরও নই; তাই তাঁর বন্দুকেও আমার অধিকার নাই। (তবে চেখভ নিজেই কি নিজেকে কম ভেঙেছেন? ‘দ্য লেডি উইথ দ্য লিটল ডগ’ পড়ুন!) আমার নোটবইতে লেখা আছে: “My concern is to show everything – the pictures, the detail, the scene – exactly. (Nabokov)”. নাবোকভের সাহিত্যসাধনার কেন্দ্রে ছিল ‘ভার্সিমিলিচ্যুড’ – আমার ভাষায় ‘সত্যপ্রতিমতা’। ‘সত্যসাদৃশ্য’ নয় কিন্তু! ‘সাহিত্য হচ্ছে সমাজের দর্পণ’ – এর মতো সারশূন্য অ্যাডেজ আর দুইটা নাই, সাহিত্যকে যদি সত্য হতে হয় – কেননা তবে আগে মানতে হবে যে সত্য সাদৃশ্যর অপেক্ষা রাখে না। এমনকি সত্য কথনের বা লিখনের অপেক্ষাতেও থাকে না। (‘পারহেসিয়া’ ইত্যাদি রাজনৈতিক ধারণা ধার করে নিয়ে এসে যারা শিল্পের ডিসকোর্সকে গড়ে-পিটে নেওয়ার চেষ্টা করছেন, আমি তাঁদেরকে বিনয়ের সাথে বলব যে সাহিত্যের একটা দর্শন বা রাজনীতি থাকলেও দর্শন বা রাজনীতির কাজ সাহিত্যকে সাজে না। দর্শন-হতে-চাওয়া-সাহিত্য বেসুরা গানবিশেষ – কানে বাযে)। শিল্পে সত্য – থাকে। তাকে যে দেখার, সে দেখে। তাই যে দেখায়, সে ঘাড় ধরে চোখে আঙুল দিয়ে দেখায় না। ‘শো, ডোন্ট টেল’ – শিল্পের মোটামুটি সবগুলি ধ্রুপদী ধারাতেই হাতেখড়ি পর্যায়ের ইনস্ট্রাকশন বলে জানি।
তবে জহিরুল আমাদের দেখাতে চাইলেন যে সত্য আর কিছুর অপেক্ষা করুক বা না-করুক, কথকের তথ্যনিষ্ঠ ‘টেলিং’-এর অপেক্ষা করে বিলক্ষণ। তিনি আরো বললেন, প্রথম অঙ্কে যে একবার বিন্দুর-মাঝে-বন্দুককে প্রত্যক্ষ করেছে, চেখভের সেই বন্দুকের গর্জে ওঠার জন্য সে অপেক্ষা করে শেষ অঙ্ক পর্যন্ত।
*
জহিরুলের পাঠপ্রতিক্রিয়ার এই অংশটি আমার জন্য খুব কৌতূহলোদ্দীপক ছিল:
“ভালো লেগেছে পুরনো প্রেম ভেঙে যাওয়ার বা যৌথজীবন থেকে সরে আসতে চাওয়ার কারণের ব্যাখ্যা—যা একসময় আকর্ষণ ছিল তাই হয়তো মনঃপীড়ার অন্যতম কারণ এখন। নতুন প্রেমের কারণও খুব চমৎকার যৌক্তিকতায় তুলে ধরা হয়েছে। যদিও বলা হয়েছে এই প্রেমে “কোনো আপাত কার্যকারণ সম্বন্ধ নাই”, তবু কাহিনীতে ধরা দেয় যে প্রাত্যহিক চিরায়তের ব্যাপারে উদাস অনুভব, আর অবাধ অনধীনতা ও অকপটতার প্রতি আকর্ষণ এর চালিকাশক্তি”।
অর্থাৎ জহিরুল আমাদের বোঝালেন যে যৌক্তিকতা ও কার্যকারণসম্বন্ধ ছাড়া উপন্যাসের গাছে একটি পাতাও নড়ে না। অথচ, ‘চেখভিয়ান’ – মানে, ব্যাখ্যাসাধ্য ঘটনাপরম্পরা দিয়ে গল্প বলে যাওয়ার যে মডার্নিস্ট রীতি, সেই রীতি ভাঙা হয়েছে চেখভের জীবদ্দশাতেই। বোধ করি দ্যা নর্থ এন্ডের বিজ্ঞাপন আর ফ্ল্যাপ পড়ে উপন্যাসটির কাছ থেকে ইস্যুভিত্তিক বিস্তার ও গভীরতার আশা ছিল জহিরুলের – অর্থাৎ চ্যারিটি যেই ভুবনে গোপনে-গোপনে কাজ করে যায়, সেই ভুবনের রহস্য বাহ্য নয় কেন? বিজ্ঞাপনে যদি চেখভের বন্দুক থেকে থাকে, তাহলে বইয়ের ভিতর সেই বন্দুকের কলকব্জা খুলে কেন দেখানো হলো না? এইখানে জহিরুল হতাশ হয়েছেন। চ্যারিটির ‘থীম’টির যে পরিপূর্ণ ও তদন্তমূলক অনুসন্ধান উপন্যাসটিতে ঘটে নাই, তাতে অবশ্য তিনি শিল্পের চেপে-যাওয়া সত্য দেখেন নাই, ঔপন্যাসিকের অপারগতাই দেখেছেন। তিনি বলেন, “কাহিনীর সরলরৈখিকতা কমাতে নানা অনুষঙ্গের যোগান ছিল, কিন্তু তার একটিও বিস্তার লাভ করে নি”। এমত শিল্পবোধই হয়তো ‘শো, ডোন্ট টেল’-এর অ্যান্টিথিসিস।
দ্যা নর্থ এন্ড লেখার সময় আমি রুশদীর কিশট্ উপন্যাসটি পড়ছিলাম। তখনো করোনা আসে নাই। রুশদী দেশে-দেশে বইয়ের পাবলিসিটি করে বেড়াচ্ছেন – সেখানে এক সমালোচকের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন (প্রশ্নটি কী ছিল, ভুলে গেছি; উত্তর স্মৃতি থেকে লিখছি), “In my novel, I will not create a world where the world-within-that-world is obsessed with social media, unfazed by zero attention span, but the narration-within-that-world is realist YET pristine, jaded and literary”. লেখকদের থেকে শেখার অন্ত নাই – আর তাছাড়া আমাদের ভুয়োদর্শন বলে ‘বুদ্ধিমান গুণবানের গোলাম’। একই সময়ে চতুর্থবারের মতো ক্ল্যারিস লিস্পেক্টরের বিসীজ্ড্ সিটি পড়ছিলাম। সিটি-স্কোয়ারে ঘোড়ার খুরের আওয়াজ ক্রমাগত প্রদক্ষিণ করছে, আর মেয়েটার হাত ধরে ছেলেটা মন দিয়ে একটা গুবরেপোকা দেখছে (“His eyelids blinking from the sun and from a stubborn thought of love”), কারণ তারা নাকি এতই ধীর আর এতই ডিফিকাল্ট ছিল যে ঘাউড়ার মতো তারা শুধু সেটাই দেখছিল যেটা দিয়ে তারা তৈরি, আর মেয়েটার মুখ যেমন চড়াতারে বাঁধা ছিল, গুবরেপোকাটাও নাকি তেমনই। কোথায় কার্যকারণ আর কোথায় বা তার বিস্তার? পাতার পর পাতা শুধু ঘোড়ার মুখ আর প্রায়-স্পিরিচুয়াল ক্রিপটিক বয়ান। উপন্যাসের জগৎ আপনার জগতের কার্যকারণের সাম্বন্ধিক ধারণাকে সর্বক্ষণ বাঁকাতে চাইবে, আপনার সম্ভাব্যতার সংজ্ঞার রেঞ্জ কতখানি, তার লাগাতার পরীক্ষা নেবে। আপনার পূর্বসাধিত জগতের ভিতর নিজেকে আঁটিয়ে নিলে সাহিত্যের যেই লোকোত্তর সত্য বলার কথা, তা সে কীভাবে বলবে? কেন বলবে?
দ্যা নর্থ এন্ডকে উপন্যাসের তালিকায় স্থান দিতে জহিরুল গররাজি। এই প্রসঙ্গে – এবং পাঠপ্রতিক্রিয়ার স্থানে-স্থানে – জহিরুল তাঁর সিদ্ধান্তের ভার “সাহিত্যে বিদ্যায়তনিক শিক্ষায় শিক্ষিত”দের হাতে ন্যস্ত করেছেন। বিদ্যায়তনিক ধারা কী বলবে জানা নাই, তবে অচলায়তনিক ধারায় আপনি একটি অন্ধকার গবেষণাগারে বসে বৃক্ষকে তার পত্র-পুষ্প-শাখা-বৃন্ত-কাণ্ড-শিকড় ধরে-ধরে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করবেন, গবেষণার স্বার্থে তাতে অনর্গল পানি আর সার ঢালবেন, অতঃপর সেমিনার-সিম্পোজিয়ামের মঞ্চমতন জায়গাটায় দাঁড়িয়ে মৃত বৃক্ষের শীর্ণ অবশেষটুকু হেলায় দোলাতে দোলাতে এম্পিরিক্যালি প্রমাণ করে ছাড়বেন যে বৃক্ষ একটি প্রাণহীন সবুজ জড়বস্তু – শুধু তাই নয়, বৃক্ষ আসলে তার ফলের চেয়ে বেশি কিছু নয় – কেননা ফল আমরা খেয়ে থাকি। চেখভের বন্দুকের যে ফ্যালাসি, তাকে বেনথামের উপযোগবাদের সাথে পাঞ্চ করে দিলে যা দাঁড়ায়, তার উজ্জ্বল উদাহরণ হচ্ছে জহিরুলের করা দ্যা নর্থ এন্ড-এর রিভিউ।
বলা ভাল, দ্যা নর্থ এন্ড-ব্যবচ্ছেদে এর মাঝে উপন্যাস খুঁজে না পেলেও এর টেক্সটে কিছু ‘উজ্জ্বলতা’ জহিরুল খুঁজে পেয়েছেন – মানে সাহিত্য না পেলেও সাহিত্যভাবাপন্নতা কিছু ছিল বটে। তিনি মুন্সিয়ানা পেয়েছেন ‘ভাষার প্রয়োগে’’ – ভাষায় নয় (আমাদের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে তান আর মুড়কিকে অনেক আনইনিশিয়েটেড শ্রোতা ডাকে ‘গলার কাজ’ বলে)। ‘শৈলী’ আমার খুব প্রিয় একটা শব্দ – তবে কার্যকারণ আর ঘটনাপরম্পরার সূত্র-অনুসরণে নিবেদিতপ্রাণ জহিরুল সেদিকে যান নাই। ধরে নিচ্ছি আমার শৈলীতে যথেষ্ট উজ্জ্বলতা নাই।
*
যেই সময়ে আমি এই প্রতিক্রিয়া লিখছি, সেই সময়ে দ্যা নর্থ এন্ড-এর দ্বিতীয় সংস্করণের কাজ চলছে। উপন্যাসটির যেইসব অংশ আমি পরিমার্জন করছি, তার মধ্যে শেষ অধ্যায়টির গুরুত্ব আমার চোখে সবচেয়ে বেশি। তাই শেষ অধ্যায়টির পাঠপ্রতিক্রিয়া আমি বিশেষ মনোযোগ দিয়ে পড়ি। এই বিষয়ে জহিরুল কী মনে করেন, তাও পড়লাম:
“(মূল চরিত্র) বর্ণালী যদি সবশেষে ঘুম থেকে উঠে পাঠকের সামনে বাকি পরিকল্পনা নিয়ে দাঁড়াতো, তবে এই কাহিনীর ব্যাপ্তি ভিন্নতর মাত্রা পেতে পারতো”।
ভিন্নতর মাত্রার ব্যাপারে আমিও নিঃসন্দেহ – এতে কাহিনির ব্যাপ্তি কমে মডার্নিস্ট প্রত্যাশার সীমার ভিতর ঢুকে যেত, যেখানে শেষ পর্যায়ে এসে প্রটাগনিস্টের জীবনের জিদ্দি সমস্যার সমাধান করে দেওয়ার দায় ঔপন্যাসিক সানন্দে গ্রহণ করতে পারতেন। তবে কিনা, একটা উপন্যাস কীভাবে শেষ হলে ভাল হতো – প্রটাগনিস্টকে ঘুম থেকে তুলে, নাকি ঘুম পাড়িয়ে – সাহিত্যালোচনায় সেই পরামর্শ দস্তুরমাফিক নয় বলেই জানি। গান পরিবেশনা শেষ হলে শিল্পীকে ‘শেষ তানটা ছুটের না হয়ে সপাটের হলেই ভাল হতো’ বলা যেমন দস্তুরমাফিক নয়। যেমন দস্তুরমাফিক নয় – না, বরং বলা চলে রীতিমতো আউটরেজাস – উপন্যাসের চরিত্রকে তার শ্রেণী, সমাজ, পেশা ও জাতির মুখপাত্রমাত্র হিসাবে দেখতে চাওয়া। সাংবাদিকতায় পর্যবসিত লিবার্যাল প্রকল্পের সাহিত্য পড়তে-পড়তে যে অভিরুচি তৈরি হয়, তার অবশ্য রিডেমশন অনিশ্চিত। রাহাত ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করে, অতএব রাহাতের মুখ থেকে ওষুধ কম্পানির দুর্নীতি-বিষয়ে ‘ভিতরের খবর’ আর রগরগে, অপঠিত, নেভার-সীন-নর-হার্ড-বিফোর তথ্যাণু শুনতে না-পেলে পাঠকের চলছেই না? মানে, মর্যালিস্ট একটা প্রত্যাশা রাহাতের কাছ থেকে করলে তারও কিছু একটা সান্ত্বনা ছিল – কেননা ধর্ম কিম্বা ন্যায়শাস্ত্রকে হঠানোর ক্ষমতা সাহিত্যের থাকলেও থাকতে পারে, কিন্তু গুগল, সংবাদমাধ্যম আর নৃতাত্ত্বিক গবেষণাকে হঠাবে সে কী গুণে?
উপন্যাসের অধ্যায়-বিভাজন নিয়েও জহিরুল সন্তুষ্ট নন। এই বিষয়ে তিনি এতটুকুই বলেন, “কথাসাহিত্যের বহুলপ্রচলিত কৌশলগুলোর প্রয়োগই উপন্যাসের স্বাভাবিক রসাস্বাদনের জন্য যথেষ্ট ছিল” – একমাত্র টেকনোক্র্যাট সাহিত্যিকের পক্ষেই বোঝা সম্ভব বহুলপ্রচলিত কৌশল বলতে সমালোচক কোন্ কৌশলকে বুঝিয়েছেন। প্রতিনিয়ত হাত ময়লা করে ও মগজ ধ্বস্ত করে লিখতে শেখা এই আমার বিবেচনায় সমালোচক বস্তুত জানান দিয়েছেন যে নিজের এস্থেটিক অভ্যস্ততার বাইরে সাহিত্যকে পাঠ করার বৌদ্ধিক এবং/ অথবা শৈল্পিক প্রস্তুতি তাঁর সীমিত।
জেরার্ড জেনেটের ন্যারেটোলজিকে (আখ্যানতত্ত্ব) জহিরুল তাঁর সমালোচনার কাঠামো হিসাবে ব্যবহার করতে চেয়েছেন। ন্যারেটোলজি? জেরার্ড জেনেট? সাহিত্যচিন্তায় কোথায় পড়ে আছি আমরা যে ‘ন্যারেটিভ ডিসকোর্স’ তকমা দিয়ে আমাদের একটা উপন্যাসকে বুঝতে হয়? সৃজনশীল সাহিত্য তো সংবাদপত্র কিম্বা নির্বাচনী ইশতেহার কিম্বা ওটিটি প্ল্যাটফর্মের কনটেন্ট কিম্বা এথনোগ্রাফিক প্রবন্ধ নয়। আর তাছাড়া সাহিত্যকে ‘ন্যারেটিভ’ অভিধা দিয়ে সংকুচিত করে আনার মধ্যে আমি নন্দনের রাজনীতিই দেখি, খুব চ্যারিটেবলি দেখতে চাইলেও প্রতিষ্ঠানদত্ত রুচির অনমনীয় সীমানার চেয়ে উচ্চতর কিছু দেখি না। এখানে বলে রাখি, রুচিগত পক্ষপাত এমনকি সবচেয়ে উদার পাঠকের ক্ষেত্রেও স্বাভাবিক। তবে নিজস্ব পক্ষপাতের ব্যাপারে অসচেতনতা নিয়ে নির্মোহ সাহিত্যালোচনা করা যায় না বলেই মনে করি। (অ্যাকাডেমির ভিতরে একটা চল আছে জানি – গবেষণাপত্রে ‘লিমিটেশন’ নামাঙ্কিত একটা অধ্যায় থাকে। ‘ডিসক্লেইমার’ বা ‘ফুল ডিসক্লোজার’ থাকে যেমন বীমা কম্পানির বিজ্ঞাপনে। সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদা সিরিজে আছে বিখ্যাত সংলাপ: “ও রসে বঞ্চিত”। সেটা অবশ্য আদতে লিমিট; লিমিটেশন নয়।)
*
জহিরুলের পাঠ প্রতিনিধিত্ব খোঁজে। জেরার্ড জেনেটের ফেনোমেনোলজিকাল পাঠও তাই খুঁজত বলে শুনি। সেই অর্থে তিনি জেনেটের তাত্ত্বিক ফ্রেমের প্রতি বিশ্বস্ত থেকেছেন। উত্তমপুরুষের বয়ানে জহিরুল বহুপাক্ষিক দৃষ্টিকোণ (৩৬০ ডিগ্রি?) অন্বেষণ করেন। জহিরুল বলেন, “রানিয়াকে সামনাসামনি দেখে ‘কী মনে হচ্ছে’ তা যদি রাহাতকে বলতে দেওয়া হতো, তাহলে রানিয়া চরিত্রটি ভিন্নতর ব্যাঞ্জনায় পাঠকের কাছে ধরা দিতে পারত। একই কথা বলা যায় তিথি চরিত্রটির ক্ষেত্রেও। তিথিও গভীরতার দিকে যেতে পারল না।“ জহিরুল আরো রায় দিয়েছেন যে, চরিত্রদের ‘উক্তি’ বা ‘চিন্তা’ যেভাবে উপস্থাপিত হয়েছে, তা হয়েছে শুধু কাহিনীর উপর প্রধান চরিত্র বর্ণালীর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার প্রয়াস হিসেবে।
একটা কবিতা বা গল্প বা উপন্যাস লিখতে হলে লেখককে অনেকগুলি এফেকটিভ সিদ্ধান্ত নিতে পারতে হয়। উত্তমপুরুষে গল্প বলার সিদ্ধান্তটি সচেতন ছিল – ঈশ্বরের চোখ দিয়ে দেখা নামপুরুষের বয়ানে যে কসমেটিক অমনিশেন্স বা সর্বজ্ঞতা থাকে, তার থেকে দূরে থাকার একটা পরিকল্পনা থেকেই এই সিদ্ধান্তে আমি পৌঁছি। এই সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে – এর এফেকটিভনেস নিয়ে সমালোচনাও – কিন্তু এই সিদ্ধান্তের উপসর্গমাত্র নিয়ে (প্রটাগনিস্ট কেন ‘বিচারমূলক’? তাই তো! হায়, প্রটাগনিস্ট কেন শিক্ষামূলক হলো না?) জহিরুল যে আরবিট্রারি অভিমত দিয়েছেন, তাতে আমার সন্দেহ হচ্ছে জহিরুল নতুন বাংলা গল্পে স্যানিটাইজড্, সুশীল, হার-না-মানা, আদর্শ নারীকণ্ঠের ‘নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার প্রয়াস’ই শুধু দেখতে প্রস্তুত (সমালোচনাপাঠের জায়গায়-জায়গায় দুর্গা, চণ্ডী, কালী ইত্যাদি দেবীর ক্লিশে ও প্রতীকী অর্থ নিয়ে জহিরুলের অবসেশন আমাকে চিন্তিত করেছে)। দ্যা নর্থ এন্ডের প্রটাগনিস্টের মতন প্রেমে সিদ্ধান্তহীন, বিবাহে টক্সিক, বন্ধুত্বে বিশ্বস্ত, রাজনীতিতে সুবিধাবাদী ও সেক্যুলার, পরিবারে এতিম, পাঠে ট্রেন্ডি, ভোগে ডিজিটাল, আর্থিকভাবে স্বাধীন, সামাজিকভাবে পরনির্ভরশীল, পুরাদস্তুর আধুনিক নারী-চরিত্র জহিরুলের বাস্তব অভিজ্ঞাকে নাড়া দিতে পারে না – কিম্বা হয়তো ‘এমন একটা পরিস্থিতিতে এমন একটা মেয়ে কী করতে পারে?’ প্রশ্নের যে যুক্তিসিদ্ধ উত্তর তাঁর আগে থেকেই জানা আছে, সেই যুক্তিবোধকে পরিতুষ্ট না-করার মাধ্যমে এমনই নাড়া দেয় যে জহিরুল তাঁর বাস্তব অভিজ্ঞাকে সক্রোধে বুকের আরো কাছে চেপে ধরেন। রানিয়া চরিত্রটি কেন “প্রধান চরিত্র বর্ণালীর সনাতন ব্যাখ্যার বাইরে যেতে পারল না”’ তাই নিয়ে তাঁর স্পষ্ট ল্যামেন্টেশন আমাকে ত্রাণ ও এমপাওয়ারমেন্টের রাজনীতি নিয়ে আরেকবার ভাবিত করে।
জহিরুল মনোযোগী পাঠক – সামাজিক পরিসরে তাঁর থেকে আমি জেনেছি তিনি আমার লেখা ছোটগল্প চশ্মে ক্বাতিল (সমকাল পত্রিকায় প্রথম ঢেউ নামে প্রকাশিত) এবং জাঙ্গলিক বিশেষ পছন্দ করেছিলেন। দুইটাই দ্যা নর্থ এন্ড প্রকাশের অনতিপরে লিখিত ও প্রকাশিত হয় – অতএব বলা যায় এর মাঝে আমার শৈলী ও লেখকবৃত্তির বোঝাপড়ায় কোনো বৈপ্লবিক পরিবর্তন হয় নাই। দুইটাই পিরিয়ড প্লটের উপর নির্মিত। দুইটাই পুরুষ-পুরুষ হেটেরোসেকশুয়াল সম্পর্ক, পৌরুষ ও পুরুষত্বের সমস্যা নিয়ে ডিল করে। দুইটারই বয়ান উত্তমপুরুষে। দুইটারই প্রটাগনিস্ট পুরুষ। দুইটারই প্রটাগনিস্ট যাচ্ছেতাই রকমের জাজমেন্টাল (জহিরুলের থেকে ধার করে বললে ‘বিচারমূলক’), এবং দুইটাতেই প্রটাগনিস্টের চোখ দিয়ে নারীকে সাবজেক্ট থেকে অবজেক্টে নামিয়ে আনা হয়েছে। সেইখানে চরিত্রের প্রতিনিধিত্বহীন উপস্থাপনের ইস্যু, ধারণা করছি, জহিরুলের কাছে সমস্যার মনে হয় নাই। সমালোচনাপাঠের এই পর্যায়ে এসে আমি ধন্দে পড়ে যাই সমালোচকের বায়াসের চরিত্র নিয়ে।
সাহিত্যসমালোচনা থেকে আমি জানতে চাই একটা গল্প কীভাবে সাহিত্য হয়ে উঠল (বা উঠল না)। একটা গল্পে আমরা কোন্ কোন্ ইস্যুর উপর কী কী মেসেজ কোন্ কোন্ চরিত্রের মুখ থেকে শুনতে পেলাম (বা পেলাম না) তার নির্ঘণ্ট বানানো যোগ্য সমালোচকের কাজ না। অতএব সন্দেহ নাই, জহিরুলের সমালোচনা একটা মিস্ড অপরচুনিটি ছিল – ছোটগল্প বনাম উপন্যাসের ফর্মগত, শৈলীগত ও কাঠামোগত ডিসিপ্লিনের অঞ্চলে তিনি আমার কাজকে লোকেট করতে পারতেন। তার বদলে ‘ন্যারেটিভ’ ও তার প্রকল্পগত ডিসিপ্লিনকে সামনে এনে তিনি যত-না উন্মোচন করলেন দ্যা নর্থ এন্ডকে, তার চেয়েও বেশি করলেন তাঁর পাঠগত দৃষ্টিকোণের ও অনুসৃত তাত্ত্বিক ফ্রেমের পরিসীমাকে। বলতেই হচ্ছে – সাহিত্যের প্রতি এ এক ডিসসার্ভিস, এবং সাহিত্যিকের জন্য এহেন সমালোচনা প্রায়-মূল্যহীন। তুলনামূলক সাহিত্যে ডিগ্রিপ্রার্থীর অভিসন্দর্ভের প্রাথমিক খসড়া হিসাবে এই সমালোচনার কিছু মূল্য থাকলেও থাকতে পারে।
এখানে বলে রাখি: গল্পে চরিত্র কী কাজ করে সেই বিষয়ে আমার এখনো পরিষ্কার ধারণা নাই; তবে কী কাজ করে না, এবং উৎকৃষ্ট সাহিত্যে কী কাজ কখনোই করবে না, সেই বিষয়ে আমার ধারণা পরিষ্কার। যদিও সাহিত্যের এক-একটা চরিত্র যে এক-একটা মনস্তাত্ত্বিক মাল্টিপ্লেক্স নয়, রসগ্রাহী পাঠক যে মনোরোগবিদ নয়, এবং সাইকোঅ্যানালিসিস যে সাহিত্যের কাজ নয় – এই আপ্তবাক্য আজও সাহিত্যরসিকদের বিবেচনার যোগ্য হয়ে উঠতে পারে নাই। এই চক্করে পড়ে আজ সাহিত্যিককেও সৃষ্টিশীল কাজ তুলে রেখে নিজের পুরানো কাজের খতিয়ান নিয়ে বসতে হচ্ছে, এবং সাহিত্যে সে যা-যা করতে চায় নাই তাই-তাই করে দেখিয়ে বুঝিয়ে দিতে হচ্ছে, “এই দেখ বাবা, এইসব-এইসব আমি করব না।“ (“ডোন্ট ওয়রি। আই উইল পে ফর ইট ভেরি ডিয়ারলি” – প্যারিস রিভিউকে সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে নিজের লেখার সময়-নষ্ট হওয়া নিয়ে হেমিংওয়ে বলেছিলেন, ওই সাক্ষাৎকারের ভিতরেই)। সমালোচনাসাহিত্যের এই নিরেট শাঁসের দায় আমি দেই পাঠসংকীর্ণতাকে – সেই সাথে স্বাধীন, স্বয়ংসিদ্ধ, সৃজনশীল সাহিত্যের উপর গণের ও প্রতিষ্ঠানের লোগোসেন্ট্রিক ফিলসফির হুকুমত চাপিয়ে দিতে চাওয়ার হঠকারিতাকে। এই হুকুমত সাহিত্যকে মনে করে ফলিত সমাজবিদ্যা। ক্রমে এই হুকুমত একটা ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্সের চরিত্র ধারণ করে এবং প্রি-অর্ডারকৃত পুষ্টিহীন-স্বাদগন্ধহীন ফর্মুলাপাতার রস খাইয়ে বলতে চায় এই হচ্ছে সমকালীন বাস্তবতার বিশ্লিষ্ট নির্যাস। এই ফাঁদ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখা যেকোনো উচ্চাকাঙ্ক্ষী, সিরিয়াস সাহিত্যিকের কর্তব্য।
*
উপন্যাসের নির্যাস – সম্পূর্ণ উপন্যাসে যার পেশকশ্ ও সাবলিমিটি নিয়ে আমি যারপরনাই আত্মবিশ্বাসী – সেই বিষয়ে জহিরুলের বক্তব্য এই:
“বইয়ের ফ্ল্যাপ থেকে আমরা জানতে পারি এই উপন্যাসে রয়েছে ত্রাণের রাজনীতি, উন্নয়ন ও উত্তরের বিত্তের ভাগ-বাটোয়ারা। আরও বলা হয়েছে যে, “এক বিবাহিত বাঙালি উন্নয়নকর্মীর সঙ্গে তার প্রেমের পরিণাম চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা হয়ে কোপেনহেগেন পর্যন্ত একটা বক্ররেখায় সঞ্চারিত” হওয়ার গল্প এটি। এই সব কিছুরই আভাস আছে উপন্যাসটিতে, কিন্তু বোধের জায়গায় তা ধরা দেয় না।“
“গোটা উপন্যাসে ‘চ্যারিটি বা এইড গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে নি, প্রোপাগান্ডার মতো কিছুক্ষণ বিচরণ করে হারিয়ে গেছে’। প্রসঙ্গক্রমে নানা বিষয়ের অবতারণা হয়েছে দ্যা নর্থ এন্ডে যার বেশিরভাগেরই কারণ বুঝা কঠিন। …‘সাড়ে চুহাত্তর’ সিনেমা দেখা ও তার বর্ণনা অকস্মাৎ কেন এলো তাও অস্পষ্ট থাকল।“
এই ব্যাপারে আমার প্রতিক্রিয়া খুব স্পষ্ট। সাহিত্য পাঠ করে কিছু উদ্ধার করতে হলে শুধু অক্ষরজ্ঞান যথেষ্ট নয় (ধরুন, সেবাল্ডের উপন্যাসে, এমনকি অক্ষরই কি আছে সর্বত্র?) – সঙ্গে প্রয়োজন আভাস, প্রতীক, ধাঁধা, ধ্বনি, চিত্র ও এইসবের মধ্যে রেখে দেওয়া শূন্যস্থানের ভিতর দিয়ে নিজস্ব জগতের পুরাতন অর্থ, অভিজ্ঞা ও পূর্বনির্ধারিত সাহিত্যপ্রকল্পকে চ্যালেঞ্জড্ হতে দেওয়ার ক্ষমতা। (নইলে “গ্রেগর সামসা কেমনে পোকা হয়ে গেল? আর সেই পোকা মরার পর গ্রেটা সামসা কেমনে সুন্দরী, যৌবনবতী হয়ে গেল?” – এর উত্তর খুঁজতে গিয়ে আপনি ফ্ল্যাপ পড়েই মেটামরফসিস তুলে রাখবেন)। এই ক্ষমতা দিয়ে পাঠক টেক্সটকে প্রতিনির্মাণ করেন – এমনকি দুর্মুখ সাহিত্যিককেও এই কথা মানতে দেখেছি। টেক্সটকে এইভাবে গেলার ক্ষমতা জন্মগত নয়, এমনকি অ্যাকাডেমিক ডিগ্রিজাতও নয়; ক্রমাগত অভ্যাস ও সংবেদনশীল পাঠের মধ্যে দিয়ে এই ক্ষমতা অধিগত হয়। ‘আপা, আপনি বীফ খান তো?’ – হিরো ভাইয়ের এই মর্মান্তিক লীডিং প্রশ্ন (যা উন্নয়নের রাজনীতির এসেন্স) যেই পাঠকের দৃষ্টি এড়িয়ে যাবে, সেই পাঠকের মনে হওয়া স্বাভাবিক যে হিরো ভাই চরিত্রটি একটি “সময় অতিবাহিত করার অনুষঙ্গের চেয়ে বেশি কিছু নয়”, আর হয়তো জন্মসূত্রে শাদা-চামড়ার দেখেই “উৎরে যাওয়া” রোজম্যারি চরিত্রটি ত্রাণের রাজনীতির প্রতীক। সেই পাঠকের এমন মনে হওয়াও অস্বাভাবিক নয় যে উপন্যাসের প্রটাগনিস্ট মেয়েটা বুঝি সত্যিই জানে না ‘মাতৃসাজে সেজেছিস মা, করিতে স্নেহের অভিনয়’-এই ডাবলস্পীকের ব্যাখ্যা কী। বা এমন মনে হওয়াও অস্বাভাবিক নয় যে গল্পের চরিত্র আসলে তথ্যগত বা বর্ণনাগত বা ভাষাগত বা পলিটিক্যাল কারেক্টনেসের দায়ে পাঠকের কাছে আবদ্ধ। বা এমনকি এটা মনে হওয়াও স্বাভাবিক যে প্রটাগনিস্ট না – বরং ঔপন্যাসিক নিজেই মূলত অন্ধকারে আছে, যে নিজের মাতৃকুলের অনুসৃত ধর্মাচারে বহুলগীত ভক্তিগান “ভবরঙ্গমঞ্চমাঝে”র শানেনজুল জানে না। আর তাছাড়া চলচ্চিত্রের দর্শক হিসাবেও এই ঔপন্যাসিক কেমন যেন। নইলে দুই বন্ধুর কথোপকথনে উত্তম, সুচিত্রা, ভানু, তুলসী চক্রবর্তী সকলের নাম বসানো হলো – কিন্তু মলিনা দেবীকে বাদ দেওয়া হলো যে বড়? (সমালোচনার এই পর্যায়ে এসে আমার মনে হতে শুরু করে – এ কি সত্যি সিরিয়াস, নাকি ট্রোল?) আমি ধরে নিচ্ছি যে আমার ব্যবহৃত প্লট ডিভাইসের ব্যাখ্যা হিসাবে প্রেমপত্র ও প্রাইভেসির কনটেক্সটে ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ সংখ্যাটির তাৎপর্য, মায় আলাউদ্দিন খিলজী, রানী পদ্মাবতী ও সাড়ে চুয়াত্তর মণ ওজনের ভস্মাবশেষের জনশ্রুতির উপরও উপন্যাসে আমার আলোকপাত করা প্রয়োজন ছিল। সেই সাথে রাহাতের বাড়িতে প্রটাগনিস্টের আগমন, রাহাতের প্রাইভেট জীবনের ভিতর তার ঢুকে পড়া অর্থাৎ ৭৪.৫ ধারার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন – ইত্যাদি সংযোগও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া দরকার ছিল। কিম্বা হয়তো এইসব কিছু না-করে জহিরুলের প্রত্যাশা-মোতাবেক “চণ্ডীরূপী মা-কালীর ব্যাখ্যা তুলে ধরা”র মাধ্যমে উপন্যাসে নারীশক্তির ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প বলা উচিত ছিল (যেহেতু উপন্যাসটি শুরুই হয়েছে পূজামণ্ডপের ভিতরে, জহিরুলের চোখে এই দেবিগণ চেখভের বন্দুক হয়ে প্রতিভাত হয়েছেন)। আর কিছু না-হলেও উপন্যাসটি তাতে কাঠামোবাদী লিবার্যাল ন্যারেটিভ-প্রকল্পের একটা অংশ হতে পারতো।
স্বপ্ন ও স্বেচ্ছামৃত্যু – এই দুইটা প্রসঙ্গ নিয়ে আমার একটা প্রায়-অস্বাস্থ্যকর ফিক্সেশন আছে। এমন গল্প অসংখ্য লিখেছি যেখানে স্বপ্ন আমার মিউজ হয়েছে, কিম্বা কাহিনির মূল সংবাহক হয়েছে। কিছু গল্প আমি স্বপ্নে পেয়েছি। কিছু গল্পের দরজা আমি জাগরণে বন্ধ করে দিয়েছি, কিন্তু স্বপ্ন এসে সেই দরজা খুলে দিয়ে গেছে। স্বপ্ন আমাকে – এবং আমি নিশ্চিত আরো হাজার-হাজার কবি ও কথাসাহিত্যিককে – যেই অমূল্য জিনিসটা দিয়েছে, সেটা হলো একটা নতুন ভাষা, এবং আন্তঃসংযুক্ত একটা পৃথিবী, যেই পৃথিবী একসেট স্বয়ম্ভূ যুক্তির সিস্টেমে বাঁধা, এবং যেই সিস্টেম কখনোই পুনরাবৃত্ত হয় না, অর্থাৎ কপি করার মতো কোনো প্যাটার্ন রেখে যায় না। যেই দুনিয়ায় মেশিনও গল্প লিখতে পারছে – সেই দুনিয়ায় মানুষকে গল্প লিখে যেতে হলে প্যাটার্ন-বুঝতে-পারা মেশিনের বোধকে ধোঁকা দিতে হবে; সেই দুনিয়ায় মানুষ-লেখক আরো বেশি-বেশি করে স্বপ্নের দ্বারস্থ হবে। সেই দুনিয়ায় লেখকের রেয়াজ হবে নিজেকে মনে করিয়ে দেওয়া যে শব্দের বা দৃশ্যের অর্থ স্থির কিছু নয়, অর্থেরও অর্থ হয় – সেই দুনিয়ায় অবশ্য মানুষ-সমালোচক প্রায় থাকবেই না, কারণ প্যাটার্নের অন্বেষণে যাঁরা আছেন, তাঁদের কাজ মেশিন-সমালোচকই ভাল করতে পারবে। দ্যা নর্থ এন্ডের সমালোচনায় প্রতিনিধিত্বশীল প্যাটার্নের অন্বেষণ করতে গিয়ে জহিরুল কিছু বিস্ময়কর মত দিয়েছেন। প্রটাগনিস্টের স্বপ্ন – যেখানে এক বুড়ি আরেক বুড়ি হয়ে ধরা দেয় – তেমন স্বপ্নদৃশ্য নাকি গল্পে-সিনেমায় “বহুব্যবহারে ন্যুব্জ”। তাই? আমি যে জানতাম যতদিন গল্পে লেখকের, কথকের কিম্বা চরিত্রদের চিন্তার জায়গা থাকবে, কথোপকথনের জায়গা থাকবে, আবেগ-অনুভূতি-সংস্কার-বিশ্বাস-চেতনা-রুটিনের জায়গা থাকবে, ততদিন স্বপ্নেরও জায়গা থাকবে! বস্তুত স্বপ্নকে ‘স্বপ্নদৃশ্য’ অভিধায় বাঁধলে, কিম্বা একটা ট্যাকটিকাল প্রকরণমাত্র মনে করলে সৃষ্টিশীল লেখকের চলবে না। চলুন নাবোকভের ইনসমনিয়াক ড্রিমস্কে দুর্বল মনস্তাত্ত্বিক গবেষণা বলে নাকচ করে দেওয়া যাক, কিন্তু ড্রিম ডায়েরি লেখার জন্য নাবোকভকে অন্তর থেকে গড় করে নাই কোন্ রসিক পাঠক? (ক্রমাগত অনুকারের মাধ্যমে ‘বহুব্যবহারে ন্যুব্জ’ প্রপঞ্চ-উৎপাদনের যদি কোনো বৈশ্বিক টপচার্ট থাকতো, বিদ্যায়তনিক গবেষণাদি বরং তার শীর্ষে থাকতো।)
এবার আসি উপন্যাসের ‘আদর্শ কলেবর’ প্রসঙ্গে। জে এম কুট্সির মাস্টারপিস ডিসগ্রেইস ২২০ পৃষ্ঠার উপন্যাস। লেসিং-এর আত্মজীবনীমূলক ডিসটোপিয়ান উপন্যাস দ্য মেমোয়ারস্ অভ আ সারভাইভার ১৯০ পৃষ্ঠার, কাফকার দ্য ট্রায়াল ১৬০ পৃষ্ঠার, হানট্কের অন আ ডার্ক নাইট আই লেফ্ট মাই সাইলেন্ট হাউজ ১৫০ পৃষ্ঠার, মোদিয়ানোর মাস্টারপিস আউট অভ দ্য ডার্ক ১৩০ পৃষ্ঠার, কামুর মাস্টারপিস দ্য আউটসাইডার ১২০, কনরাডের মাস্টারপিস হার্ট অভ ডার্কনেস ৭৫ – পৃষ্ঠাসংখ্যায় নিম্নক্রমে চললাম। (কাফকা আর কনরাড ছাড়া এই দলের প্রত্যেকেই নোবেল পেয়েছেন – এই তথ্যাণুটি আশা করি গুগল না-করেই বিশ্বসাহিত্যের পাঠকেরা জানেন)। অরওয়েল, ক্যালভিনো, রুলফো, হামসুন – একশ’ পৃষ্ঠার আশেপাশে তাঁদের প্রত্যেকের ম্যাগনাম ওপাস সমাপ্ত হয়েছে। বাংলার সবচেয়ে সেরিব্রাল কথাসাহিত্যিকের জায়গায় যিনি আছেন, সেই অমিয়ভূষণ মজুমদারের দুই উপন্যাস (মহিষকুড়ার উপকথা আর মধু সাধু খাঁ) একত্রে দুই মলাটের ভিতরে প্রকাশিত হয়েছে – এবং দুই উপন্যাস মিলে একশ পৃষ্ঠাও নয়। তারাশঙ্করের কবি ১৩০, মানিকের দিবারাত্রির কাব্যও তাই। কমল কুমার মজুমদারের উপন্যাস ২৬ পৃষ্ঠা থেকে ১০৬ পৃষ্ঠা – এই রেঞ্জের ভিতর ওঠানামা করেছে, এবং তাঁর দীর্ঘতম উপন্যাসগুলি তাঁর নিজস্ব এবং নির্গুণ – এই দুই বিচারেই তাঁর দুর্বল কাজ বলে স্বীকৃত হয়েছে (পিঞ্জরে বসিয়া শুক আর অন্তর্জলী যাত্রার মধ্যে ভেদ কী তা রসিকমাত্রই জানেন)। জানি না সমালোচকদের পাঠ্যতালিকায় এঁরা স্থান পান কিনা; স্থান না পেলে তাঁরা কাদের লেখা পড়ে রসজ্ঞ হলেন, তাও জানি না – তবে দ্যা নর্থ এন্ডের ক্ষুদ্র কলেবরের কারণেই (১২০ পৃষ্ঠা) জহিরুল সাব্যস্ত করেছেন যে এটিকে উপন্যাস নয়, বরং ‘বড় কলেবরের ছোট গল্প’ বলা যায়। আমার পরবর্তী উপন্যাস – যার প্রস্তুতিমূলক গবেষণায় আমি ইঙ্গিত পাচ্ছি যে ছয়শ পৃষ্ঠার কমে এই গল্প হয়তো বলা যাবে না – তার কলেবরের কারণে নয়, বিষয়বস্তুর কারণেই তার লিটারারি পরিণতি নিয়ে আমি সন্দেহমুক্ত নই। তবে পৃষ্ঠা গুনে নম্বর দেওয়ার পেডাগজিক ঐতিহ্যের যে ধারা বাংলায় বাহিত হচ্ছে – জানি তার দায় শুধু ব্যক্তি-সমালোচকের নয় – আশা জাগে, তাতেই বুঝি একটা ঢাউশ সাইজের উপন্যাস ‘উৎরে যাবে’।
সমালোচনার ভাষা নিয়ে এবার কিছু বলতে হয়। জহিরুলের গদ্য বিক্ষিপ্ত – তত্ত্ব দিয়ে গাঁথার সৎ চেষ্টা আছে, কাঠামোতে যত্নের অভাব যদিও চোখ এড়ায় না – প্রসঙ্গ থেকে প্রসঙ্গান্তরে নন-ডেলিবারেট উল্লম্ফন প্রচুর। বাগরীতি ক্লিশে। শুরুর তাত্ত্বিক আলোচনাটি, পাঠপ্রতিক্রিয়ার অংশটি থেকে এতই বিযুক্ত, যে মনে হয়েছে জেনেট-প্রণীত চেকলিস্টের চোথা হাতে নিয়ে বসে “মিলতেই হবে” পণ করে উপন্যাসটি পড়েছেন জহিরুল, কিন্তু সেই কাজে খুব লাগসই বিশ্লেষণের সন্ধান আমাদেরকে দিতে পারেন নাই। (রাহাত চরিত্রটি নাকি তার বান্ধবীর চোখ দিয়ে ‘বৃত্তাকারে সামনে আসে’, আরেকবার তার বউয়ের চোখ দিয়ে ‘বর্গাকারে সামনে আসে’ – এবং কোনাগুলির কারণে বর্গটা বৃত্তটার মধ্যে ‘খাপ খায় না’। আমি বুঝলাম, সমালোচক প্রথমত প্রতিটি চরিত্র বিষয়ে অন্য চরিত্রদের স্বাধীন দৃষ্টিকোণ প্রত্যাশা করেন, দ্বিতীয়ত প্রতিটি দৃষ্টিকোণের আর্থসামাজিক প্রতিনিধিত্বশীলতা দাবি করেন, তৃতীয়ত সেই দৃষ্টিকোণগুলি যেন অতিরিক্ত ‘সনাতনী’ না-হয়ে পড়ে সেই চাহিদা ব্যক্ত করেন, এবং চতুর্থত সেই দৃষ্টিকোণগুলির তুলনামূলক জ্যামিতিক আকার-বিষয়েও স্পষ্ট অভিমত ধারণ করেন, কারণ নইলে জেনেটের উচ্চতর সাহিত্যালোচনায় ‘খাপ’ নামক যে স্থিতিমাপকটি রয়েছে, চরিত্রেরা সেটা ঠিক খেয়ে ওঠে না)। এমন হতে পারে, দ্যা নর্থ এন্ড-বিষয়ে তাঁর পূর্বনির্ধারিত বায়াস, পাঠকালীন ওভারসাইট ও চর্চাগত খামতিগুলিকে একটা অ্যাকাডেমিক গিলাফে ঢাকার কিছু তাড়া ছিল তাঁর। দ্যা নর্থ এন্ড পাঠে আনন্দবিধান না হওয়ায় তাঁর সেই প্রয়াস সিদ্ধ হয়েছে।
প্রসঙ্গত, আনন্দ বিষয়ে একজন নোবেল-বিজয়িনী পূর্বজা বলেছিলেন, “বই পড়ার একটামাত্র উপায় আছে – যে বই পড়ে আনন্দ পাচ্ছ না, সে বই পড়ো না”। আরেক পূর্বজ কাব্যসমালোচনা প্রসঙ্গে ১০৩ বছর আগে এক বক্তৃতায় বলেছিলেন, “পূর্ব্বাচার্য্যেরা বলে গেছেন “মধুমিচ্ছন্তি ষটপদাঃ”। এ কথা একালের সমালোচকদের সম্বন্ধে খাটে না। কেননা বাক্যের মধুচক্র (মৌচাক) রচনা করা কাব্যের উদ্দেশ্য হতে পারে, কিন্তু সমালোচনার উদ্দেশ্য হচ্ছে বোলতার চাক তৈরি করা। এ থেকে প্রমাণিত হয় সেকালের লোকেরা নিতান্ত স্থূলদর্শী ছিলেন। তাঁরা খুঁজতেন রূপ, আমরা খুঁজি ছিদ্র”। এই বক্তব্যের এসেন্সের সাথে খানিকটা একমত হয়েও আমি মনে করি একটি বই পড়ে আনন্দ না-পাওয়ার অধিকার একটি বই লেখার অধিকারের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ অধিকার।
সাহিত্যপাঠ অত্যন্ত পরিশ্রমের কাজ। ক্রমাগত স্থির অর্থের খোঁজে যেই পাঠ, সেই পাঠে পরিশ্রমের উপর যোগ হয় অবশ্যম্ভাবী বিফলতার ভার। শুনেছি জহিরুল দ্যা নর্থ এন্ড আটবার পড়েছেন। আর এতকাল কিনা আমার জীবনলব্ধ জ্ঞানের সারাৎসার ছিল – “নোবডি গিভস্ আ ড্যাম”! মানতেই হচ্ছে, আমার জাগতিক সম্ভাব্যতার সংজ্ঞার রেঞ্জ জহিরুল প্রসারিত করেছেন। জেমস জয়েসের ফিনেগ্যান’স ওয়েইক কিম্বা ভার্জিনিয়া উল্ফের অরল্যান্ডো কিম্বা টি এস এলিয়টের দ্য ওয়েইস্ট ল্যান্ড কিম্বা কমল কুমারের গোলাপ সুন্দরী পড়ে যে আনন্দ আর যে প্লেফুলনেসের খোঁজ পেয়েছি, যে সরস গদ্য লিখতে চেয়েছি, আগুন-লেগে-যাওয়া ঘাসের জমির মতো যে কনফ্রন্টিং, নির্ভাণ, র্যাপচারাস সাহিত্যকে আবাহন করতে চেয়েছি, তার উল্টাপাশে অবিরত নিরানন্দ পাঠের যে দর্শন নির্জন বসে আছে, তা নিয়ে আমাকে আরো চিন্তা করার প্রণোদনা দিয়েছেন তিনি। এইরূপে, সমালোচনা রূপ না-খুঁজুক, সমালোচনার রূপ আমরা আজ খুঁজতেই পারি।
দ্যা নর্থ এন্ড: সমকালীন উপন্যাস, প্রথম প্রকাশ ফেব্রুয়ারি ২০২০, পাওয়া যাচ্ছে ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেডে