মঙ্গলবার, ১৩ জুলাই ২০২১, ১২:২৪ পূর্বাহ্ন
মোবারক খান হৃদয়-এর কবিতা
ইনবিটুইন
আমার সকল ভাবনার ভিতরে ইদানীং একটা রাজহাঁস ঢুইকা পড়ে,
বিস্তৃত মাঠ মনে কইরা গলা বাড়ায়া দৌড়াইতে থাকে,
তার কর্কশ ডাকে ভাবনায় ছেদ পড়লে কিছুটা বিরক্তিতে মনোযোগ সরায়া নিই।
আকাশ-টাকাশ নিয়া কিছুটা ভাবি।
কিংবা ভাবি গাছেরা হাঁটতে পারলে পৃথিবীর মানচিত্র কেমন হইতো!
এইসব নানাবিধ ভাবনা আইসা জড়ায়া ধরে মরিচার মতোন।
যদিও আগের ভাবনার কথা মনে হইলে ঐদিকে তাকাই,
দেখি ঐখানে তখন একটা মরুভূমি, কোন উট নাই।
এইভাবে বুকের মধ্যে মরুভূমি নিয়া ঘুমায়া যাই।
আর ক্রমাগত আমার ঘুমের মধ্যে
কোথাও একটা রাজহাঁস খালি ছটফট করতে থাকে।
আরও কিছু অগোচর
দৃশ্যের পর দৃশ্য হয়ে দাঁড়িয়ে আছি।
এই বর্বর জীবন নিয়ে আমি সন্ধ্যার শিশিরের পাশে বসে হাসাহাসি করেছি অনেক।
মাথাভর্তি সাদা পায়রার চিৎকার আমার
পেরোবার মতো কোন মানচিত্র নেই জেনেও অসংখ্য রাত আমি শামুকের মতো হেঁটে-হেঁটে পৌঁছে গেছি হাসনাহেনার প্রার্থনারত ফুলের পাশে।
তারপর অনেক হয়েছে ভেবে ফিরে এসেছি।
কুয়োর পানির মতো নিবিড় নিঃসঙ্গতা শরীরে জড়িয়ে ঘুমিয়ে গেছি থতমত ধানক্ষেতের ‘পরে।
দেখেছি, গলায় ছলছল হাম্দের সুর তুলে, গোলাপি হাঁসেরা মার্চ করতে করতে পেরিয়ে গেলে পৃথিবীর দেয়াল
বহেড়ার বনে কোথাও একটা ঝড় বয়ে যায়।
দৃশ্যের পর দৃশ্য হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি।
মর্মরিত গানের মতো তুমি, নিদারুণ বেজে উঠো শিরায় শিরায়।
সহজপাঠের গণিত
অঙ্কের স্যার বই দেখিয়ে জিজ্ঞেস করেন, এখানে দুইটা আপেল এখানে তিনটা আপেল।
মোট কয়টা আপেল?
দুনিয়ার সবচাইতে কঠিন প্রশ্নটির সম্মুখীন হয়ে আমি বোবা বনে যাই।
অঙ্কে বরাবরই কাঁচা হওয়ায় আমি সর্বোচ্চ মনোযোগে বইয়ের আপেলগুলার দিকে তাকায়া থাকি।
কোনভাবেই দুই আর তিনকে একসাথে করতে না পারার শাস্তি হিসেবে স্যার কানে ধরে উঠ্-বস্ করায়।
রাতে খেতে বসলে আমি আব্বারে জিজ্ঞেস করি, দুইটা আপেল আর তিনটা আপেল মিলে কয়টা আপেল হয়?
আমার আব্বাও অঙ্কে কাঁচা।
ছেলের অঙ্কের সমাধান করতে না পারার লজ্জা নিয়ে আব্বা কেবল চুপচাপ ভাত খাইতে থাকে।
আমি খেয়ে উঠে চুপচাপ খাতায় একটা আপেল গাছ আঁকি।
তারপর যোগ করতে বসলে বুঝি, দুইটা আপেল আর তিনটা আপেল মিলে দুইটা শিং মাছ হয়।
সেই শিংমাছ দুইটা সাহস করে আব্বা কিনে ফেলে।
আম্মা ইদের চাঁদ দেখার মতো একটা বাৎসরিক আনন্দ নিয়া সেই শিংমাছ কাটে।
শিংমাছের জোছ্নায় আমরা ভাত খাই।
দুঃখের পাশে আম্মা যেমন
১
আমাদের নদী-সংসারে আম্মা একটা সাঁকো।
আমাদের সাঁতার না-জানার ব্যর্থতা ঢেকে যিনি মচ্মচ্ করে ভেঙে যাচ্ছেন জীবনভর।
২
নানাজান ছিলেন মস্তবড় জাদুকর। লোকজন সমূহ বিস্ময় নিয়ে নানাজানকে দেখতেন, কীভাবে একটা লাঠির ওপর ভর দিয়ে শূন্যে তিনি হাত-পা ছড়ান। নানাজান লাঠি দিয়ে টোকা দিয়ে কাগজকে ফুল পাখি পাথর ইত্যাদি বানিয়ে ফেলতে পারতেন নিমেষেই। আম্মা আমাদের সেইসব গল্প বলেন। আমরা টের পাই,কাগজ হতে না পারার দুঃখ নিয়ে আম্মার বুকের ভেতর মরে যাচ্ছে একটা পাখি।
৩
ভাতের মধ্যে চুল দেখলেই আম্মার উপর রাগ হইতো।
দুনিয়ার বিরক্তি নিয়া আম্মার দিকে তাকাইতাম।
আমার বিরক্তি দূর করতে তাই বহুবছর ধরে আম্মা সন্তর্পণে ভাত বেড়ে দেয়, মাটিতে পুঁতে রাখা বিস্ফোরক মাইন খোঁজার মতো করে আম্মা ভাতের মধ্যে তাঁর অবাধ্য চুল খোঁজে।
ইদানীং তা-ও দেখি আম্মার চোখ ফাঁকি দিয়া একটা দুইটা সাদা চুল প্লেটের মধ্যে ক্লান্ত হয়ে প’ড়ে থাকে ভাতের পাশে।
আমি সাদা প্লেটের দিকে তাকায়া থাকি।
দেখি আম্মার বয়স বেড়ে যাওয়ার দুঃখ নিয়ে পৃথিবীটা হাহাকার করতে করতে আমার প্লেটে এসে টুকরা টুকরা হয়ে ভেঙে যাচ্ছে।