রবিবার, ০৪ জুলাই ২০২১, ০৯:৪০ অপরাহ্ন
প্রাগের অন্তিম গোধূলী
অনেক অনেক দিন এমনকি নিয়মিত ডায়েরিটুকুও লেখে না জোসেফ কে.। অথচ ভেতরে বহু বহু কথা জমা হয়ে আছে। সেসব বাদ দিয়ে সে ফরমায়েশ মত অন্যদের গল্প লিখছে। নিজের কথাটিই লিখছে না। কিন্তÍ আজ সন্ধ্যাতেই পাড়ায় গুঞ্জন শোনা গেল যে সোনিয়ার বাগদান হতে চলেছে। কয়েক মূহুর্ত বা অনেকটা সময়ই কেমন থমকে গেল জোসেফ কে.। যদি আজ এত এত দিন পরে সোনিয়া সিদ্ধান্ত নেয়, সেই অপরাধ বা পাপ কি পুরোটাই জোসেফের নয়? কম ত‘ অপেক্ষা করেনি সোনিয়া। পৃথিবীর কোন মেয়ে এত নিশ্চুপ, বিনা দোষে এত দণ্ড নিয়ে এত দীর্ঘ অপেক্ষা করে না। চব্বিশটি বছর! ভাবা যায়? অথচ জোসেফ কে. নি:শব্দে তাকে শুধু কষ্টই দিয়ে গেল! কিন্তÍ এমনটা তো হবার কথা ছিল না। একই তুলনামূলক ভদ্রস্থ ইহুদি পাড়ার ছেলে-মেয়ে তারা। কে অবশ্য ছোটবেলায় খেলতো সোনিয়ার কয়েকজন বান্ধবীর সাথে। সেই মেয়েগুলো একটু বড় হতেই বাবা-মা’র সাথে পাড়ি জমালো অন্য দেশে। ইহুদিরা যেমন কোথাও বেশি দিন থাকে না। ভাগ্যের সন্ধানে এই দেশ থেকে ঐ দেশে পাড়ি জমাতেই থাকে। দেখতে দেখতে গোটা প্রাগ কেমন ইহুদিশূন্য হয়ে এলো! তা স্কুল জীবনের শেষের দিকে একটি বিজ্ঞান মেলায় জোসেফ দেখেছিল সোনিয়াকে। ভুলেও গেছিল। তবে বড় হয়ে ভার্সিটিতে পড়তে পড়তে বাসায় যখন জোসেফের ঠিক উপরের ভাইটির এক খ্রিষ্টান মেয়ের সাথে শহর জুড়ে গল্পের বিষয় প্রেম নিয়ে মহা অশান্তি, জোসেফ তখন সোনিয়াকে দূর থেকে দ্যাখে আর ভাবে যে দিমিত্রফের মত সে কখনো হবে না। সোনিয়াকে সে বিয়ে করে শান্ত গৃহস্থের জীবন যাপন করবে ঠিক বড় ভাই এ্যালেক্সেইয়ের মত। কিন্তÍ দিমিত্রফ সারাক্ষণই জোসেফকে কুমন্ত্রণা দেয়, ‘বাসায় কেউ আমার প্রেমটা মেনে নিতে চাচ্ছে না। ইহুদি মেয়ে বিয়ে করে কি করবি? সারা জীবন ইহুদি পাড়াতেই পড়ে থাকবি? লোকে সারাক্ষণ মনে করাবে, তুই ইহুদি!‘
‘তা আমরা তো ইহুদিই!‘ অবাক হয়ে বলতো জোসেফ।
‘এজন্য তোকে আমার অসহ্য লাগে। আবার নাকি তুই উঠতি লেখক! বড় বড় সালোঁগুলোর সাহিত্যকর্ত্রীরা তোকে সেধে ডেকে গল্প পড়ার আসর জমাচ্ছে! শোন- সংখ্যাগুরুর সাথে না মিশে, তার সাথে না একাত্ম না হলে তোর জীবনেও কিছু হবে না- গোঁয়ার ভূত কোথাকার!‘
তখনো পর্যন্ত দিমিত্রকে খুব ভালবাসত জোসেফ। দিমিত্রফের জন্য সে জীবন দিতে পারে। দিমিত্রফের কথায় মানুষও খুন করতে পারবে অবলীলায়। যদিও সে জানে দিমিত্রফ একটু যেন কেমন। নানা বিষয়েই। বড় ভাই এ্যালেক্সেই যেমন মোজেসের ঠিক পরের মানুষটি, দিমিত্রফ তেমন নয়। তবু অল্প বয়সেই লুকিয়ে সিগারেট খাওয়া, খ্রিষ্টান পাড়ার মেয়েদের সাথে নাচতে যাওয়া দিমিত্রফ সারা দিনই বাধা-নিষেধের পৃথিবীর ওপারে জোসেফ কে.-কে টানছে। কিন্তÍ জোসেফ পুরোপুরি সেই পৃথিবীতে যেতেও পারে না। এ্যালেক্সেই যেন খাঁটি ইহুদি পরিবারের ধর্মনিষ্ঠ পুত্র হিসেবে জোসেফের ঘাড়ে পেছন থেকে একটা হাত দিয়ে রেখেছে, ‘কখনো ধর্মভ্রষ্ট হবি না, জোসেফ! জীবন দিয়ে হলেও এই তালমুদ, এই সিনাগগ- এই সবকিছু আমাদের রক্ষা করতে হবে। আমরা কখনো নিজেদের অপবিত্র হতে দিতে পারি না!‘ কে যেন এই দুই ভাইয়ের দুই নির্দেশের ভেতর আজীবন দাঁড়িয়ে থাকলো। কাউকেই সে অনুসরণ করতে পারল না পুরোপুরি।
তাই রোজ তখন রাতে দিমিত্রফের সাথে সে বাড়ির বড়দের হয়ে ঝগড়া করে যেন সে শেষমেশ কোন খ্রিষ্টানকে বিয়ে না করে, এদিকে ভার্সিটি পুরো পাশ না করতেই প্রাগের বিখ্যাত সাহিত্য সাঁলোগুলোতে পঠিত কে-র একটা/দু‘টো গল্পের সুনামে প্রাগের রূপসীতমা খ্রিষ্টান তরুণীরা তার পাশে ঘোরাঘুরি শুরু করেছে। অথচ দিমিত্রফের তুলনায় কিছুই না জোসেফ দেখতে। লম্বায় পুরো পাঁচ ফুট ছয়ও নয়। পাঁচ সাড়ে পাঁচ। হ্যাংলা-পাতলা। খানিকটা ক্ষয় কাশির সমস্যা আছে এবং সেটা সে নিজেই সবাইকে বলে বেড়ায়। এর ভেতর যদিও নিজে থেকে একদিন সোনিয়াকে পার্কে দেখে নিজে থেকে এগিয়ে গেছিল, কে আর অনেকটা সময় গল্প করেছিল…পার্ক থেকে সামনে খানিকটা পথ হেঁটে সোনিয়াকে জোর করে বলে-টলে একসাথে কফিও খেয়েছিল…এরপর থেকে সোনিয়া তাকে পাড়ার পথে দেখলে একটু দাঁড়িয়ে পড়ে বা লাজুক হাসে…কিন্ত কি যে হলো জোসেফের…সে নিজেই সোনিয়াকে এড়িয়ে যেতে থাকলো! বয়স মাত্র তেইশ তার। যদিও তাদের পরিবারে বড় ভাইয়ের আগে ছোট ভাইয়ের বিয়ে হয় না আর হতচ্ছাড়া দিমিত্রফ খ্রিষ্টান মেয়ের সাথে প্রেমের কারণে ঠিক কবে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেবে তা জিহোভাও জানেন না আর তাই বাবা-কাকা-জ্যাঠা এবং বাড়ির বড় কাজিন বা এ্যালেক্সেইয়েরও জোসেফ এখন আগেই বিয়ে করে বসলেও আপত্তি নেই…কিন্তু…এখনি…এখনি কি সে বিয়ে করবে? সেই এ্যালেক্সেইয়ের মত সকাল থেকে ব্যবসার কাজ এবং তাতে একটি অলস বউ তার…কাকি-জ্যাঠি-মা সবাই দেখতে দেখতে বুড়ি হয়ে যাচ্ছেন এবং এ্যালেক্সেই অলস বউয়ের যন্ত্রণায় ঘরের কাজও প্রচুর করে নিজের হাতে আর বাচ্চা দু‘টোকেও বড় করে…এত খাটুনির জীবনে এখনি কি সে ঢুকে যাবে? তারপর মাত্রই কিনা প্রাগের সালোঁগুলোয় তার গল্পের সুনাম ছড়িয়ে পড়ছে। প্রাগের সবচেয়ে বড় সালোঁর সাহিত্যকর্ত্রী মাদাম গোলুবেভা তখনো তাঁর প্রথম বিয়ের বৈধব্যের পর দ্বিতীয় বিয়েতে আবদ্ধ হননি। জোসেফ কে-র মাত্র চোদ্দ বছরের বড়। সবাই বলছে বিশেষ সুদৃষ্টি পড়েছে তাঁর কে-র উপর। তরুণ লেখকেরা তো ঈর্ষায় পুড়ে মরছে যে মাদাম গোলুবেভা কবে না জোসেফকে বিয়ের প্রস্তাবই দিয়ে বসেন! কে অবশ্য মাদাম গোলুবেভার প্রেমে পড়েনি। তবে ইহুদি তরুণ হিসেবে একজন বড় সাহিত্যকর্ত্রী অথচ খ্রিষ্টান নারীর সাথে যতটা দূরত্ব রেখে সৌজন্যমূলক ব্যবহার করা যায় সেটা করে চলেছে। সেই শুরু হলো অকারণে সোনিয়াকে এড়ানো। এখনি…এই বয়সেই…সে সংসারের কঠিন দায় নিতে পারবে না।
আজ পেছন ফিরে দেখলে মনে হয় সেই সময়েই সে যদি সোনিয়াকে এড়ানো শুরু না করতো, তবে আজ তাদের সুদৃঢ় সংসার জীবন হতে পারতো। যাহোক, সারা দিন ইন্স্যুরেন্স কোম্পানীর কাজ আর সন্ধ্যার পর সালোঁগুলোর সাহিত্য সভা আর রাতে লেখার টেবিল মিলে অদ্ভুত জীবন হয়ে দাঁড়ালো তার। সবাই জানে যে কে একা বা খ্যাতি থাকলেও অথবা খুব কুরূপ না হলেও সে ইচ্ছে করেই একা। না সে কোন ইহুদি তরুণীর সাথে অঙ্গীকারাবদ্ধ, না আছে তার কোন খ্রিষ্টান প্রেমিকা। তবে অনেক বন্ধু-বান্ধবী আছে তার। তাদের সাথে সে হৈ চৈ করে। সেটা তো আর কোন প্রেম নয়। এমন বছর কয়েক যেতে না যেতেই বন্ধু-বৃত্তের বাম, বিপ্লবী নারী জোয়া দ্যুনিয়েভস্কয়া করে বসেছিল সেই অবিশ্বাস্য কাণ্ড। তেমন কিছুই নয় হয়তো। কিন্তু লেখক জোসেফ…হয়তো লেখক বলেই…অন্য সবার মত হিসাব-নিকাশ না কষে, এক তুষার ঝড়ের সন্ধ্যায় একটি কাফেতে অন্য বন্ধুরা না আসায় এবং হুট করে জোয়ার সাথে টেবিলে একসাথে মুখোমুখি পড়ায়…দীর্ঘাঙ্গী, খানিকটা শ্যামাভ তবে কোঁকড়া কালো চুল আর গভীর কালো দুই অতল চোখের জোয়া যখন লজ্জারুণ হয়ে মাথা নিচু করে বসে রইলো পনেরো মিনিট আর সেই পনেরো মিনিট জোসেফের জীবনে এক অনন্ত সুন্দর রূপকথা হয়েই রইলো পরবর্তী ১৮ বছর ধরে জোয়ার দূর্বোধ্য ও লাগাতার মন্দ আচরণের পরেও। লেখক বলেই জোসেফ যেন আটকা পড়ে গেল বাইরে তুষার ঝড় আর কাফের ভেতরে অন্য বন্ধুরা না আসায়, হুট করে মুখোমুখি হয়ে যাওয়া অমন শক্ত ও জেদি, কয়লাখনির শ্রমিকদের সাথে সেধে কাজ করা অথচ স্বচ্ছল খ্রিষ্টান পরিবারের মেয়ে জোয়ার সেই লজ্জিত, অবনতমুখী পনেরো মিনিটের রূপকথায়। অথচ, উপর থেকে সেদিন শক্ত ছিল কে। মাথায় হাতুড়ির বাড়ি পড়ছে। ইহুদি ছেলে হয়ে এই খ্রিষ্টান মেয়ের ফাঁদে পড়িস না! পালা! অবিচল থেকে স্বাভাবিক রাজনীতির আলাপ চালিয়ে গেলো কে.। ধীরে ধীরে জোয়া ধাতস্থ হয়ে উঠলে দু‘জনেই কাফে থেকে বাইরে বের হয়ে এলো তবে সেই সন্ধ্যার পর থেকে জোসেফ জীবন নিয়ে কি করে উঠবে ভেবে পেল না।
জোয়া অবশ্য খুব জেদি মেয়ে। যে বামপন্থী দলের সে সদস্যা, তারা বামের মোড়কে ডান বা বাম হয়েও গুরুতর ইহুদি-বিদ্বেষী বা সংখ্যালঘু বিদ্বেষী বলে অন্য বাম দলগুলোই তাদের নিয়ে পরিহাস করে। জোসেফও সেটা জানতো এবং জোসেফ সচেতন ভাবেই খানিকটা জায়োনিস্ট। দিমিত্রফের মত বামের নামে খ্রিষ্টান তোষন এবং খ্রিষ্টানের সাথে বিলীন হবার নীতি তার নীতিও নয়। পরবর্তী এক সপ্তাহ খুব তুষার ঝড় চললো আর তারই ভেতর এ শহরে ইহুদিদের পক্ষে কথা বলা এক খ্রিষ্টান লেখক খুন হলেন। যেদিন প্রথম রোদ হলো, জোসেফ একটি লেখা লিখলো সেই লেখকের হত্যায় রেগে গিয়ে। সেই লেখার বিরুদ্ধে বইয়ের দোকানের সামনে জোয়া এসে তার সাথে ঝগড়া করলো। তিক্ত হয়ে উঠলো সব কিছু। তবু জোয়াকে দেখতে সেই বইয়ের আড্ডায় যাওয়া ছাড়লো না সে। জোয়া আগের মত সহজ ভাবে এসে আর আড্ডা জুড়ে দেয় না, দূরে দূরে থাকে আবার খানিকটা বিখ্যাত জোসেফের পাশে অন্য মেয়েদের এগিয়ে এসে কথা বলাও তীব্র অপছন্দ তার। আসলে জোয়া যে কি চায় বা চেয়েছিল সেটা সে বুঝেই পায়নি কখনো। এর ভেতরেই এসেছিল প্রাগের এক বিখ্যাত পরিবারের মেয়ে নাতালী যে আশৈশব প্যারিস আর মিউনিখে জীবন কাটিয়েছে। নাতালী এসে মাদাম গোলুবেভার একটি সাহিত্য আসরে জোসেফের কয়েকটি গল্পকে ‘ফ্ল্যবেয়ার ত‚ল্য‘ মন্তব্য করাতে না পুরো প্রাগ জুড়ে ঢি ঢি পড়ে গেল। নাতালী জোসেফকে বিয়ে করতে চাইছে বা দু‘জনের দৈহিক সম্পর্ক হয়েছে থেকে শুরু করে জনতার অদ্ভুত জল্পনা ও রটনার শেষ রইলো না। ইহুদি পাড়াতেও ফিসফাস শুরু হলো। অথচ নাতালীকে ভাল চিনতও না সে তখন। সোনিয়ার মত কম কথার মেয়েও একদিন তাকে জিজ্ঞাসা করে বসলো যে নাতালী অমন লেখা তাকে নিয়ে কেন লিখেছে? জোয়া ত‘ কথাই বলে না আজকাল। সোনিয়া শীতল, জোয়া অকারণে মন্দ আচরণ করে। এরকমই চলে যায় বেশ কয়েক মাস। রাগের মাথায় হুট করে এক বা দু‘দিন নাতালীর সাথে কফি খেল জোসেফ কে. এবং দ্বিতীয় দিনেই নাতালী জানালো যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে তার ধনাঢ্য প্রেমিক আসছে যাকে সে বিয়ে করে চলে যাবে। মাঝখান থেকে এই দু‘দিনের কাফেতে বসার জন্যই সদা সতর্ক জোসেফ কে-র নামে বাজারে যত রকমের খারাপ কথা চলা সম্ভব, ছড়িয়ে পড়তে বেগ পেল না। জীবন বেশ প্রহসন, তাই না?
তারপরের গল্পটুকু আপনারা সবাই জানেন বা এটুকুও আপনারা অনেকবার শুনেছেন। জীবনের শুরুর বছরগুলো এসব কিছুই তোয়াক্কা না করলেও জোসেফ কে. আজকাল এই গল্পগুলোই বারবার যেন বলে। লোকে তাকে নিয়ে হাসলেও। এদিকে বেশ কয়েক বছর আগে চুপচাপ, অন্তর্মুখী সোনিয়া যে একটি খ্রিষ্টান ছেলের সাথে জড়িয়ে পড়েছিল সেটা সে জানতও না। জানালো আর একটি ইহুদি ছেলে। শুরুতে তার বিশ্বাসও হয়নি অতটা। তবে প্রেমটা নাকি ভেঙে গেছিলো। এজন্য কি সোনিয়া তার সাথে আবার যোগাযোগ করলো? অথচ নাতালী চলে যাবার পরও সোনিয়াকে সে ভুল যেন না বোঝে সে চেষ্টা করেছিল। সোনিয়া এড়িয়ে গেছে। জোয়াও তাই। গত কয়েক বছর হয় জোয়া অবশ্য লেটার বক্সে তাকে প্রায়ই অনামা প্রেরক হিসেবে ‘লম্পট-দুশ্চরিত্র-ভণ্ড-দেহ বিক্রি করে সাহিত্য খ্যাতি পাওয়া‘ জাতীয় নানা সম্বোধনের বিচিত্র সব চিঠি পাঠাতো। দোষের ভেতর বহুদিন পর জোয়ার সাথে দেখা হওয়ায় সে সব জড়তা ভেঙ্গে সামনে এগিয়ে গিয়ে ভুল ভাঙানোর চেষ্টা করেছিল। জোয়া একটি কথা না বলে সরে যায় কিন্তু পরের দিন থেকেই জোসেফের লেটার বক্সে হামলা হতে থাকে। ভাগ্যে গত বছর শহরে যখন খুব উদরাময় ছড়িয়ে পড়েছে আর বহু বছর পর নাতালী এসেছে এদেশে, একটি বারে এক সন্ধ্যায় নাতালী আর জোয়া দু‘জন দুই টেবিলে থাকা অবস্থায় খানিকটা মাতাল অবস্থায় নাতালী নাকি সবাইকে শুনিয়ে বলে উঠেছিল যে কোথাকার কোন খনি মজুরদের সাথে কাজ করা এক মহিলার জন্য জোসেফ কে তার কাছে এলো না কোনদিন! এই ক্রুদ্ধ স্বগতোক্তি শুনে ফেলেছিল জোসেফের খুব কাছের বন্ধু, জীবন রসিক রচেস্টার। আজ এত বছর পর (নাতালীর কাছ থেকে অযাচিত সেই সাহিত্যিক হিসেবে বন্দনা পাবার দোষেই কি জোয়া বা সোনিয়া কেউ থাকেনি তার পাশে) জোয়ার কাছে ফিরে যাবার কোন অর্থই হয় না। তবে এই যে অশালীন গালাগালি ক্রমাগত কয়েক বছর অনামা পত্রবাহক হিসেবে করে গেছে অথচ প্রেম করছে একাধিক সমাজের উচ্চ পদস্থ ব্যক্তির সাথে…সেই জোয়া অন্তত: ক্ষমা চাবে ভেবেছিল। তাহলেই আর জোসেফের দু:খ থাকত না। জোয়া কিন্তÍ ক্ষমাও চায় না। উল্টো দোষারোপ করে চিঠি পাঠায়, ‘হয়তো তুমি শয্যায় যাওনি, তবে ফ্লার্ট করেছো।
এক খুব ধনাঢ্য শিল্পপতি যিনি বহু বছর বাইরে কাটিয়েছেন, বিবাহিত এবং এক কন্যার জনক, কয়েক বছর হয় প্রাগে এসে হুট করেই লেখক হিসেবে খুব আত্মপ্রকাশ করেছেন। সালোঁগুলোতে এখন তাঁর লেখাই নিয়মিত প্রকাশিত হয়। জোয়া এবং তাঁর পার্টি খুব প্রমোট করেছে তাকে। জোয়ার সাথে তাঁর হাল্কা অনুরাগ বা সখ্যতার কথাও কেউ কেউ বলে। তবে ভদ্রলোক খুব বিচক্ষণ। তিনি জোয়াদের দলের সুযোগগুলো নিচ্ছেন তবে তাদের পক্ষে বিশেষ উচ্চ-বাচ্য করছেন না। হালে অবশ্য জোয়াদের দলের কোন একটি বিষয় তিনি উপন্যাস লিখছেন। মাদাম গোলুবেভার সালোঁতে ধারাবাহিক সেটা পড়া হচ্ছে এবং পরে বই আকারেও বের হবে। একটি বামের মোড়কে ডানপন্থী খ্রিষ্টবাদী জোয়ারা এমনিতেই জোসেফ কে-কে দেখতে পারেনা। মাদাম গোলুবেভাও কে-র প্রতি রুষ্ট। কে-র এমন একা ইহুদি থেকে যাওয়া, সুযোগ পেয়েও ধর্মান্তরিত না হওয়া বা সামান্য ইন্স্যুরেন্স কোম্পানীর চাকুরে থেকে যাওয়াসহ যে কোন কারণেই হোক। আজ বহু বছর হয় গোলুবেভা বা তাঁর সাহিত্য আসরের সাথে কে-র কোন যোগাযোগ নেই। তাকে বছরে এক/আধবার ডাকা হয় অবশ্য গল্পপাঠের জন্য। তবে সে যায় না। সালোঁগুলোতে এখন সব নতুন বিশেষত: শিল্পপতি বা প্রচন্ড অর্থ-বিত্তশালী, নবাগত লেখকদের ভিড়। বহুদিন হয় ঘরকুনো হয়ে আছে জোসেফ কে। তাতে দু‘বছর ধরে উদরাময় আর এক অদ্ভুত তাপপ্রদাহে লোকে প্রায় ঘরবন্দী। আর এইসব নাতালী-জোয়া-সোনিয়াদের ভেতর মহামারীর বছর তিনেক আগে একটি বাণিজ্যমেলায় মিনিট পাঁচেকের জন্য দেখা হওয়া ও নিউইয়র্কের প্রবল ধনাঢ্য ইহুদি যুবতী, হাসি-খুশি ও অদ্ভুত সরল আনা তাকে পরবর্তী তিন বছর প্রায়ই ফোন করেছে। তবে প্রাগে নেই নেই করেও তার এই সাহিত্য জীবন বা চাকরি ছেড়ে অমন কোটিপতি বাবার কন্যা আনার কাছে সে যাবে কিনা সেটাও মনস্থির করতে পারেনি। সোনিয়া…সোনিয়াকেই কি সবচেয়ে অবহেলা করা হয়েছে তার? গত এক বছর হয় আনাও অদ্ভুত নীরব। গত বছর শেষ টেলিগ্রাফে তার মা মারা গেছে বলে জানা গেছে।
এরই ভেতর গত সন্ধ্যায় পাড়ায় গুঞ্জন ছড়ালো যে সোনিয়া বিয়ে করতে যাচ্ছে। কাকে? সেই খ্রিষ্টান ছেলেটিকেই? যার সাথে মাঝখানে তার প্রেম হয়েও ভেঙ্গে গেছিলো? হোক। সাহিত্য কীর্তি, একাকী জীবন বা যে কোন মোহেই হোক, সোনিয়াকে সে কম কষ্ট দেয়নি। আবার এটাও সত্যি…কি জোয়া, কি নাতালী অথবা কি আনা…সবার ক্ষেত্রেই সেই পাড়ার মেয়ে সোনিয়ার মুখটিও তার সামনে এসে দাঁড়াতো। তবে সোনিয়া নানা কারণেই আজকাল একটু জটিলও বটে। সরলতম ছিল আনা। নাতালী সরল ছিল তবে সে কি একটু লোভী? বলতেই হয়। নিউইয়র্কে কোটিপতি বরের কাছে গতবছর আবার ফিরে গেছে নাতালী- মারীতে কয়েক মাসের বন্দি দশা কাটিয়ে- না, জোসেফের সাথে তার দেখা হয়নি। কিন্তু কী করলো মেয়েটা? লেখার হাত তো ভালই ছিল। এখন কোটিপতির বউ হওয়া ছাড়া বিশেষ কিছু করছে কি? কই- কে তো কোটিপতির কন্যা আনার এত ফোনের পরও ভেবেছে প্রাগ ছেড়ে আমেরিকা গিয়ে সে লিখতে পারবে কিনা? সব দিক থেকে সোনিয়াই সেরা সঙ্গিনী হতে পারত তার। তবে বড় অন্যায় হয়ে গেছে তার পক্ষ থেকে। আজ সোনিয়া যদি খ্রিষ্টান যুবকের সাথে জীবন কাটানোর সিদ্ধান্তও নেয়, জোসেফ তাকে একেবারেই দায়ি করতে পারেনা। সোনিয়ার সাথে আর কথা হবে না তার… জোয়া অমন ক্রুদ্ধ, অমনি একা আর কিছু বিবাহিত পুরুষের বান্ধবী হিসেবেই থেকে যাবে…সরলা আনাও কি আর ক্ষমা করবে তাকে?