মঙ্গলবার, ১৩ জুলাই ২০২১, ০১:১৫ পূর্বাহ্ন
তোমার খোলা হাওয়া
ইরা রহমান যখন শায়ানকে প্রথমবার দেখলেন তখন নিজের অজান্তেই বলে ফেললেন, “অনন্য!” শায়ানের মতো কাউকে তিনি আগে কখনো দেখেননি। শায়ানের বাবা-মা অবশ্য নিজেদের ছেলেকে অস্বাভাবিক বলে মনে করেন।
-শায়ানের ডানা দুটো কেটে ফেলতে হবে।
-ঠিক বলেছো। আমাদের ছেলে আমাদের মতো হবে। সমাজে আমাদের কত সুনাম! এরকম অদ্ভুত হওয়া যাবে না।
-আমি সেরা সার্জনদের কাছে যাব। কীভাবে ডানাগুলো কেটে ফেলা যায় দেখতে হবে।
শায়ান নিজের ঘর থেকে তার বাবা-মায়ের এসব কথা শুনতে পাচ্ছিল। বাবা-মায়ের আধিপত্যের মধ্যে ছেলেটা সবসময় চুপসে থাকে। ভয়ে কখনো কিছু বলতে পারে না তাদের। তাকে ঘর থেকে বের হতে দেন না বাবা-মা। তাদের ছেলের এ-রকম দুটো ডানা আছে, এটা তাদের জন্য অসম্মানের কারণ হবে। কেমন অসুন্দর একটা ব্যাপার! মানুষের আবার ডানা গজিয়েছে!
-আমার মেয়েকে একদম রাজকন্যা মনে হবে এই ড্রেসটা পরলে।
-আহা, দেরি হয়ে যাচ্ছে তো। মেহমানরা সবাই চলে এসেছে।
আজ শায়ানদের বাসায় তার ছোটবোন শ্রেয়ার জন্মদিনের অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়েছে। শ্রেয়াকে ড্রেস পরিয়ে তার মা যখন তাকে রাজকন্যার মত লাগবে বলে গর্ববোধ করছিলেন তখন বাবা তাড়া দিলেন। শ্রেয়াকে নিয়ে আনন্দ করলেও শায়ানের বেলায় তারা নির্বিকার। শায়ানকে কখনও জনসম্মুখে আনেন না। তাকে নিয়ে যে সমাজে কানাঘুষা চলে তা অবশ্য শায়ানের বাবা-মা বুঝেন। তাই তার ডানা দুটো কেটে ফেলার ব্যবস্থা করতে তারা উম্মুখ হয়ে আছেন।
আজকের অনুষ্ঠানে অতিথিদের মধ্যে আছেন ইরা রহমান। তিনি শ্রেয়ার স্কুলে চিত্রাঙ্কন-এর শিক্ষিকা। শ্রেয়া উনাকে খুব পছন্দ করে। প্রিয় শিক্ষিকাকে নিজের ঘর দেখাবে বলে নিয়ে গেল শ্রেয়া। সে, যে ছবিগুলো এঁকেছে সেগুলো দেখাতে চায়। পথিমধ্যে শায়ানের ঘরের দিকে নজর গেল ইরা রহমানের। তিনি এর আগে কখনো ডানাওয়ালা মানবশিশু দেখেননি। এই শহরে নতুন হওয়ায় শায়ান সম্পর্কে প্রচলিত কানাঘুষাও কানে যায়নি ইরার। তিনি মুগ্ধ হয়ে দেখলেন শায়ানের শুভ্র পালক-মোড়ানো বিশাল দুটি ডানা।
-আপনারা আপনাদের ছেলেকে এভাবে আটকে রেখেছেন কেন?
-নিজের সন্তানকে কীভাবে লালন-পালন করব, তা কি এখন আপনার কাছে শিখতে হবে?
-আপনারা অন্যায় করছেন তার প্রতি। আমি দেখছি কী করতে পারি।
-আপনি দেখতে থাকুন; আমরা এর মধ্যে তার ডানা কাটার ব্যবস্থা করছি।
ইরা রহমান শায়ানের বাবার সাথে কথা বলছিলেন। কোনও সমাধান বের হলো না তাতে। তিনি চাচ্ছিলেন যে, শায়ানের বন্দি জীবনের অবসান ঘটুক।
শায়ান আকাশে পাখিদের উড়তে দেখে, নিজের ঘরের জানালা দিয়ে। তার খুব ইচ্ছা হয়, যেন সে ওদের মতো মুক্ত হয়ে আকাশে উড়ে বেড়ায়। খুব ছোটবেলায় কখনও তার ডানা বেঁধে রাখা হতো বা কখনও ছেঁটে ফেলা হতো। এ-কারণে সে শিখতেই পারেনি কীভাবে উড়তে হয়। এখন সে আর কিছুই পারে না, শুধু চুপচাপ বসে থাকা ছাড়া। বাবা-মায়ের কাছে প্রতিনিয়ত অবহেলিত হয়; কারণ সে অন্যদের মতো নয়।
এর মধ্যে ইরা রহমান আইনের সহায়তা নিলেন। শায়ানকে মুক্তজীবন উপহার দিতে চাইলেন। এই উদ্যোগের খবর শায়ানের বাবা-মায়ের কাছেও পৌঁছে গেলো।
– ডাক্তার সাহেব, খুব আশা নিয়ে আপনার কাছে এসেছি।
-কী ব্যাপার?
-আমার ছেলের ডানা দুটো কাটতে হবে।
-আমি আপনাকে আগেও বলেছি, আমি এটা পারবো না। এটা উচিত না। আর এতে তার ক্ষতি হতে পারে।
-তাহলে তো আমাকেই কিছু করতে হবে।
পরিচিত একজন সার্জনের কাছে গিয়ে, ছেলের ডানা কেটে দেয়ার জন্য মিনতি করতে লাগলেন শায়ানের বাবা। তিনি রাজি না হলে হতাশ হয়ে বাসায় ফিরে আসলেন।
শাওনের বাবা বাসায় ফিরে নিজ হাতে শায়ানের ডানা কেটে ফেলতে চাইলেন। শায়ান বাধা দিল। পালাতে গিয়ে দৌঁড়ে বাসার ছাদে উঠে আসলো। নিজেকে বাঁচানোর আর কোনও পথ না দেখে, ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে উড়ার চেষ্টা করলো সে। এই মনে হয় তার জীবন শেষ…
নিজেকে ও অন্য সবাইকে অবাক করে দিল শায়ান। সে উড়তে পারছে। উড়তে উড়তে অনেক দূরে চলে গেলো শায়ান। আর কোনদিন বাবা-মায়ের কাছে ফিরে আসলো না। মুক্ত প্রকৃতির মাঝে আশ্রয় খুঁজে পেলো সে।