বৃহস্পতিবার, ১৪ অক্টোবর ২০২১, ০৪:২৮ অপরাহ্ন
অনুক্রমণ
(১)
রাজিব হাসান কপাল কুঁচকে দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকালেন। সময় কি আজকে এগুচ্ছে না? চোখ বুজার আগে দেখলেন ৪টা ৫ বাজে। চোখ খোলার পর দেখলেন দশ মিনিটও পার হয়নি। কিন্তু মনে হচ্ছে দীর্ঘ ঘুম শেষ করে উঠেছেন। ঘড়ি থেকে চোখ নামিয়ে নড়েচড়ে বসলেন তিনি। টেবিলে রাখা হাত ঘড়ি তুলে নিয়ে তা হাতে পরতে পরতে চতুর্দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন। আজ অফিসে মন টিকছে না। অস্থির লাগছে খুব। প্রচণ্ড গরম পড়েছে। এসি রুমে থেকেও গরম-ভাব দূর করতে পারছেন না শরীর থেকে। যতই বয়স বাড়ছে ততই গরম বাড়ছে তার। রীতিমতো প্রেশার আপ-ডাউন করছে। মেজাজ খানিকটা খিটখিটে হয়ে আছে। শান্ত স্বভাবের রাজিব হাসান কখনও মেজাজ দেখান না। চিৎকার করে কথা ব’লে, বিচ্ছিরী ব্যবহার করে রাগ জাহির করা তার স্বভাব না। রাগ উঠার সঙ্গে সঙ্গে একটা বই হাতে নিয়ে পড়তে শুরু করেন। কয়েক পৃষ্ঠা পড়ার পর আপনা-আপনি মেজাজ ঠান্ডা হয়ে যায়। অবশ্য কয়েকদিন ধরে এ-পদ্ধতি বিশেষ ফল দিতে পারছে না। নতুন পদ্ধতি খোঁজার চেষ্টায় আছেন তিনি।
রাজিব চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। তাড়াতাড়ি বের হয়ে যাওয়ার পণ করেছেন। অফিস থেকে বের হয়ে সামনের কফি শপে এক মগ কফি খেয়ে বাসার দিকে যাওয়া যায়। টেবিলে রাখা ফাইলগুলো গুছিয়ে পরিপাটি করে শেলফে রাখলেন। তার অফিস ঘরটা বেশ বড়। অফিসের দরকারি ফাইল-পত্র, আসবাবপত্র ছাড়া আর কিছুই নেই। তিনি প্রয়োজনবোধ করেন না। অফিস ঘর তো আর শখের ঘর নয় যে একে নান্দনিক রূপ দিতে হবে। রাজিব সাহেব ঘড়ির দিকে তাকালেন। সাড়ে চারটা বাজে। আর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলে আসরের নামাজ সেরে বের হতে পারবেন। তিনি টেবিলের উপরে রাখা মোবাইলটা হাতে নিলেন। স্পর্শ করতেই একটি ছবি জ্বলজ্বল করে ভেসে উঠলো। পরিবারের ছবি। তিনি তার স্ত্রী নাদিয়াকে জড়িয়ে সোফায় বসে আছেন। আর নাদিয়ার কোলে মুখ গোমড়া করে বসে আছে তাদের একমাত্র কন্যা সন্তান রামিয়া। ছবি তোলার সময় খুব বিরক্ত করছিল সে। ৫ বছরের মেয়ে আজকাল কোলে উঠতেই চায় না। তরতর করে সারা বাড়ি হেঁটে বেড়াবে। বিড়বিড় করে কথা বলেই যাবে। আবদার করবে। আবদার না পূরণ করলে কপালে শনি আছে। ঘ্যানঘ্যান করে কাঁদা যেন শক্ত অভ্যাসে পরিণত হচ্ছে। নাদিয়া কী সুন্দর করে হাসছে! ঠোঁট টিপে হাসছে। ছবি থেকে চোখ সরাতেই মোবাইল বেজে উঠলো। রাজিব হাসানের স্ত্রী নাদিয়া কল করেছেন। রিসিভ করে শান্ত গলায় বললেন, তোমার কি কিছু লাগবে নাদিয়া?
ওপাশ থেকে ভয়ার্ত-কণ্ঠে তার স্ত্রী নাদিয়া বললেন, তুমি কখন বাসায় ফিরবে?
স্ত্রীর গলার স্বর শুনে একটু ঘাবড়ে গেলেন রাজিব। বাসায় কোন কিছু হল নাকি? রাজিব হাসান ভারী গলায় জিগ্যেস করলেন, কী হয়েছে নাদিয়া?
নাদিয়া আমতা আমতা করে বললেন, কী যে হচ্ছে! শুনো, তোমার ভাই তো মহা এক কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলেছে।
-রিয়াদ আবার কি করলো?
-বাসায় আসো তারপর বলি?
-না, তুমি এক্ষণই বলবে।
নাদিয়া কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বললেন, আমাদের বাসার গলির মুখে একটা ভ্যানে করে কাপড় বিক্রি করছে তোমার ভাই রিয়াদ।
রাজিব হাসান চমকালেন না। তিনি স্বাভাবিক স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, সে কতক্ষণ ধরে আছে?
নাদিয়া বললেন, তা জানি না। নিলুফার মার কাছে শুনলাম সে সকাল বেলায় এসেছে।
রাজিব নির্লিপ্ত-কণ্ঠে বললেন, ও।
-তুমি শুনে অবাক হওনি?
-অবাক হবার কি আছে? রিয়াদ কেমন সেটা আমিও জানি তুমিও জানো।
-তারপরও তোমার ছোট ভাই বলে কথা। বিরাট কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলল আর তুমি এমন এক ভাব নিয়ে কথা বলছ যেন কিছুই হয়নি।
-নিলুফার মা’র কাছে জিজ্ঞেস করেছো ও কী করছে ওখানে?
নাদিয়া বললেন, করেছি। সে সবাইকে আঙুল তুলে বড় ভাইয়ের বাসা দেখাচ্ছে। তার মূল উদ্দেশ্য আমাদেরকে অপমান করা।
রাজিব মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, হুম।
নাদিয়া নরম স্বরে বললেন, কিছু টাকা পাঠিয়ে দেই?
-কাকে?
-রিয়াদকে।
রাজিব রেগে গিয়ে ভারী গলায় বললেন, না।
রাজিবের গলার স্বর শুনে কিছুটা ঘাবড়ে গিয়ে নাদিয়া ম্লান গলায় বললেন, আম্মা এসেছেন।
-ওহ্ আচ্ছা। কিছু আনতে হবে?
নাদিয়া আবার বললেন, আম্মা এসেছেন।
রাজিব বিরক্ত গলায় বললেন, আম্মা এসেছে সেটা দু’বার বলতে হবে কেন? আমি তো শুনতে পেয়েছি।
নাদিয়া আয়োজন করে শ্বাস ফেলে বললেন, তোমার আম্মা এসেছেন।
রাজিব হাসান এবার অবাক হলেন। তার বিস্ময়ের সীমা রইল না। হঠাৎ যেন শরীরে ঠান্ডা শিহরণ দিয়ে উঠলো। বুক ধড়ফড় করা শুরু হল। কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, আম্মা এসেছেন?
নাদিয়া শান্ত গলায় বললেন, হুম। কেন এসেছেন জানি না।
শরীরের কাঁপন থামেনি। হাত দিয়ে কপালে হালকা স্পর্শ করলেন রাজিব। বিন্দু বিন্দু ঘাম জমা হয়েছে। তিনি কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, আমার ফিরতে দেরি হবে।
নাদিয়া স্বাভাবিক কণ্ঠে বললেন, তিনি তোমার সাথে দেখা করতে এসেছেন। তোমাকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে চান।
রাজিব কিছু না বলে কল কেটে দিলেন। বুক ধক ধক করছে। মুহূর্তেই যেন বুকের মাঝখান থেকে একটা বড়সড় শক্তি গায়েব হয়ে গেলো। পুরো দেহকে শক্তিহীন করে গেলো।
তার মা সালেহা বেগম বাসায় এসেছেন এ-কথা শুনে জগত ওলটপালট হয়ে যাবার পিছনে শক্ত কারণ আছে। ৭ বছর আগে সালেহা বেগমের দ্বিতীয় বিবাহের পর রাজিব নিজ থেকে মা’র সাথে সব প্রকার যোগাযোগ বন্ধ করে দেন। দ্বিতীয় বিয়ে মেনে নিতে পারেননি রাজিব। নিজের আপন ফুপার সঙ্গে মায়ের বিয়ে কে মেনে নিতে পারে?
নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারে সংসার চালানো যেন ঠেলাগাড়ির মতো। ঠেলে ঠেলে ধীরে ধীরে এগুতে হয়। বাবা রাশেদ হাসান তৃতীয় শ্রেণির সরকারি চাকুরিজীবী ছিলেন। চুপচাপ স্বভাবের মানুষটিকে কখনও কোন বিষয় নিয়ে উত্তেজিত হতে দেখেননি রাজিব। মা সালেহা বেগমের সাথে সম্পর্ক ছিল খুব ঠান্ডা। ঝগড়াঝাঁটির চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায়নি। দুজনই বেশ ঠান্ডা মাথার মানুষ।
গুটি কয়েক সুযোগসুবিধা বাদে প্রচণ্ড কষ্ট করে সংসারের চাকা ঘুরানো হতো। দু’ছেলেকে নিয়ে রাশেদ আর সালেহার ছোট সংসার। রাজিব আর রিয়াদ দু’জন পড়াশুনায় তুখোড় ছিল। বয়সে রিয়াদ রাজিবের থেকে ৪বছরের ছোট। বৃত্তি পেয়ে দু’জন ইন্টার পর্যন্ত নিজের মতো করে খরচা চালিয়ে নিয়ে যেতে পেরেছে। রাজিব সঠিকভাবে পড়াশুনা শেষ করে বহু কষ্টে নিজের এক ফার্ম করতে সক্ষম হলেন, আর ওদিকে ছোট ভাই রিয়াদ রাজনীতিতে ঢুকে পড়াশুনা ছেড়ে জীবন বরবাদ করলো।
রাজিব স্নাতক শেষ করে যখন অল্প বেতনে চাকরি শুরু করলেন তখনি তার বাবা ভীষণভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। পুরো সংসার চালানোর দায়িত্ব তার কাঁধে চলে আসে। সংসার চালাও, ভাইয়ের পড়াশুনার খরচ বহন কর, বাবার চিকিৎসা চালাও – এ তিন মুখ্য কাজ করে তার পকেটে কিছুই থাকতো না। অবশ্য জীবনের একমাত্র প্রেম নাদিয়া যেন তার ভাগ্যের চাবিকাঠি। কলেজে দু’জনের পরিচয়, তারপর প্রণয় শুরু। দুর্দিনেও তাকে ছেড়ে যায়নি। অন্য কোথাও বিয়ে করেননি। রাজিবের করুণ আর্থিক অবস্থা দেখেও নাদিয়া বিয়ে করতে রাজি হন। ঘরোয়া পরিবেশে বিয়ের পর্ব ঠিকঠাক মতো সম্পন্ন হল। রাজিবের বয়স তখন ২৫ আর নাদিয়ার ২৪। সংসার ঠিকমতো চলেই না ওদিকে আরেকজন মানুষ বেড়ে গেলো। নাদিয়াও চাকরিতে ঢুকে গেলেন। স্বামী-স্ত্রী সারাদিন খেটেখুটে রোজগার করে সংসারটাকে ভালো রূপ দেওয়ার চেষ্টা করে গেলো। দুমাসের মাথায় হঠাৎ রাশেদ সাহেবের আকস্মিক মৃত্যু। স্ট্রোক করে না ফেরার দেশে চলে গেলেন। সংসারের চেহারা পাল্টে গেলো আপনাআপনি। সরকারি বাসা ছেড়ে উঠতে হল ভাড়া বাসায়। খরচাপাতি বেড়ে গেল। রিয়াদ পড়ালেখা ছেড়ে বাসায় পড়ে রইল। সালেহা বেগম বিকার-হীনভাবে সংসার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। যেন সংসার টানা রাজিব-নাদিয়ার কাজ। রাজিব অনেকবার রিয়াদকে কাজ করবার তাগাদা দিলেও তাতে কাজ হল না। অবশেষে তার খরচা দেওয়া বন্ধ করে দিলেন। সালেহা আপত্তি জানালেও রাজিব সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেননি। ছোট ভাই রিয়াদ কাউকে কোন কিছু না জানিয়ে একদিন বাড়ি থেকে চলে গেল। সালেহাও গ্রামের বাড়িতে চলে গেলেন। হঠাৎ করে দায়িত্ব থেকে বিরাট মুক্তি। রাজিব আর নাদিয়া টাকা জমানো শুরু করলেন। নিজের ফার্ম করবার ইচ্ছে তার আগের থেকেও ছিল কিন্তু হঠাৎ এক আকস্মিক বিশাল সুযোগ হাতছানি দিল। বন্ধুর সাথে ফার্ম খুলে বসলেন। ২-৩ বছরের মাথায় লাভের মুখ দেখলেন তারা। জীবন বদলাতে শুরু করলো। এ যেন নাটকীয় পরিবর্তন। নাদিয়া নিজের কর্মক্ষেত্রেও সফলতা পেলেন। রাজিব আর নাদিয়ার সুখী জীবনের সূচনা। ভাড়া বাড়ি ছেড়ে দিয়ে নিজেদের কেনা ফ্ল্যাটে উঠলেন। রাজিব মা সালেহা আর ভাই রিয়াদকে নিজের ফ্ল্যাটে উঠবার জন্য অনুরোধ করলেও দু’জনই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলো। রিয়াদ এক বন্ধু বাসায় দীর্ঘদিন ধরে থেকে নিজের অবস্থা ধীরে ধীরে অবনতির চরম পর্যায়ে নিয়ে গেলো। মদ-গাজা খেয়ে জীবনকে ছারখার করে ফেলল। ওদিকে সালেহা ছেলেদের না জানিয়ে বিয়ে করে বসলেন। আর কাউকে নয় রাজিবের বড় ফুপা খুরশেদ রহমানকে।
সংবাদটা শুনে রাজিব অধিক শোকে পাথর হয়ে যাবার অবস্থা হল। ক্ষোভ এবং রাগের বশে মায়ের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিলেন। রাজিবের বড় ফুপি মারা গেছেন তার বাবা মারা যাবার ১বছর পর। তাই বলে কি আপন ফুপাকে সালেহার বিয়ে করতে হবে?
রাজিব কিন্তু নিজের দায়িত্ব অবশ্যই পালন করেছেন। নির্দিষ্ট অংকের টাকা তিনি প্রতিমাসে মাকে পাঠান। সালেহার সামনে দাঁড়ানোর শক্তি তার নেই। রাজিবের রাগ ৭বছরেও কমেনি। তিনি কি এতোই দুর্বল যে তার মার ভরণপোষণের দায়িত্ব নিতে পারবেন না? বিয়ে করবার আগে জিজ্ঞেস করবার প্রয়োজনবোধ করলেন না? আর পরিবারের মধ্যেই কেন বিয়ে করতে হল তাকে? কোন পারিবারিক বিয়েতে লজ্জায় সে যেতে পারে না। অবশেষে ফুপাতো ভাইবোনেরা তার সৎ ভাইবোনে পরিণত হল।
সালেহা বেগম যোগাযোগ করবার চেষ্টা করছিলেন কিন্তু সম্ভব হয়নি। রাজিব কড়া-কণ্ঠে নাদিয়াকে বারণ করে রেখেছেন। বড় ছেলের একমাত্র মেয়ে দেখতে সালেহা যেদিন আসলেন সেদিন বাসায় ছিলেন রাজিব। যতক্ষণ সালেহা বাসায় ছিলেন ততক্ষণ তিনি নিজের ঘরে নিজেকে বন্দী করে রেখেছিলেন।
কিছু কিছু সম্পর্ক মানুষ কখনও গ্রহণ করতে পারে না। রাজিবের ক্ষেত্রেও তাই হল। দিন গড়াতে লাগলো কিন্তু অভিমানের পাথরে ভাঙন ধরল না। প্রথা ভেঙে বের হতে পারলেন না।
রাজিব ছোটভাইকেও সঠিক পথে আনবার চেষ্টা করেছিলেন। মাদক নিরাময় কেন্দ্রে এক বছর রেখে বাসায় এনেছিলেন। ৬মাসের মধ্যে নাদিয়ার কিছু গয়না নিয়ে সে গায়েব হয়ে যায়। ২বছর পর আবার ফেরত আসে। বড় ভাইয়ের কাছে ক্ষমা চেয়ে রিয়াদ বিশ্বাস অর্জন করার চেষ্টায় সফল হয়। তার জন্যে একটা মুদির দোকান ব্যবস্থা করে দিলো রাজিব। ৩মাসের মধ্যে লোকসান করে আবার পালিয়ে যায়। এরপর তার খোঁজ পাওয়া সম্ভব হয়নি। অবশেষে রিয়াদ ফিরল কাপড় বিক্রেতা হিসেবে।
রাজিব কখনও দুর্নীতি করে উপরে ওঠেনি। আজ তার কাছে টাকা-পয়সা থাকলেও সুস্থ স্বাভাবিক একটি পরিবার নেই।
রাজিবের চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি ঝরছে।
(২)
সালেহা বেগম সোফায় বসে রামিয়াকে দেখছেন। ৫ বছর বয়সী তার নাতনি তড়তড় করে অনেক কথা বলে। আধা ঘণ্টা যাবত রামিয়া তার স্কুলের বন্ধু-বান্ধবীদের সম্পর্কে ভাঙা ভাঙা বাক্যে বলেই যাচ্ছে। কথাগুলো অবশ্য বসে বলছে না। হাতে একটা চারকোণা ইলেকট্রনিক যন্ত্র নিয়ে ঘুরছে আর বলছে। যন্ত্রটার থেকে চোখ সরাচ্ছে না। সালেহা বেগম জিজ্ঞেস করলেন, এটা কী?
রামিয়া যন্ত্রের উপর স্পর্শ করে বলল, এটা হল প্যাড।
-এটা দিয়ে কী করে?
-এটা দিয়ে আমি গেইম খেলি।
-কী গেইম খেল?
-দাদু আমাকে খেলতে দাও।
সালেহা বেগম শাড়ির আঁচল দিয়ে কপাল মুছলেন। ড্রয়িংরুমটা প্রয়োজনের তুলনায় বড়। এসি চলছে তাও গরম লাগছে। টপ ফ্লোরে থাকার কারণে ছাদের গরম আসছে ঘরে। বিশাল অ্যাপার্টমেন্ট কিনেছে রাজিব। বিরাট ৩টা ঘর তার সঙ্গে ৩টা বারান্দা, ৩টা টয়লেট। ডাইনিং, কিচেনও প্রয়োজনের তুলনায় বেশ বড়। সারাজীবন তিনি থেকে এসেছেন খুপরি এক বাসায়। দুটো ঘর ছিল ছোট ছোট। ছেলে দুটো খুব কষ্টে ঘুমাতো। নাদিয়া আসার পর রিয়াদ তার ঘরে নিচে বিছানা করে ঘুমাতে হতো। সালেহা বেগম দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে রামিয়ার কার্যক্রম খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন। গায়ের রঙ বেশ ফর্সা রামিয়ার। বাবার গায়ের রঙ পেয়েছে। নাদিয়া শ্যামলা হলেও রামিয়া তার রঙ পায়নি। চেহারা অবশ্য তার মায়ের মতো। ৫ বছরে দেখতে বড়সড় হয়েছে। বাবার মতো লম্বা হবে। রামিয়া কুঁজো হয়ে এখনও প্যাড নামক যন্ত্রটার দিকে তাকিয়ে আছে। সালেহা বেগম বিরক্ত-স্বরে ডেকে উঠলেন, নাদিয়া! নাদিয়া!
নাদিয়া রান্নাঘর থেকে চেঁচিয়ে বললেন, কী হয়েছে আম্মা?
-কী করছো ওখানে? এদিকে আসো।
-আসছি আম্মা।
সালেহা বেগম আবার রামিয়ার দিকে তাকালেন। সে এখনও মাথা তুলছে না। তিনি কোমলকন্ঠে বললেন, রামিয়া এদিকে আসো।
-না দাদু। আমি কাজ করছি।
-এদিকে আসো বলছি।
-না।
নাদিয়া একটা ট্রেতে করে খাবার নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। রামিয়াকে প্যাড টিপতে দেখে হুংকার দিয়ে বললেন, দাদু ডাকছে আর তুমি যাচ্ছ না কেন? সারাদিন আইপ্যাড টিপতে হবে?
মার বকুনি খেয়ে মুখ ভোঁতা করে সালেহা বেগমের পাশে বসলো রামিয়া। সালেহা তার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন, এরকম যন্ত্রের নেশা হয়েছে কেন?
নাদিয়া ট্রে টেবিলে রেখে বললেন, এখনকার ছেলেমেয়ে এরকমই আম্মা। সারাদিন ইলেকট্রনিক জিনিসপত্র নিয়ে থাকে।
-স্বভাব পরিবর্তন করাও।
-হ্যাঁ। এডিক্টেড হয়ে যাচ্ছে। আচ্ছা আম্মা আপনি কি রিয়াদকে টাকাটা দিয়েছেন?
সালেহা বেগম মাথা নাড়িয়ে বললেন, হুম। সে এমন কাজ আর করবে না বলেছে।
নাদিয়া করুণ গলায় বললেন, আম্মা টাকার ব্যাপারটা যেন রাজিব না জানে। শুনলে ও খুব রাগ করবে।
সালেহা বেগম তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নাদিয়ার দিকে তাকালেন। রাজিবের প্রতি নাদিয়ার ভালোবাসা জ্বলজ্বল করছে তার মুখমণ্ডলে। তার ভয়ার্ত চেহারা সব কথা আপনাআপনি বলে দিচ্ছে।
কলিং-বেল বেজে উঠলো। সালেহা বেগম ঘোমটা ঠিক করে নড়েচড়ে বসলেন। নাদিয়া রামিয়ার কাছ থেকে আইপ্যাড ছিনিয়ে নিয়ে কর্কশ গলায় বললেন, ভিতরে যাও।
রামিয়া কাঁদতে কাঁদতে ভিতরে চলে গেলো। সালেহা বেগম নিচু স্বরে বললেন, রাজিব নাকি?
নাদিয়া তড়িঘড়ি করে দরজার কাছে গেলেন। দরজা খুলে দেখলেন রাজিব দাঁড়িয়ে আছে। রাজিবের মুখমণ্ডল লাল এবং তা কিছুটা ভীত। হাতে একটা মিষ্টির প্যাকেট। নাদিয়া আগ বাড়িয়ে মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে বললেন, যাও ঘরে যাও। ফ্রেশ হও।
রাজিব কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, আম্মা কোথায়?
নাদিয়া বললেন, ড্রয়িং রুমে।
রাজিব জুতো খুলে ভিতরে ঢুকলেন। বড় বড় করে কয়েকটা শ্বাস নিয়ে চোখ বন্ধ করে ড্রয়িংরুমের দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলেন। চোখ খুলে দেখলেন সালেহা বেগম বসে আছেন মাথা নিচু করে। আজ তিনি হালকা নীল রঙের একটি শাড়ি পরেছেন। শাড়িটা রাজিব তার প্রথম মাইনে নিয়ে কিনে দিয়েছিলেন। এখনও শাড়িটা আছে! ভাবতেই রাজিবের মন খানিকটা আনন্দিত হল। রাজিবের উপস্থিতি বুঝতে পেরে মাথা তুলে তাকালেন সালেহা। চেহারা আগের থেকে বেশ নষ্ট হয়ে গিয়েছে। চোখ বসে গিয়েছে। গাল ভেঙে গেছে। চোখের চশমার ফ্রেমটা বেশ ময়লা। কিন্তু চেহারার ঔজ্জ্বল্য এখনও অটুট। ঘোমটা ঠিক করতে করতে রাজিবের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট টিপে হেসে সালেহা বেগম বললেন, ভালো আছো?
রাজিব চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে সোফায় বসতে বসতে শান্ত গলায় বললেন, আলহামদুলিল্লাহ্। ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?
সালেহা বেগম চশমা খুলে হাতে নিয়ে বললেন, ভালো নাই। চোখে ছানি পড়েছে।
রাজিব অবাক-কণ্ঠে বললেন, সে কি! আমাকে আগে বলেননি কেন?
সালেহা বেগম স্বাভাবিক গলায় বললেন, তোমাকে কি করে বলবো? তুমি তো কথাই বলতে চাও না আমার সাথে।
রাজিব প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্য নাদিয়াকে ডাকতে থাকলেন। চিৎকার করে বললেন, নাদিয়া! মিষ্টিগুলো নিয়ে আসো।
সালেহা বেগম বললেন, ডায়াবেটিসের কারণে মিষ্টি খেতে পারি না।
-ওহ আচ্ছা। টেবিলের খাবার তো ঠান্ডা হচ্ছে। নিন।
-খাবার পরে খাওয়া যাবে।
-হুম।
সুনসান নীরবতা ঘরে। দুজন চুপ করে আছেন। ফ্যান ঘুরার শব্দ কানে আসছে। রাজিব সোফায় বসে পা নাচাচ্ছেন। সালেহা বেগম নীরবতা ভেঙে বললেন, আমি হজ্বে যাচ্ছি।
রাজিব বললেন, সে তো খুব ভালো সংবাদ।
সালেহা বেগম মাথা নিচু করলেন। চোখ মুছতে মুছতে বললেন, বাবা। আমি জীবনে অনেক ভুল করেছি। তোমাদের অনেক কষ্ট দিয়েছি। মাফ করে দিও।
রাজিব জমে থাকা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে কাতর গলায় বললেন, আমি মাফ করার কেউ নই।
সালেহা বেগম কাঁদতে কাঁদতে বললেন, মাফ করে দিও। তোমার ভাইকেও মাফ করে দিও। তোমার ভালোবাসাকে সবাই সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে পারেনি। মাফ করে দিও।
রাজিব আবেগ-আপ্লুত হয়ে বললেন, আমি মাফ করে দিয়েছি তোমাকে। মা! তুমি সবকিছু ছেড়েছুড়ে আমার এখানে চলে আসো।
সালেহা বেগম শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বললেন, সম্ভব না। সংসার ছেড়ে আসা আমার পক্ষে সম্ভব না।
রাজিব রাগান্বিত কণ্ঠে বললেন, “ঠিক আছে আমার বলা ভুল হয়েছে।”
-ওভাবে বোলো না।
-তাহলে কী বলবো? ৭ বছর পর আপনি এসেছেন হজ্বের জন্য দু’য়া নিতে? মাফ করে দিলাম। খুশি?
-এভাবে কথা বলবে না। আমি তোমার মা।
-ছোট ছেলের ব্যাপারে আপনার কিছু বলার আছে?
-না, নেই।
-অকর্মার ঢেঁকি একটা। আমার বাসার গলির সামনে সে কাপড় বিক্রি করতে এসেছে। মানুষ এতো খারাপ হয় কীভাবে?
-ওর কথা বাদ দাও। ও নষ্ট হয়ে গিয়েছে।
-কিন্তু আমাকে তো টানতে হবে।
সালেহা বেগম বললেন, তোমাকে কাউকেই টানতে হবে না।
রাজিব ঠান্ডা গলায় বললেন, আপনি সুখে আছেন?
সালেহা বেগম মুখ মুছতে মুছতে বললেন, জানি না।
-আপনি কী করে ফুপার সাথে বিয়ে বসলেন? একবারও আমার কথা চিন্তা করলেন না?
-আমি একজন বয়স্ক মানুষ। আমি আমার সিদ্ধান্ত নিতে পারি।
-বয়স্ক মানুষেরা ভুল করেন।
-আমি ভুল করিনি।
-আপনি আমাকে একবার জিজ্ঞেস করতে পারতেন।
-জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন মনে করিনি।
রাজিব উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “আম্মা আমি ভিতরে যাই।”
সালেহা বেগম বললেন, তুই মাফ করেছিস সেটাই আমার কাছে বড়।
রাজিব সোফা থেকে উঠে গটগট করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। সালেহা বেগম শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ ঢেকে মাথা নিচু করে বসে থাকলেন। আজ তিনি ছেলের কাছেই থাকতে পারতেন। দ্বিতীয় বিবাহের পর তার জীবনরেখা পাল্টে যাবে সেটা ভাবা যেন এক ধরনের ভুল স্বপ্ন দেখা। দ্বিতীয় সংসারেও টানাপোড়েন। সৎ একটা ছেলে আর দুটো মেয়ে বছরে একবারও দেখতে আসে না। বাড়িতে আসলেও মামিকে তারা মা ডাকতে নারাজ। আর স্বামী খুরশেদকে প্রতিনিয়ত কটু কথা শুনতে হয়। এ শেষ বয়সে একা থাকার গ্লানি তারা কী করে মানুষদের বুঝাবে? তিনি আর খুরশেদ নিজের মতো করে জীবন চালিয়ে নিচ্ছেন, এতে সমাজের অন্যদের মাথা-ব্যথার কী হল? বয়সের কারণে, সম্পর্কের জোরে ব্যক্তি-স্বাধীনতাকে বধ করে রাখবে আধুনিক শ্রেণির সমাজ-ব্যবস্থাপকরা? সালেহা বেগম চোখ মুছলেন। বারবার চোখ ভিজে যাচ্ছে জলে। তার দ্বিতীয় বিবাহের একমাত্র কারণ ছিল একাকীত্ব মোচন করা। কিন্তু মোচন-কর্ম করতে গিয়ে তিনি মর্যাদা, সম্পর্ক সব হারিয়ে ফেলেছেন। যেন আধুনিক সমাজ তার চাওয়া-পাওয়াকে পাত্তা দিতে চায় না। যেন প্রথা-ভঙ্গকারীরা পুরনো প্রথাকে অনুসরণ করছে। এই যেন যুগ যুগ ধরে চলে আসা অদৃশ্য অনুক্রমণ প্রক্রিয়া।
রাজিব বিছানায় বসে হাঁপাচ্ছে। আজ ৭ বছর পর মাকে সামনাসামনি দেখতে পেয়েছে। ভেবেছিল সবধরনের অভিযোগ ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে সব সমস্যা সমাধান করে ফেলবে। পারলো না সে। সকল অভিমান বিসর্জন দিয়ে মা’র বর্তমান অবস্থা মেনে নিতে পারলো না। রাজিব বিড়বিড় করে বললো, “আম্মা তোমাকে আমি ক্ষমা করতে পারলাম না।”